শুরুটা হোক ওপার দিয়ে। অরিন্দম শীলের ‘আবর্ত’র পর সৃজিত মুখার্জির পরিচালনায় ‘রাজকাহিনী’র কাজ শেষ করেছেন।
এপার বাংলায় জয়ার ছবির চিন্তাভাবনা এবং বৈচিত্রের তারিফ করেছেন সবাই। তালিকাটা দেখুন- ‘ব্যাচেলর’ (২০০৪), ‘ডুবসাঁতার’ (২০১০) ‘গেরিলা’ (২০১১), ‘চোরাবালি’ (২০১২), ‘পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেমকাহিনী’ (২০১৩)। এই তালিকায় ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে এমন গল্প যেমন আছে, তেমনি আছে মুক্তিযুদ্ধের সাহসিকা নারীর উপস্থিতি, আবার নাচে-গানে ভরপুর বাণিজ্যিক ছবিও আছে।
ওপার বাংলায়ও জয়ার রুচির সুনাম ছড়িয়েছে। তাই দুই বছর আগে অরিন্দম শীলের প্রথম পরিচালনায় ‘আবর্ত’ দিয়ে ওপারের ছবিতে অভিষেক হয় তার। এক বছর পেরোতে না পেরোতেই কাজ করে ফেলেছেন সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ছবি ‘রাজকাহিনী’তে। এবার হাতে পেলেন ‘কণ্ঠ’ ও ‘একটি বাঙালি ভূতের গল্প’। সব মিলিয়ে ওপারে তিন বছরে চারটি ছবিতে কাজ করে ফেলছেন জয়া। আর সবটার সঙ্গেই টালিগঞ্জের সফল পরিচালকদের নাম যুক্ত।
জয়া বাংলানিউজকে জানালেন, ‘কণ্ঠ’র গল্প নিয়ে নন্দিতা ও শিবপ্রসাদ কাজ করছেন সেই ২০০২ সাল থেকে। এক যুগ সময় পেরিয়ে গেলো কেনো? কারণ গল্পের একটা যুক্তি পাচ্ছিলেন না তারা। রুবিক কিউবের মতো বাকি দিকগুলো মিলে গেলেও একটা দিক কিছুতেই মেলাতে পারছিলেন না দু’জনে। সেজন্যই এতোদিন দেরি৷ যুক্তিটা শেষ পর্যন্ত তারা পেয়েছেন ‘অলীক সুখ’ ছবির ওপর কাজ করতে করতে।
চিত্রনাট্য লেখার সময় পর্যন্ত এ ছবির নাম ছিলো ‘সাউন্ড অফ সাইলেন্স’। এটা পুরোপুরি মৌলিক গল্প৷ এতে তুলে ধরা হবে একজন রেডিও জকির জীবন। সেটা কী নিয়ে? কেবল বলছেন, ‘সেটা না হয় রহস্যই থাক! এটুকুই বলতে পারি, এটা কিছু মানুষের জীবনযুদ্ধে জয়ী হওয়ার গল্প৷ যার ক্যাচলাইন হতে পারে, কবির সুমনের লেখা সেই লাইনটা- ‘হাল ছেড়ো না বন্ধু’।
‘কণ্ঠ’র জন্য এপারের জয়াকে বেছে নেওয়ার অন্যতম কারণ তার হেঁয়ালি কণ্ঠ। অডিশন দিতে গিয়ে জয় গোস্বামীর ‘মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়’ কবিতাটা পড়েছিলেন তিনি৷ সেটাই শিবপ্রসাদের বড় ভালো লেগেছিলো। তার চেয়েও বড় কথা, এতো সুন্দরী হওয়া সত্ত্বেও নাকি জয়ার মধ্যে একটা ভীষণ নরম ব্যাপার পেয়েছেন শিবপ্রসাদ-নন্দিতা। চরিত্রটার জন্য তারা এমন একজনের খোঁজে ছিলেন। জয়া বললেন, ‘শিবুদাদের কাজ দেখতে আমার ভীষণ ভালো লাগে৷ তাই তাদের ছবিতে কাজের সুযোগ পেয়ে নিজেকে সত্যিই ভাগ্যবান মনে হচ্ছে। তারা কাজ করেন কম। সত্যি বলতে একটা ছবির পেছনে যে পরিমাণ গবেষণা আর আনুষঙ্গিক হোমওয়ার্ক দরকার, তাতে কখনও বছরে একটার বেশি ছবির প্রতি সুবিচার করা সম্ভব নয়। ’
