চলচ্চিত্রের সঙ্গেই বসবাস তার। নির্মাণের স্বপ্ন দেখেছিলেন সেই ছোটবেলায়।
মুখজুড়ে হালকা সাদা দাঁড়ি। স্বচ্ছ, গোল ফ্রেমের চশমার আড়ালে শান্ত সুবোধ চোখ জোড়া যেন কিছু একটা খুঁজে চলে প্রতিনিয়ত। সবসময় ঠোঁটে ঝুলে থাকে হাসি। কথার ফাঁকে ফাঁকে রসিকতাও করেন। একদিকে তার কণ্ঠ চুইয়ে বেরিয়ে আসে রসিকতা। সেই কণ্ঠও আবার, অন্যদিকে, নিয়ম ভাঙ্গে। বলে চলে, ‘সিনেমা বানানোর নির্দিষ্ট কোন নিয়ম নীতি নেই। ’ প্রচলিত ধারা ভেঙ্গে তার নির্মাণ তাই ভিন্নতার স্বপ্ন দেখায়।
বাংলানিউজ : ৫৫ বছর ধরে নির্মাণের সঙ্গে আছেন। দীর্ঘ যাত্রা। খুবই গতানুগতিক প্রশ্ন, ঠিক কবে ভেবে রেখেছিলেন যে, আপনি নির্মাতা হবেন?
শ্যাম বেনেগাল : চলচ্চিত্র তো আসলে এক ধরণের অ্যাডভেঞ্চার। নতুন নতুন অভিজ্ঞতা। চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রক্রিয়াকে বলা যেতে পারে, এক্সাইটিং জার্নি এবং আবিষ্কারের একটা পদ্ধতি। সিনেমাই আমাকে সিনেমা বানাতে উৎসাহ যুগিয়েছে। বাবা ছিলেন আলোকচিত্রী। তার একটা ১৬ মিলিমিটারের মুভি ক্যামেরা ছিলো। বাবা সেটা দিয়ে এটা সেটা বানাতেন। ফ্যামিলি মুভি। রাতে খাবার শেষ করে একত্রে বসে আমরা দেখতাম। আমার বয়স যখন মাত্র ছয়, তখন একটা ছবি দেখলাম ‘দ্য ক্যাট পিপল’ নামে। ভৌতিক চলচ্চিত্র। এটা দেখার পর থেকে অনুভূতি জন্মালো, আমি চলচ্চিত্র নির্মাতা হতে চাই।
বাংলানিউজ : সে ইচ্ছার মোটামুটি প্রতিফলন ঘটলো ১২ বছর বয়সে। ওই বয়সেই তো আপনি প্রথম ছবি নির্মাণ করেন, নাকি?
বেনেগাল : এক জন্মদিনে আমার বাবা ম্যাজিক লন্ঠন উপহার দিলেন। এটা ছোটখাট একটি প্রজেক্টর। বেডসিট নিচে বসে অন্ধকার করে ভাই-বোনরা মিলে তাতে ছবি দেখতাম। ১২-১৩ বছর বয়স যখন, বাবার ক্যামেরা দিয়ে ছবি বানিয়ে ফেললাম। সে গল্পটা একটু বলি, এক গরমের ছুটিতে সব বন্ধুরা এক জায়গায় হলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম, ছবি বানাবো। বিষয় হচ্ছে- পিকনিক। স্টেশন থেকে কয়েকজন বন্ধু বের হলো, এখানে সেখানে ঘুরলো, পিকনিকের আয়োজন করা হলো, অতঃপর একজন নিখোঁজ। গল্পটা মোটামুটি এ রকম ছিলো। ছবির নাম দিয়েছিলাম ‘ছুট্টিও মে মজমাজা’।
বাংলানিউজ : আপনার নির্মাতা হয়ে ওঠার পথে সত্যজিৎ রায় বিশেষ প্রভাব রেখেছেন। সেটা বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে বলেছেনও। আরও বিস্তারিত শুনতে চাই।
বেনেগাল : আমার একজন চাচা ছিলেন কলকাতায়। ৫০ দশকের মাঝামাঝি সময়ের কথা। তখন কলেজে পড়ি। মাঝে মাঝে ছুটিতে কলকাতায় যেতাম। সিনেমার প্রতি আমার আগ্রহ তিনি জানতেন। বললেন, তুমি সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালি’ দেখো। আমি গেলাম, দেখলাম। ছবিটি আমার মনকে একেবারে ওলট পালট করে দিলো। খুবই আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করলাম, এ লোক তো কাউকে ফলো করেননি! কোন রীতি অনুসরণ করেননি। একেবারেই নিজের মতো করে বানিয়েছেন। তার ছবি আমাকে শিক্ষা দিলো, আমাকে আমার নিজস্ব ঢংয়েই বানাতে হবে। কারও অনুকরণ কিংবা অনুসরণ করে নয়।
বাংলানিউজ : তার সঙ্গে দেখা হয়েছিলো?
বেনেগাল : তারও ১০ বছর পরে তার সঙ্গে দেখা করেছিলাম। তার সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি। তিনি আমার কিছু তথ্যচিত্র দেখেছিলেন। ‘অংকুর’ বানানোর পর আমি বলেছিলাম, আমার ছবির প্রথম দর্শক হবেন সত্যজিৎ রায়। তাকে ছবিটি দেখিয়েছিলাম। ছবি দেখে তিনি বলেছিলাম, এটা নিয়ে তোমার প্রত্যাশা কি? আমি বলেছিলাম, ছবিটি যেন ইরস সিনেমা এবং বম্বেতে এক সপ্তাহ চলে। তিনি বলেছিলেন, ‘এক না, অনেক সপ্তাহ ধরে তোমার ছবি চলবে। ’
বাংলানিউজ : বাংলা চলচ্চিত্র বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কি?
বেনেগাল : বাংলা সিনেমা থেকেই কিন্তু উপমহাদেশের চলচ্চিত্র নতুন ভাষা পেয়েছে। ‘পথের পাঁচালী’র মধ্য দিয়ে এ স্বতন্ত্র ধারার সূত্রপাত। সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন- তারা ভারতীয় চলচ্চিত্রের গতিপথ একেবারেই বদলে দিয়েছেন। তাদের ছবি তখনকার জনপ্রিয় ধারার বাইরে। তবে মূলধারার সিনেমাকে অবজ্ঞা করেনি। প্রচলিত ধারাকে আমূল বদলে দিয়ে নতুন ধারার সৃষ্টি করেছে। এটা সম্ভব হয়েছে বাংলা সিনেমা দিয়েই।
বাংলাদেশ সময় : ২১২১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১০, ২০১৪