গুলশান ক্লাব। দুপুরবেলা।
ওখানকার ড্রইংরুমটা বেশ অন্ধকার। ছবি তোলার আর তেমন জায়গাও নেই। হৈমন্তী শুক্লা তাই পায়ে হেঁটে, সিঁড়ি ভেঙে, দোতলায় নেমে আসলেন। লাগোয়া একটুখানি ব্যালকনির মতো আছে। ওখানেই ছবিটা তোলার কথা। তিনি এসেই, বাইরে স্যাঁতসেঁতে বৃষ্টি দেখে, স্বভাবজাত হাসিমুখে বললেন, ‘তোরা আমাকে ভেজাবি নাকি?’ হৈমন্তী সাবধানী পায়ে, পানি ডিঙিয়ে, ব্যালকনিতে নেমে গেলেন। এরপর অষ্টাদশী নায়িকার মতো পোজ দিলেন এপাশে-ওপাশে ঘুরে, দাঁড়িয়ে-বসে।
হৈমন্তীর হাতে উল্কি। বাঁ-হাতে জি-ক্লেফ সিম্বল আঁকা কালো রঙের উল্কিটি তার ফর্সা হাতে ফুটেছে দারুণ। বললেন, ‘এই ট্যাটু নিয়ে আমাদের পত্রিকাগুলো যে কতোকিছু করলো!’ বয়সের চোখরাঙানিকে নির্দ্বিধায় অবহেলা করে হৈমন্তী সবসময়ই উচ্ছ্বল। একটানা কথা বলেন। শব্দ করে হাসেন। পরিচিত-অপরিচিত সবার সঙ্গেই আড্ডা জমিয়ে দেন, সুযোগ পেলেই।
তখন ছবি তোলা শেষ। হৈমন্তী শুক্লা বাইরে বেরোবেন। তার আগে ড্রইংরুমের প্রশস্ত সোফাটায় আরাম করে বসলেন। দৃষ্টি ছড়িয়ে দিলেন সামনে। জিজ্ঞাসু চোখ, ‘কি জানতে চাস বল!’ আমরা জানতে চাই না। শুনতে চাই। এ আলাপচারিতায় কোনো প্রশ্ন থাকবে না। তার গান নিয়েও না, আগেরকার-এখনকার গানের পুরনো দ্বান্দ্বিক টানাপোড়েন নিয়েও না। এই যে হৈমন্তী ৪৫টি বছর ধরে গান করছেন, ঘুরছেন, গানের ফেরি নিয়ে বেড়াচ্ছেন বিদেশ-বিভুঁই। কতো ভক্ত, শ্রোতা, মানুষের রকমফের- এসব নিয়ে বলবেন তিনি। আর আমরা শুনবো।
হৈমন্তী শোনালেন। বাংলাদেশেরই নারায়ণগঞ্জ। বছর কয়েক আগের কথা। তিনি গাড়ি করে যাচ্ছেন। সামনে প্রচন্ড জ্যাম। একদল মানুষ ব্যান্ডপার্টির মতো ঢোল-বাঁশি বাজাতে বাজাতে চলছে। পেছনের গাড়িগুলোকে কচ্ছপের গতি নিয়ে যেতে হচ্ছে, বাধ্য হয়ে। হৈমন্তীর বিরক্ত হওয়ারই কথা। কিন্তু উল্টো তার কান তাক হয়ে আছে সুরে। তারই গান না? তাই তো। পাশের জনকে ডেকে বললেন, ‘অ্যাই দ্যাখ, ওরা আমার গান বাজাচ্ছে!’
সেকেন্ডেই নারায়ণগঞ্জ থেকে হৈমন্তীর স্মৃতি উড়ে গেলো সিডনিতে। গান করতেই গিয়েছিলেন ওখানে। নিজের রুমে বসে আছেন। হঠাৎ প্রচন্ড দরজা ধাক্কানোর শব্দ। বাইরে এক বৃদ্ধার চিৎকার। ছাপিয়ে গার্ডগুলোর ধমক আরও কানে বাজছে তীব্র হয়ে। বৃদ্ধ মহিলা অন্ধ। ভেতরে আসতে চান। গার্ডগুলো আসতে দেবে না কিছুতেই। হৈমন্তী বললেন, ‘ওনাকে আসতে দাও। ’ শুধু ‘উনি’ এলেন না, সঙ্গে ছেলে-বৌমা-নাতি-নাতনি। হৈমন্তীর সঙ্গে একটা ছবি তুলতে চান শুধু। তার পাশে দাঁড়িয়ে। মহিলা দেখতে পান না। তবু হৈমন্তীর সঙ্গে একটা ছবির আবেদন তার কাছে কতো বিশাল! যে ছবিটি তিনি কখনও চোখে দেখতে পারবেন না!