‘কণ্ঠ’র আগের কয়েকটা দিন ‘জিরো ডিগ্রি’র প্রচার করতে ঢাকায় ফিরেছেন জয়া। এর অংশ হিসেবেই তিনি সময় দিলেন বাংলানিউজের তারার ফুলকে। অনিমেষ আইচ পরিচালিত ছবিটি মুক্তি পাবে আগামী ৬ ফেব্রুয়ারি। এতে সোনিয়ার ভূমিকায় দেখা যাবে তাকে। তিনি বললেন, ‘এটা একটু ডার্ক ছবি। চরিত্রটি কৌতূহল জাগানিয়া। এটা অবশ্যই বেশ গুরুত্বপূর্ণ। গল্পটাই খুব চিত্তাকর্ষক, পুরো ছবিটাই আগ্রহ জন্মানোর মতো। সবাই যার যার জায়গা থেকে ভালো কাজ করেছেন। বাকিটা দর্শক দেখলেই বুঝতে পারবেন। ’
দর্শকদের সোনিয়া চরিত্রটি সম্পর্কে ধারণা দেওয়া যাক। গ্রামের প্রভাবশালী ব্যক্তি পাটোয়ারী সুন্দরী মেয়েদের বিয়ে করে দিনকয়েক পরে ছেড়ে দিতেন অথবা মেরে ফেলতেন। এ কারণে স্ত্রী তাদের মেয়ে সোনিয়াকে কিছু টাকা দিয়ে ঢাকা পাঠিয়ে দেন। এক পর্যায়ে সে আত্মহত্যা করতে গেলে কবি ওয়াহেদ তাকে আটকায়। তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পরে জানা যায় ওয়াহেদ আসলে এক নারী-ব্যবসায়ী। সে টাকার বিনিময়ে সোনিয়াকে বিক্রি করে দেয়। এরপর ধর্ষণের শিকার হয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে মেয়েটি। বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়ে একই হাসপাতাল ঠিকানা হয় অমিতেরও।
সোনিয়া চরিত্রটি আপাতদৃষ্টিতে একটু জটিল মনে হচ্ছে। অভিনয়ের আগে জয়ার কি আলাদারকম প্রস্তুতি ছিলো? ‘নাটক হোক বা চলচ্চিত্র, একটা প্রস্তুতি তো থাকেই। ‘জিরো ডিগ্রি’র বেলায় পান্ডুলিপিটাই সহায়ক হয়েছে। এটা বেশ বৈচিত্রময়। তবে বিশদভাবে চিত্রনাট্যটা লেখা ছিলো না। হয়তো অনিমেষ নিজেই নির্মাতা হওয়ায় চিত্রনাট্যটা তার মাথায় সাজিয়ে রেখেছিলেন। বাকিটা অনিমেষ গাইড করলো। আমি নিজে যতটুকু বুঝি প্রস্তুতি নিলাম। একজন অভিনয়শিল্পীকে যেরকম প্রস্তুতি নিতে হয় তেমনই, আলাদা করে কিছু করতে হয়নি আমাকে। আর অনেকদিন একসঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে অনিমেষ কেমন চায়, কী চায় তা আমি ভালো বুঝতে পারি। ’
সোনিয়া চরিত্রে কাজ করতে গিয়ে ভয়ঙ্কর এক উপহার পেয়েছেন জয়া! উপহারটা ভয়ঙ্করই! নাম ‘ব্যাক পেইন’, অর্থাৎ কোমরে ব্যথা! কৌতূহল দেখে জয়া ঘটনাটা জানালেন। সেদিন ‘জিরো ডিগ্রি’র দৃশ্যধারণ চলছিলো রাজধানীর বিমানবন্দরে কাছাকাছি কাউলার পেছনে একটি ট্রেনে। ১০ সেকেন্ড আগে ট্রেন থেকে ঝাঁপ দিতে বলা হয়েছিলো তাকে। দৃশ্যটা নিখুঁত করার জন্য অনেক ঝুঁকি নিয়ে তিন সেকেন্ড আগেই ঝাঁপ দিয়ে বসেন তিনি। তাতেই ঘটে বিপত্তি। কোমরে মারাত্মক চোট পান জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত এই অভিনেত্রী। তবে শুরুতে পাত্তা দেননি সেটা। তবে ইউনিটের সবাই ব্যথা পাওয়ার পর ঘাবড়ে গিয়ে ক্যামেরা বন্ধ করে দিয়েছিলো। জয়া বললেন, ‘দৃশ্যটা ছবিতে আছে। ব্যথা পাওয়ার পরেও কাজ করেছিলাম। আসলে আমি গায়ের জোরে কাজ করি তো! তবে সেই ব্যথা এখনও আমাকে ভোগাচ্ছে। এ কারণে দেড় মিনিটের বেশি একটা জায়গায় দাঁড়াতে পারি না। অনেক চিকিৎসা করিয়েও লাভ হয়নি। রোগটা আমার সঙ্গী হয়ে গেলো। ‘জিরো ডিগ্রি’ আমাকে এটা উপহার দিয়েছে বলতে পারেন!’
