২০১৪ সালে সাংস্কৃতিক জগতের বেশ কয়েকজন গুণী ব্যক্তিত্বকে হারিয়েছি আমরা। চিরবিদায় নিলেও তারা বেঁচে থাকবেন তাদের কর্মে।
ফিরোজা বেগম
এ বছর সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সবচেয়ে বড় ধাক্কা হয়ে এসেছে কিংবদন্তি নজরুলসংগীতশিল্পী ফিরোজা বেগমের চলে যাওয়া। ৯ সেপ্টেম্বর রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। গুণী এই ফরিদপুরের এক সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারে ১৯৩৪ সালের ২৮ জুলাই জন্মেছিলেন। মাত্র ১২ বছর বয়সে ইসলামি গান নিয়ে তার প্রথম রেকর্ড প্রকাশ করেছিল বিখ্যাত গ্রামোফোন কোম্পানি এইচএমভি। কবি কাজী নজরুল ইসলামের দুর্লভ সান্নিধ্য পেয়েছিলেন ফিরোজা বেগম। চেষ্টা, নিষ্ঠা আর সততার গুণে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নজরুলসংগীতের সম্রাজ্ঞীর আসনে। নজরুলসংগীতে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ দেশে-বিদেশে তিনি পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র পুরস্কার, সত্যজিৎ রায় পুরস্কার, নাসিরউদ্দীন স্বর্ণপদক, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী স্বর্ণপদক, নজরুল একাডেমি পদক, চুরুলিয়া স্বর্ণপদক, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডিলিট প্রভৃতি। এ ছাড়া জাপানের অডিও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সিবিএস থেকে তিনি পেয়েছেন গোল্ড ডিস্ক।
খলিলউল্ল্যাহ খান
বছরের শেষে এসে চলচ্চিত্রাঙ্গন শোকে মুহ্যমান হয়ে ওঠে। ৭ ডিসেম্বর আমরা হারিয়েছি প্রখ্যাত অভিনেতা খলিলউল্ল্যাহ খানকে। ৮১ বছর বয়সে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে মারা যান তিনি। ‘সোনার কাজল’, ‘সঙ্গম’, ‘জংলি ফুল’, ‘আলোর মিছিল’, ‘বিনি সুতার মালা’, ‘সোনার চেয়ে দামি’, ‘মেঘের পরে মেঘ’, ‘মধুমতি’ এবং ‘প্রীত না জানে রীত’সহ অসংখ্য কালজয়ী ছবিতে দেখা গেছে তাকে। বিটিভিতে ‘সংশপ্তক’ ধারাবাহিক নাটকে অভিনয়ের জন্য বিপুল খ্যাতি অর্জন করেন খলিল। দেশীয় চলচ্চিত্র শিল্পে অভিনয়ে স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১২ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি।
বশির আহমেদ
‘যারে যাবি যদি যা’, ‘আমাকে পোড়াতে যদি এত লাগে ভালো’, ‘সজনী গো ভালোবেসে এত জ্বালা কেন বলো না’, ‘ডেকো না আমারে তুমি কাছে ডেকো না’, ‘অনেক সাধের ময়না আমার’, ‘খুঁজে খুঁজে জনম গেল’, ‘অথৈ জলে ডুবে যদি মানিক পাওয়া যায়’- এমন অসংখ্য কালজয়ী গানের শিল্পী বশির আহমেদকে আমরা হারিয়েছি গত ১৯ এপ্রিল। রাজধানীর মোহাম্মদপুরে নিজের বাড়িতে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। বশির আহমেদ দীর্ঘদিন ধরে ক্যান্সারে ভুগছিলেন। ১৯৪০ সালে কলকাতায় জন্মেছিলেন বশির আহমেদ। তিনি ছিলেন দিল্লির সওদাগর পরিবারের সন্তান। ২০০৩ সালে ‘কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি’ ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ গায়ক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান তিনি। সংগীত গুরু হিসেবেও গুণী এই শিল্পী বেঁচে থাকবেন যুগ যুগ।
পণ্ডিত রামকানাই দাশ
সংগীতজ্ঞ ও লোকসংগীত সংগ্রাহক পণ্ডিত রামকানাই দাশ ৫ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মেট্রোপলিটন হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। একুশে পদকপ্রাপ্ত এই গুণী শিল্পীর বয়স হয়েছিলো ৭৯ বছর। লোকসংগীত সংগ্রহে অবদানের জন্য ২০১৪ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন তিনি। পুরনো বাংলা গানকে নাগরিক শ্রোতাদের কাছে জনপ্রিয় করতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন এই গুণী শিল্পী। পণ্ডিত রামকানাই দাশ ২০১২ সালে বাংলা একাডেমি ফেলোশিপ অর্জন করেন। এ ছাড়া পেয়েছেন বাংলাদেশ জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ থেকে রবীন্দ্র পদক, ওস্তাদ মোজাম্মেল হোসেন স্মৃতি পদক, ঊর্বশী পদক এবং ‘পাগলা মাঝি’র জন্য শ্রেষ্ঠ গায়ক হিসেবে সপ্তম সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ড প্রভৃতি। তার লেখা