এরপর গড়িয়াহাটের মাছ বাজার। হৈমন্তী বললেন, ‘আমি তো রাস্তায় আসতে-যেতে মাঝে মধ্যেই মাছের বাজারে ঢুকে পড়ি। ’ সেরকমই একটি দিন। দোকানে গিয়ে, একটা রুই তুলে, জিজ্ঞাসা করেছেন, ‘এটার কতো দাম?’ দোকানদারের তড়িঘড়ি, ‘দিদি, আপনি গাড়িতে গিয়ে বসুন। যা আছে সব তুলে দিচ্ছি। ’ মাছ বিক্রেতা তুলে দিলো। হৈমন্তীর গাড়ি চলতে শুরু করেছে। তিনি পেছনে তাকিয়ে দেখেন, লোকটি আসছে ছুটতে ছুটতে। কী ব্যাপার? হৈমন্তীর পা ছুঁয়ে একবার প্রণাম করতে চায় লোকটি।
একটানা স্মৃতিগুলো সামনে মেলে একটু থামলেন হৈমন্তী। তারপর বললেন, ‘এসব ঘটনা কোনোদিন ভুলতে পারবো, বল? এই যে এতো মানুষের ভালোবাসা!’ ঘটনাগুলোকে আমরা মেলাতে চাই আরও অনেকের সঙ্গে। মেলে না। কেমন খাপছাড়া ঠেকে। অনেকেরই তো দেখা মেলে আশপাশে। কী রকম একটা বায়বীয় ‘সেলিব্রিটি’ ইমেজ নিয়ে ঘুরে বেড়ান। কথায় কথায় চটে যান। দর্শক-শ্রোতাকে হিসেব করেন ‘জনসংখ্যা’য়।
হৈমন্তী সেটারও ব্যাখ্যা দিলেন, ‘আমরা কাদের সঙ্গে মিশেছি, সেটা তো দেখতে হবে। মান্না দে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। একদিনের ঘটনা বলি শোন। ’ তখন সবে বেশ নামডাক হয়েছে হৈমন্তীর। চাহিদা বেড়েছে। বিভিন্ন জায়গা থেকে গান গাইতে যাওয়ার ডাক আসছে। শো পড়েছে এক প্রত্যন্ত এলাকায়। থাকার জায়গা, বসার জায়গা, খাবার, পানি- কিছুই ঠিক নেই। ভালো ব্যবস্থা নেই। আয়োজকদের সঙ্গে হৈমন্তী বেশ রাগ-টাগ দেখিয়ে বসলেন।
তাদের বসতে দেওয়া হয়েছে ভাঙা একটি স্কুল ঘরে। দরজা ঠেলে স্কুলঘরের রুমটায় ঢুকতে গিয়ে, তিনি দাঁড়িয়ে পড়লেন। হৈমন্তী বিস্মিত, হতবাক, ‘আমি দেখলাম মান্না দে ছাত্রদের বসার বেঞ্চিতে বসে আছেন। ভাঙা বেঞ্চি। এক কোণে বসে তিনি মাটির ভাঁড়ে করে চা খাচ্ছেন। তার মতো মহান একজন শিল্পী! কতো সাধারণ! এসব মানুষদের দেখেই তো আমরা বড় হয়েছি। শিখেছি অনেক কিছু। ’
শিখেছেন তার বাবার কাছ থেকেও। বাবা প্রখ্যাত শিল্পী হরিহর শুক্লা। হৈমন্তী বললেন, ‘বাবা আমার গানকে কখনও ভালো বলেননি। সারাক্ষণ শুধু এই খুঁত, ওই খুঁত! এখানে সুরটা ঠিকমতো লাগেনি। ওইখানটা আরেকটু ভালো হতে পারতো। কি গান গাইলি! এইখানে [বুকে হাত রেখে] খোঁচাই লাগলো না! বড় হয়ে খুব কষ্ট হতো। কতো মানুষ আমার গানের প্রশংসা করছে! বাবার মুখে কখনও এমন শুনিনি। ’ বাবাই ছিলেন তার শিক্ষক, গুরু। তিনি হৈমন্তীকে কথায় কথায় বলেছিলেন এক সময়, ‘মদ-টদ খেয়ে কেনো নেশা করতে হয় বুঝি না। গানে নেশা হয় না? তানপুরাটা নিয়ে একটু বসলে, এতে কী কম নেশা?’
হৈমন্তী শুক্লা কথা শেষ করলেন, ‘আমার নেশা হয় রে! গাইবার নেশা হয়। ’
বাংলাদেশ সময় : ১৩২০ ঘন্টা, জুলাই ২২, ২০১৫
কেবিএন/জেএইচ