ঢাকা, শনিবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

তারার ফুল

শঙ্খচিলের খোঁজে ঢাকা টু সাতক্ষীরা

খায়রুল বাসার নির্ঝর, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৪৫ ঘণ্টা, জুলাই ৫, ২০১৫
শঙ্খচিলের খোঁজে ঢাকা টু সাতক্ষীরা ছবি: নূর/বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

‘যতোটা পারা যায় গোপনে’ শুরু থেকেই এ নীতি ছিলো গৌতম ঘোষের। কিছুতেই চাচ্ছিলেন না দৃশ্যায়ন শেষ হওয়ার আগে, আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনের আগে, ‘শঙ্খচিল’কে নিয়ে লেখালেখি হোক।

কেনো? তার যথেষ্ট যৌক্তিক কারণ আছে গৌতম ঘোষের কাছে।

কলকাতার মিডিয়াও তার মুখ থেকে ছবিটি নিয়ে বিস্তারিত কিছু জানতে পারেনি। আর ঢাকায় তো গৌতম পা-ই রাখেননি। এমনকি যে সাতক্ষীরায় ‘শঙ্খচিল’-এর বেশিরভাগ অংশের কাজ হলো, সেখানকার স্থানীয় পত্রিকাগুলোও সাক্ষাৎকার পায়নি কারও। না গৌতমের, না প্রসেনজিতের, কুসুম সিকদার, মামুনুর রশীদ, শাহেদ আলী- কারও না।

‘শঙ্খচিল’ টিম এবার দ্বিতীয়বারের জন্য সাতক্ষীরা ঢুকলো, এর আগেও একবার ছবিটির কাজ হয়েছে সেখানে। ওইবার গৌতম-প্রসেনজিৎকে সংবর্ধনা দিয়েছিলো সাতক্ষীরা জেলা পুলিশ। গৌতম ঘোষকে ডাকা হয়েছিলো স্থানীয় প্রেসক্লাবে। তিনি গিয়েছিলেনও। কিন্তু শর্ত ছিলো একটাই- ‘শঙ্খচিল’ নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না।
inner_songghochil_02
ঢাকায় বসে সব খবরই কানে আসছিলো আমাদের। এতো ‘না’-এর মিছিলে কীভাবে একটুখানি ‘হ্যাঁ’ বসিয়ে দেয়া যায়, ভাবনা ছিলো সেটাই। খবর এলো, দ্বিতীয় কিস্তির শুটিংয়ের জন্য বাংলাদেশে আসছেন গৌতম, প্রসেনজিৎ। যোগাযোগ করা হলো ‘শঙ্খচিল’-এর প্রযোজক হাবিবুর রহমান খানের সঙ্গে। এতোক্ষণ ধরে যেগুলো পড়লেন আপনারা, ওগুলোই শোনালেন তিনি। আরও বেশ কিছুক্ষণ কথা চালানোর পর নিমরাজি হলেন। বললেন, ‘৩০ জুন সাতক্ষীরায় মন্টু মিয়ার বাগানে এসে আমার সঙ্গে দেখা করো। ’ এডিটর ইন চিফ আলমগীর হোসেন স্যারকে জানানোর পর তিনি অনুমোদন দিলেন। তখন ২৯ জুনের দুপুর। সিদ্ধান্ত হলো, রাতের বাসেই সাতক্ষীরার পথে যাত্রা শুরু হবে।

হোটেলের নাম আল কাশেম। নামের শেষে ব্র্যাকেটে ইন্টারন্যাশনাল (!) বলেও একটা শব্দ আছে। আগের দিন বাংলানিউজের সাতক্ষীরা প্রতিনিধি শেখ তানজির আহমেদকে আমাদের আগমনের কথা জানাতেই একটা রুম বুকিং দিয়ে রেখেছিলেন। ভোরে যখন আমরা বাস থেকে নামলাম, জেলা শহর জাগেনি তখনও।

আগের রাতটা ভালো কাটেনি। তাড়াহুড়ায় বাসে দু’টো সিট মিলেছিলো ঠিকই, কিন্তু একেবারেই সুবিধার না। আঁটোসাঁটো সিট, দু’জন চাপাচাপি করে বসা চলে কোনোমতে। তার ওপর গুমোট গরম, দুর্গন্ধ। রাতভর ঘুম হয়নি একেবারেই। হোটেলে ঘণ্টা তিনেক বিশ্রাম নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। গন্তব্য মোজাফফর গার্ডেন। মন্টু মিয়ার বাগানবাড়ি নামেই পরিচিত এ পার্কটি, সঙ্গে গেস্ট হাউসও আছে। ‘শঙ্খচিল’ টিম ওখানেই থাকছে।
songgho_chil_4
সাতক্ষীরা শহর থেকে মোজাফফর গার্ডেন মাত্র তিন কিলোমিটারের রাস্তা। এবড়োখেবড়ো পথ, যেখানে সেখানে খোয়া উঠে নর্দমার আকার প্রায়; পথ যেন শেষ হয় না আর! দেখা হলো হাবিবুর রহমান খানের সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘দ্রুত ভাতশালা চলে যাও। বিজিবি ক্যাম্পের কাছে। বিকেল ৩টা থেকে ওখানে আমাদের কাজ শুরু হবে। ’ বেলা তখন বারোটা পেরিয়েছে। এর আগে বেশ কয়েকদিন ধরে টানা বৃষ্টি ছিলো। ওইদিন কড়া রোদ। সাতক্ষীরা শহর থেকে ভাতশালা প্রায় ৩০ কিলোমিটারের পথ। যেতে হবে মোটরবাইকে । ওই এলাকার অনেক তরুণই উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে এটিকে বেছে নিয়েছে। যেখানে দূরত্ব অনেক, যোগাযোগের মাধ্যম ভালো নয়, দ্রুত পৌঁছানোরও তাড়া থাকে; সেসব ক্ষেত্রে এ ভাড়ায় চালিত মোটরবাইকগুলো খুব কাজে লাগে।

