কপালে-নাকের ডগায়-গলার কাছে ঘাম। হাঁপাচ্ছেন।
দুপুরবেলা। চারিদিকে চকচকে রোদ। গুমোট গরম। এ দুপুরে দিলরুবা মাল্টা জুসের গ্লাসে স্ট্র ডুবিয়ে, চোখ রাখতে চান নব্বইয়ে। দু’হাতের আঙ্গুলগুলো লুকিয়ে ফেলেন পরস্পরের ভাঁজে। যেন স্মৃতি এসে জমা হচ্ছে নখে, রূপালি নেলপলিশে। আমরা সাক্ষী হই। দিলরুবা বলেন, ‘পঁচিশ বছর আগে এক দেবদূত এসে আমাকে দিলরুবা থেকে পাগল মন বানিয়েছিলো। ঠিক পঁচিশ বছর পরে এলো আরেকজন। ’ ‘পঁচিশ’-এর দু’প্রান্তে দু’টো গল্প আছে। ভেতরে আছে আরও অসংখ্য গল্পের শাখা-প্রশাখা।
১৯৯০-এর শেষ দিকে। দুপুরবেলা। দিন-তারিখটা অতো মনে নেই দিলরুবার। দু’জন লোক এলেন। হাতে একটা কাগজ, কাঁপা কাঁপা অক্ষর। একটা গান লেখা- ‘কে বলে পাগল, সে যেনো কোথায়, রয়েছো কতই দূরে, মন কেন এতো কথা বলে’। ‘আপা, আপনি কি এই গানটা গাইবেন?’-আগন্তুকদ্বয়ের চোখমুখ জুড়ে বিনয়, অনুরোধের ঝাপটা। দিলরুবা দেখলেন এবং ভ্রু কুঁচকালেন। এ কোনো কথা হলো! কী সব পাগল মন, ঘোড়া দৌড়ায়! ‘না না, এ গান আমি গাইতে পারবো না। এ সব কি লিখেছেন?’ আগন্তুকদ্বয় সম্ভবত ভেবেই নিয়েছিলেন দিলরুবা এমনটা বলবেনই। তাই অনুরোধ তরল হলো আরও। দ্বিতীয়জন বললেন, ‘আপা, আমি ভালো সুর করেছি। সুরটা তুলে দিচ্ছি। আপনি গান। আপনি যদি রেডিওতে গানটা করেন, তাহলে আমি একটা টেপ-রেকর্ডার পাবো। ওটা আমার খুব দরকার। ’ তারপর আরও অনেক অনুরোধের অধ্যায় ডিঙিয়ে দিলরুবা গাইলেন।
রমনা পার্কের শান্ত দীঘিটা আলাপচারিতার এ পর্যায়ে এসে নড়েচড়ে উঠলো খানিকটা। রোদ সরে গেছে, বাইরে বৃষ্টি। নড়েচড়ে বসলেন দিলরুবাও, ‘ওরা কারা ছিলো জানো? আহমেদ কায়সার, ‘পাগল মন’ গানের গীতিকার। আর আশরাফ উদাস। তিনি সুরটা করেছিলেন। ’
এরপর কী হয়েছিলো, সেটা নব্বইয়ের দশক জানে। জানে শুন্য দশক, বর্তমানও। তবু আমরা দিলরুবার চোখের সামনে বসে, আগ্রহ মেলে ধরি; যদি তিনি আরও কিছু বলেন! ‘আমার নাম তো দিলরুবা থেকে পাগল মন হয়ে গেলো। আমার বাবা, পুলিশে চাকরি করতেন, গানও করতেন, তিনি কিন্তু আমাকে কখনও গাইতে দিতেন না। গাইলেই ঝাড়ু নিয়ে আসতেন মারতে! তিনি দেখি রেডিওতে আমার গানই গাইছেন। এখনও আমাকে জবাবদিহি করতে হয়, জানো?’
সেটা কেমন কথা! যে দিলরুবার কণ্ঠ শুনে অশ্রু ঝরে, ক্লান্তির ঘাম শুকিয়ে যায়, কোথাও তার ছবি দেখলেই পত্রিকাওয়ালা জড়ো করে নিয়ে আসে বাড়ি পর্যন্ত, দু’দিন পরপর মাছওয়ালা-মাংসওয়ালা ফোনে অভিমান করে- ‘ভুলে গেলেন! আর আমার কাছ থেকে মাল নেবেন না?’ সেই দিলরুবার সামনে জবাবদিহির হিসেব কষতে বসবে, এমন সাহস কার? ‘ভালোবাসা যে! মানুষ কাঁদে তো। ফেসবুকে, ফোন করে; রীতিমতো ধমকায়, কেন গাইলেন আপনি এ গানটা! অথচ এটা আমি গাইতেই চাইনি। কোন সুর, কোন কথা, কোন গান মানুষের কলজেতে গিয়ে যে বাঁধে; কে বলতে পারে!’ দিলরুবার মন ভারী হয়।
আমরা পঁচিশের পরের গল্পটা জানতে চাই। ‘পাগল মন’ গানটির পঁচিশ বছর পূর্ণ হলো ২০১৫ সালে। দিলরুবা এটা আবার নতুন করে গেয়েছেনও, নতুন করে মিউজিক ভিডিও-ও আসছে, ওই গল্পটা। এখানেও একটা ‘হঠাৎ’ ব্যাপার আছে। একদিন ফেসবুকে নক করলেন ডিজে রাহাত। গানটা নতুন করে বানাতে চান। দিলরুবার ওসব নিয়ে আপত্তি নেই, করতে চায় তো করবে! আরও কিছুদিন পরে রাহাত জানালেন, ভয়েস দিতে হবে। ‘আমি তো অবাক, বুঝেছো? ভেবেছিলাম, অন্য কেউ হয়তো গাইবে। ওটা যে আমাকেই গাইতে হবে, জানতামই না। ট্র্যাকটা পাঠালো, শুনলাম। কী বানিয়েছে ছেলেটা! ওই যে বললাম না, এ হলো আরেক দেবদূত!’
মিউজিক ভিডিওটার দৃশ্যধারণ এখনও হয়নি, ক’দিন পরে হবে। দিলরুবা জানিয়ে রাখলেন আরও একটা আগাম খবর, পুঁথিগান করবেন। কালের লিখন নামে একজন কবিকে খুঁজেও পেয়েছেন তিনি। তার কাছ থেকে কিছু পুঁথি নিয়েছেন। গুনগুন করে শুনিয়ে দিলেন একটু সুরও। যখন শোনাচ্ছেন, চোখমুখ উজ্জ্বল। হয়তো ভাসছে ছোটবেলা। বাড়ির উঠান। গোল হয়ে বসে জনাকয়েক। হারিকেনের টিমটিমে আলো। মাঝে একজন মাথা ঝুঁকিয়ে, দুলে দুলে, সুর করে পড়ছেন, ‘শোন শোন বন্ধুগণে শোন দিয়া মন...’।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৪০ ঘণ্টা, আগস্ট ০৪, ২০১৫
কেবিএন/জেএইচ