রাত ১২টার দিকে কন্টেইনারে ঢোকেন দ্বীন ইসলাম ও আল আমিন। চট্টগ্রাম বন্দরে কাজ করতেন দু’জন।
ঘটনাটা ২০১১ সালের ১ এপ্রিলের। রোজকার রুটিন- পাহাড়তলীর বিশ্ব কলোনি থেকে তারা বন্দরে ঢুকলেন সকাল ৮টার দিকে। কাজ টানা সন্ধ্যা পর্যন্ত। যে টাকা মিললো, তা দিয়ে সস্তা হোটেলে ভাত খেয়ে বন্দরে ঘুরতে ঘুরতে গভীর রাত নেমে এলো এলাকাজুড়ে।
রাত তখন ১২টা। দ্বীন ইসলাম ও আল আমিন দু’জনেরই অল্পস্বল্প নেশা করার অভ্যাস ছিলো। গাঁজা খেয়ে আশেপাশের একটা খালি কন্টেইনারে ঢুকলেন। ঘুমিয়ে পড়লেন একসময়। ওই ঘুমই কাল হলো দু’জনের জন্য।
কন্টেইনারটি উঠে গেলো হানসা কালেডো জাহাজে। সিঙ্গাপুরগামী জাহাজ। জাহাজ নদীতে ভাসলো। তখনও দ্বীন ইসলাম ও আল আমিনের ঘুম ভাঙেনি। মরার ঘুম ভাঙলো যখন, ততক্ষণে সব আশা শেষ। কন্টেইনারের মুখ বন্ধ। মালভর্তি শত শত কন্টেইনারের ভিড়ে এ দুই জীবিত অস্তিত্ব অসহায়। হাজার চিৎকার-আর্তনাদ মুখবন্ধ কন্টেইনারের ভেতরেই বিলীন হয়ে গেলো।
জাহাজ সিঙ্গাপুর পৌঁছালো পাঁচ দিনের মাথায়। এই ক’দিনে তাদের জীবনে ঘটে গেছে ভয়াবহ দূর্বিষহ ঘটনা। ক্ষুধায়-তৃঞ্চায়-ভয়ে কন্টেইনারের ভেতরেই তিন দিনের মাথায় মৃত্যু ঘটে আল আমিনের। আর দ্বীন ইসলাম পাশে নিথর লাশ নিয়ে বসে থাকেন নির্বাক। শেষমেষ দ্বীন ইসলামকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। তবে সিঙ্গাপুর পৌঁছানোর আরও পাঁচদিন পর।
২০১১ সালের এ ঘটনা আলোড়ন সৃষ্টি করে দুনিয়াজুড়ে। পত্রিকায়, টিভি সংবাদে দ্বীন ইসলামের অসহায় বর্ণনা আবেগাপ্লুত করে সুদূর জার্মানির সাইমন ডোলেন্সকিকেও। নির্মাতা তিনি। একসময় রেডিওতে সাংবাদিকতাও করেছেন। ডোলেন্সকি সিদ্ধান্ত নিলেন- এ কাহিনী নিযে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করবেন। শুরু হলো দ্বীন ইসলামকে খোঁজ করা। কিন্তু বাংলাদেশের কাউকে চেনেন না তিনি। আশা মিললো না দূতাবাস থেকেও। অবশেষে তিনি নিজেই এলেন বাংলাদেশে। খুঁজে বের করলেন দ্বীন ইসলামকে।
ততদিনে দ্বীন ইসলাম প্রায় উন্মাদ। একটা জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেন অন্যরকম। তবু তার সঙ্গে কথা বলে কিছু তথ্য পেলেন ডোলেন্সকি। ফিরে গেলেন নিজ দেশে। আবার এলেন যখন, চিত্রনাট্য প্রস্তুত। প্রস্তুত চলচ্চিত্রের নামও- ‘নির্ভানা’। অডিশনের মাধ্যমে নির্বাচন করলেন নাজমুল হুদা ঈমনকে। প্রধান সহকারী পরিচালক হিসেবে ‘নির্ভানা’য় থাকবেন তিনি। ঈমন ইংরেজিতে লেখা চিত্রনাট্যকে বাংলায় রূপান্তর করলেন। এবার অভিনেতা খোঁজার পালা- টানা ২০ দিন ধরে বিচ্ছিন্নভাবে অডিশন চললো। পছন্দ হয় না কাউকে। শেষমেষ তারেক মাসুদের ‘রানওয়ে’ দেখে ডোলেন্সকি নির্বাচন করলে ফজলুকে। ফজলুল হক, ‘রানওয়ে’তে রুহুল চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তিনি। যুক্ত হলেন আরও একজন- ইউনুস সানাই। দ্বীন ইসলাম চরিত্রে ফজলু, আর ইউনুস থাকবেন আল আমিন চরিত্রে। একটি চরিত্রে ঈমনও অভিনয় করেছেন।
২০১৩ সালের আগস্ট মাস। কোনো এক সুসময়ে ‘নির্ভানা’র ক্যামেরা চালু হলো। লোকেশন- শরীয়তপুর, চট্টগ্রাম ও এফডিসি। শুটিং শেষ হলো। জার্মানি থেকে আসা ডোলেন্সকিও ফিরে গেলেন নিজ দেশে। চমকটা এরপরই!
৪৮তম হফ ইন্টারন্যাশনাল ফ্লিম ফেস্টিভ্যাল (হফার ফিল্মটেজ), ফার্স্ট স্টেপ অ্যাওয়ার্ড, জার্মান শর্টফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, জার্মান নিউকাম অ্যাওয়ার্ড-সহ একাধিক উৎসবে আমন্ত্রণ পেলো ‘নির্ভানা’। প্রদর্শিত হলো, পেলো পুরস্কারের জন্য মনোনয়নও।
বাংলাদেশেই ঘটে যাওয়া একটি মর্মান্তিক কাহিনী, সেটা নিয়ে ছবি যিনি নির্মাণ করলেন তিনি থাকেন সুদূর জার্মানিতে, আবার এতে যারা অভিনয় করলেন- তারা বাংলাদেশেরই। ছবির ভাষাও বাংলায়। নিঃসন্দেহে এটি একটি উদাহরণ।
কিন্তু কতদিন ‘নির্ভানা’ বিদেশে বিদেশে ঘুরবে? দেশের মানুষের সৌভাগ্য হবে না এটি দেখার? ছবির সহকারী পরিচালক নাজমুল হুদা ঈমন জানালেন, সেদিনও ঘনিয়ে এসেছে। আগামী মার্চেই বাংলাদেশে ‘নির্ভানা’র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হবে।
বাংলাদেশ সময় : ১৫০০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২১, ২০১৫