ব্যথার কারণে পরে চিত্রায়িত মোটরসাইকেল তাড়া করার দৃশ্যে কাজ করতে গিয়ে ভয় পেয়েছিলেন জয়া। শত হলেও শরীর তো! তাকে সবসময় সহযোগিতা করেছেন মাহফুজ আহমেদ। ‘জিরো ডিগ্রি’তে অমিত চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। তার সঙ্গে ছোট পর্দায় বেশ কিছু একক ও ধারাবাহিক নাটকে কাজ করেছেন জয়া। ‘জিরো ডিগ্রি’র প্রযোজকও মাহফুজ। তাকে এই দায়িত্বে কেমন দেখলেন? জয়ার উত্তর, ‘প্রযোজক হিসেবে তিনি নিঃসন্দেহে খুবই ভালো, খুবই আন্তরিক। সত্যি বললে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের প্রয়োজনীয়তা ভালো বুঝতে পারেন প্রযোজক অভিনয়শিল্পীরা। সাধারণ প্রযোজকদের অনেকে সীমাবদ্ধতার কথা বুঝতে চান না বা বারবার হিসাব চান। কোথায় টাকা বেশি লেগে যায়, কখন টাকা প্রয়োজন হয় কিংবা পরিচালকের চাহিদা বা পরিচালক কী চাচ্ছেন এসব বিষয় এই শিল্পের মানুষ না হলে বোঝাটা কঠিন। মাহফুজ ভাই ছবিটি পুরোপুরি অনিমেষের ওপর ছেড়ে দিয়েছিলেন। তিনি নিজেও শিল্পী বলেই এটা করতে পেরেছেন। বিপণনের দিক দিয়েও তিনি ভালো কাজ করেন, এ ছবির বেলায়ও প্রচুর কাজ করছেন। আমাদের যখন যেটা দরকার পড়েছে তিনি দিয়েছেন। প্রযোজক হিসেবে মাহফুজ ভাই কোথাও আপস করেননি। এরকম মানসিকতার প্রযোজক আরও প্রয়োজন আমাদের। ’
অনিমেষ আইচের পরিচালনায় নাটকে কাজ করেছেন জয়া। এবার চলচ্চিত্রে করলেন। অনিমেষকে নিয়ে তিনি বললেন, ‘নাটকেও যেমন অভিনয় আর নির্মাণে মনোযোগী ও, তেমনি চলচ্চিত্রেও একইরকম দেখেছি। বড় পর্দার বেলায় কারিগরি দিকগুলোতে হয়তো পরিবর্তন থাকে। টানা কাজ করে সে একটা ছবি সুন্দরভাবে নামিয়ে আনতে পেরেছে, এটাকেও সার্থকতাই বলবো। এটা অনেক সময় দেখা যায় না। টিভি নির্মাতারা বড় পর্দায় কাজ করতে এসে মাঝে মধ্যে খেই হারিয়ে ফেলে। ’
ছবিটা কেমন হলো? তার প্রত্যাশাই বা কী? জয়া বললেন, ‘প্রত্যাশা ভালো। এই সময়ে দর্শক আসবেন কি-না জানি না। তবে আমার ভালো লেগেছে। দর্শক যখন প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে ছবি দেখে বলবে ভালো, তখনই আসলে আমাদের কষ্ট সার্থক হবে। ছবি আসলে ভালো না খারাপ দর্শকদের মতামতেই বোঝা যায়। আমার কাজ করে ভালো লেগেছে, টিমওয়ার্কটা ভালো ছিলো। আমার কাজ করার অভিজ্ঞতা খুবই ভালো। এই রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে মাহফুজ ভাই ছবিটা মুক্তি দিচ্ছেন। তাই আমি দর্শকদের বলবো, প্রেক্ষাগৃহে এসে ‘জিরো ডিগ্রি’ দেখুন। ছবিটা লোকে দেখবে হয়তো। ’
জয়ার সর্বশেষ মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেম কাহিনী’ ছিলো পুরোপুরি বাণিজ্যিক ধাঁচের। এখন তার হাতে আছে ‘পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেম কাহিনী টু’। ‘জিরো ডিগ্রি’ সেই পথ থেকে একটু আলাদা। তবে এসব বৈপরীত্য মানতে রাজি নন তিনি। তার ভাষ্য, ‘দর্শকই ছবির মূল বিচারক ঠিক আছে, তবে একজন অভিনয়শিল্পী হিসেবে আমি নানারকম ছবিতে কাজ করতে চাই। আর এসব কাজ বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপন করা গেলে মূলধারার ছবিও দর্শকের ভালো লাগতে পারে। ‘জিরো ডিগ্রি’তে আমাকে নায়িকাসুলভ ভাবমূর্তিতে পাওয়া যাবে না। এখানে একটি চরিত্র উপস্থাপন করেছি। এ ধরনের কাজই আমি করতে চাই। সত্যি বলতে আমি মনে করি, সব ধরনের বৈচিত্র্যই তো থাকা চাই। পরের ছবিতে হয়তো আমাকে অন্যরকম মনে হবে দর্শকের। ’
* ‘জিরো ডিগ্রি’ ছবির ‘বিমূর্ত এই রাত্রি আমার’ গানের ভিডিও দেখুন
* ‘জিরো ডিগ্রি’ ছবিতে জেমসের গাওয়া গানের ভিডিও দেখুন
বাংলাদেশ সময় : ১২২৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৪, ২০১৫
বিনোদন ও সংস্কৃতি বিষয়ক যাবতীয় যোগাযোগ এই ই-মেইলে : [email protected]