আমাদের তিন সদস্যের টিম। সঙ্গে আছেন বাংলানিউজের সিনিয়র আলোকচিত্রী নূর-এ-আলম ও সাতক্ষীরা প্রতিনিধি তানজির। দু’জন বাইকওয়ালাকে পাওয়া গেলো, যারা ভাতশালা অব্দি আমাদেরকে নিয়ে যেতে রাজি। জেলা শহর থেকে ভাতশালা- আসা-যাওয়ার ভাড়া এক হাজার টাকা।

হালকা হাওয়া গায়ে মেখে, সঙ্গে ধুলোবালি, মাথার ওপর কড়া রোদ; আমরা চলেছি। একটা কুঁড়ে ঘর, টং দোকান, একদল ছেলেমেয়ে, একটু এগোলেই ছোট বাজার, রাস্তা ঢালু হয়ে নেমে গেছে বামে; আমরা চলেছি। পাকা রাস্তা শেষ, ইটের সলিং শুরু, একসময় তা-ও শেষ হয়ে যায়। গন্তব্য আসে না। এরপর বহুদূর পর্যন্ত কাঁচা রাস্তা। প্রায়ই কাদাপানি। রাস্তার দু’পাশ বেয়ে চিংড়ির ঘের নেমে চলে গেছে দৃষ্টির সীমানা ছাড়িয়ে।

একসময় তো আমরা পৌঁছাবোই দেবহাটার ভাতশালা, ইছামতির তীরে। তার আগে বলে নেওয়া যাক, ‘শঙ্খচিল’-এর পিছু কেনো এতো দূর অব্দি দৌড়ে মরছি আমরা! পরিচালক গৌতম ঘোষ- সেটা অবশ্যই একটা কারণ। কিন্তু মুখ্য কারন হচ্ছে- আমরা, আমাদের দেশ, আমাদের সীমান্ত, অনিশ্চিত জীবন, সংগ্রাম, দারিদ্র্য, বঞ্চনা; সবকিছুকে ছাপিকে ’৪৭ এর দেশভাগ। হ্যাঁ, গৌতম ঘোষের ‘শঙ্খচিল’ এগুলো নিয়েই। ফরিদপুরে তার জন্ম, পূর্বপুরুষের ভিটে। অথচ দেশভাগের ‘কোপে’ পড়ে তিনি আজ অন্য দেশের। ফরিদপুরের ভিটেমাটি দখল হয়ে গেছে কবেই! সেখানে যেতেও পারেন না তিনি। কেউ নেই সেখানে। এটা হয়তো পোড়ায় গৌতম ঘোষকে। না হলে এপারের বাদল মাস্টারের দুঃখ তার তো এতো গভীরভাবে বোঝার কথা নয়! ‘শঙ্খচিল’-এর সূত্র ধরে ’৪৭ এর দেশভাগ আসার কথা নয়। সে সবই আমরা খুঁজতে গেছি। জানতে চেয়েছি, জানাতে চেয়েছি।
songgho_chil_8
ভাতশালা পৌঁছাতে দুপুর ২টা বাজলো। পথে ঘনঘন ফোন কওে খোঁজখবর নিচ্ছিলেন বাংলানিউজের হেড অব বিনোদন জনি হক। ইছামতির পাড়ে তখন শুটিংয়ের তোড়জোড়। ক্রেন বসানো হচ্ছে। প্রোডাকশন বয়গুলো ছুটছে, হাঁফাচ্ছে। আরও আধঘণ্টা পর গৌতম ঘোষ এলেন। কথা হলো তার সঙ্গে। বললেন, ‘খুব খুশি হয়েছি তোমরা এসেছো। ’ প্রণামের ভঙ্গিতে দু’হাত এক করে স্বভাবজাত হাসি ছুঁড়ে দিলেন প্রসেনজিৎ।

ওইখানেই হেঁটে, দাঁড়িয়ে থেকে ছয় ঘণ্টা পার। ততক্ষণে শরীরের সবটুকু শক্তি প্রায় শেষের পথে। আমরা যখন ফেরার জন্য ফের মোটরবাইকে সওয়ার হলাম, তখন সন্ধ্যা। আশ্চর্য কোমল বাতাস ঘিরে নিচ্ছে আমাদের। ইছামতির ওপারে দেখা যাচ্ছে ঝলমলে শহর। ভারতের টাকি।

বাংলাদেশ সময় : ১১৫০ ঘণ্টা, জুলাই ৫, ২০১৫
কেবিএন/জেএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

তারার ফুল এর সর্বশেষ