দুটি গ্রন্থ হলো স্মৃতিকথা ‘সংগীত ও আমার জীবন’ এবং ‘সরল সংগীত শিক্ষা’। এই শিল্পীর জীবন ও সাধনা নিয়ে ‘সুরের পথিক’ (২০১১) শীর্ষক একটি তথ্যচিত্র তৈরি হয়েছে। ১৯৩৫ সালের ১৫ এপ্রিল সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার পুটকা গ্রামে জন্মেছিলেন লোকসংগীতের অনন্য সাধক রামকানাই দাশে। তার পৈতৃক বাড়ি সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার পেরুয়া গ্রামে। ২০০৪ সালে সত্তর বছর বয়সে প্রকাশিত হয় তার প্রথম অ্যালবাম ‘বন্ধের বাঁশি বাজে’। ২০০৫ সালে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন বাজারে আনে তার ‘অসময়ে ধরলাম পাড়ি’ অ্যালবামটি। লেজার ভিশন থেকে বের হয় ‘পাগলা মাঝি’ এবং সুরের মেলা থেকে বের হয় ‘রাগাঞ্জলি’ নামে শাস্ত্রীয় সংগীতের একটি অ্যালবাম। সংগীত পরিষদ নামে সিলেটে সংগীতশিক্ষার একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন রামকানাই দাশ। ১৯৯৫ সালে সিলেটে এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই তিনি আয়োজন করেছিলেন জাতীয় উচ্চাঙ্গসংগীত সম্মেলন।
মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী
বরেণ্য কণ্ঠশিল্পী মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী চিরবিদায় নিয়েছেন গত ৪ নভেম্বর। সত্তর ও আশির দশকের জনপ্রিয় এই গায়কের মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে আসে সংগীতাঙ্গনে। ১৯৪৪ সালের ২ ফেব্রুয়ারি নেত্রকোনা জেলায় জন্মেছিলেন তিনি। ১৯৬০ সাল থেকে তিনি রেডিও ও চলচ্চিত্রে গান গাইতে শুরু করেন। তিনি ২০৬টি চলচ্চিত্রে গান গেয়েছেন। তার গাওয়া গানের সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন হাজার। বাংলা গানের পাশাপাশি উর্দু গানও করেছেন তিনি। সংগীত জীবনে জাতীয় পুরস্কার ছাড়াও অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হন তিনি। এর মধ্যে আছে দীনেশ পদক, শিল্পকলা একাডেমি থেকে সংগীত ও নাট্যকলা পুরস্কার, বন্ধন আজীবন সম্মাননা প্রভৃতি।
বেলাল আহমেদ
এ বছরের ১৮ আগস্ট রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে মারা যান চলচ্চিত্র পরিচালক বেলাল আহমেদ। মৃত্যুর সময় তার বয়স হয়েছিলো ৬৬ বছর। ১৯৪৮ সালের ২৮ নভেম্বর জামালপুরে জন্মেছিলেন তিনি। ষাটের দশকে কাজী জহির পরিচালিত ‘বন্ধন’ ছবির শিশুশিল্পী হিসেবে চলচ্চিত্রাঙ্গনে আগমন তার। ১৯৬৭ সালে পরিচালক নজরুল ইসলামের সঙ্গে ‘স্বরলিপি’তে (১৯৭০) সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করেন বেলাল আহমেদ। এরপর আরও অনেকের সহকারী ছিলেন। ১৯৭৬ সালে প্রথম পরিচালক হন ‘নাগরদোলা’র (ফারুক, সুচরিতা) মাধ্যমে। তার পরিচালিত অন্যান্য ছবির মধ্যে রয়েছে ‘আমানত’, ‘গঙ্গা যমুনা’ (ওয়াসিম, রোজিনা), ‘নয়নের আলো’ (জাফর ইকবাল, সুবর্ণা মুস্তাফা, কাজরী), ‘ঘর আমার ঘর’, ‘সাক্ষী প্রমাণ’, ‘ক্রিমিনাল’ প্রভৃতি। নব্বই দশকে দীর্ঘ বিরতিতে যান বেলাল আহমেদ। ফিরে এসে হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয় উপন্যাস অবলম্বনে ‘নন্দিত নরকে’ আর মাহমুদুল হকের 'মাটির জাহাজ' উপন্যাস অবলম্বনে সরকারি অনুদানে ‘অনিশ্চিত যাত্রা’ ছবি দুটি পরিচালনা করেন তিনি। সর্বশেষ ইমপ্রেস টেলিফিল্মের প্রযোজনায় মৌসুমী ও নিলয়কে নিয়ে ‘ভালোবাসবোই তো’ নামের একটি চলচ্চিত্র পরিচালনা করছিলেন তিনি। কিন্তু মৃত্যুর কাছে হেরে তা অসম্পূর্ণই রেখে যেতে হলো তাকে।
চলে গেছেন তারাও
এ বছর বিনোদন ও সাংস্কৃতিক জগতকে শোকে ভাসিয়েছে আরও কয়েকজনের মৃত্যু। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী (৩০ নভেম্বর), কণ্ঠশিল্পী মীনা বশির (৭ আগস্ট), সঙ্গীতশিল্পী অজিত পাণ্ডে (১৩ জুন), চলচ্চিত্র অভিনেত্রী অন্তরা (৮ জানুয়ারি), চলচ্চিত্র পরিচালক এনায়েত করিম (৩ ডিসেম্বর), ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ছবির স্থির চিত্রগ্রাহক সুনীল আমিন (১৭ আগস্ট), সাংবাদিক-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব গোলাম ফারুক (৬ সেপ্টেম্বর)।
বাংলাদেশ সময় : ১৮২৮ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৪, ২০১৪