এক এক করে সিনেমা হল বন্ধ হচ্ছে। গুঁড়িয়ে যাচ্ছে।
যদিও এখন অবস্থা একটু পাল্টেছে। কিছু কিছু সিনেমা ব্যবসার মুখ দেখছে মোটামুটি। প্রচুর যৌথ প্রযোজনার সিনেমা আসছে। সাম্প্রতিক যৌথ প্রযোজনার প্রক্রিয়া নিয়ে বেশ বিতর্ক আছে যদিও। কিন্তু এ কথা তো ঠিক, দেশীয় সিনেমার বাজারকে একটা ভালো অবস্থানে নিয়ে যেতে হলে, ক্ষেত্র বাড়ানো যেমন জরুরি। দুই বাংলার অংশগ্রহণ, চলচ্চিত্র বিনিময়টাও খুব দরকার।
তারেক মাসুদ এ কথা অনেক আগেই বলেছেন। বেশ গুরুত্ব দিয়ে। অনেকবার। এসব নিয়ে প্রচুর লিখেছেন, যুক্তি দিয়েছেন। ‘দুই বাংলার চলচ্চিত্র আদান প্রদান’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে তিনি লিখছেন, ‘চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও গোষ্ঠীদের সঙ্কীর্ণ মনমানসিকতা ও স্বার্থ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বিশ্বায়নের সুযোগ কাজে লাগাতে না পারলে আমরা নিজেরাই বিশ্বায়িত হয়ে পড়বো। হলিউড আর বলিউডের প্রকোপ থেকে আঞ্চলিক, বিশেষত বাংলা সিনেমাকে বাঁচাতে দুই বাংলার চলচ্চিত্রজনদের ইগো ও সেন্টিমেন্টের উর্ধ্বে উঠতে হবে। ’
স্পষ্টতই, তারেক মাসুদের আগ্রহ চলচ্চিত্র বিনিময়ের দিকে। ১৯৪৭-এর দেশভাগের আগে, এমনকি পরপরই ওইভাবে আঞ্চলিক চলচ্চিত্রশিল্পের অস্তিত্ব ছিলো না। ভারতীয় হিন্দি এবং কলকাতার বাংলা ছবি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানি ব্যাপকহারে মুক্তি পেতো। ১৯৫৬ সালে আবদুল জব্বারের ‘মুখ ও মুখোশ’ ছবিটির মাধ্যমে একটি নিজস্ব চলচ্চিত্র কাঠামোর সূচনা হয় এখানে। তারেক মাসুদ লিখে গেছেন, ‘এর পরের বছরই পাকিস্তান সরকার ভারতীয় ছবির আমদানি নিষিদ্ধ করে। তারপরও এক বছরের মধ্যেই ভারত-পাকিস্তান যৌথ উদ্যোগের একটি নমুনা খুঁজে পাওয়া যায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র ওপর তৈরি করা পাকিস্তানি ছবি ‘জাগো হুয়া সাভেরা’য়। ’
১৯৫৭ সালের এই যে চলচ্চিত্র বিনিময়ের নিষেধাজ্ঞা, সেটি কিন্তু ফলপ্রসূ হলো না। ভালো কিছু বয়ে আনলো না। হলগুলো মুখ থুবড়ে পড়লো। সামরিক সরকার বাধ্য হলো ১৯টি ভারতীয় ছবি কিনে স্থানীয় পরিবেশকদের কাছে বিক্রি করে সিনেমা হলগুলোকে বাঁচিয়ে তোলার উদ্যোগ নিতে। ’৫৭ সালের ওই নিষেধাজ্ঞা, সেটি কিন্তু স্থানীয় চলচ্চিত্র শিল্পকে প্রতিষ্ঠিত করার স্বার্থে ছিলো না। ছিলো রাজনৈতিক স্বার্থ। যেটি দেখা গেছে ১৯৬৫ সালেও।
ওই বছরের ৬ সেপ্টেম্বর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়। তার পরদিন থেকেই ভারতীয় ছবির বাণিজ্যিক প্রদর্শন বন্ধ করা হয়। সে সিদ্ধান্তটিও বেশিদিন টিকে থাকেনি। ষাটের দশকের শেষের দিকে সত্যজিৎ রায়ের ‘মহানগর’ ও ‘স্ত্রীর পত্র’ একটি চলচ্চিত্র উৎসবের অংশ হিসেবে বাংলাদেশে মুক্তি পায়। এ সিনেমা দেখতে টিকিটের জন্য দর্শক বলাকা সিনেমা হলের গেট ভেঙে ফেলেছে- এমন ঘটনাও ঘটেছে।
তারেক মাসুদের কলম এ ক্ষেত্রে লিখেছে, ‘আমি তত্ত্ব-তালাশ করে দেখেছি, পাকিস্তান আমলেও এই নিষেধাজ্ঞার হুংকার ধারাবাহিকভাবে কার্যকর হওয়ার সুযোগ পায়নি প্রধানত এই কারণে যে, এটির আইনগত ভিত্তি ছিলো না। পাকিস্তান আমলে তৈরি জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিটি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কলকাতায় মুক্তি লাভ করে। ‘জীবন থেকে নেয়া’র পদাঙ্ক অনুসরণ করে স্বাধীনতার পর ’৭২ সালেই সূচিত হতে পারত দুই বাংলার চলচ্চিত্র আদান-প্রদানের ভারসাম্যমূলক শুভযাত্রা। এর মধ্য দিয়ে বৃহত্তর বাংলায় চলচ্চিত্রের অমিত সম্ভাবনা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হলো। বাংলাদেশের ‘শিশু চলচ্চিত্র’কে ভারতীয় জুজুর ভয়ে থেকে বাঁচাতে আমাদের চিত্রশিল্পের নাবালক একটি গোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুকে বোঝাতে সক্ষম হলো, আমাদের চিত্রশিল্পকে সুস্থ প্রতিযোগিতার আলো-বাতাসে বাড়তে না দিয়ে বনসাই করে রাখা উত্তম। ফলাফল হলো, পাকিস্তান আমলের শেষের দিকে যে শিল্পটি মহীরূহের রূপ নিয়েছিলো, সত্তরের শুরুতেই তা মুমূর্ষু হয়ে পড়ল। মুক্তিযুদ্ধকে উপজীব্য করে নয়, পুঁজি করে বন্দুক-কামানের গর্জন আর ধর্ষণসর্বস্ব ছবি দিয়ে কূল না পেয়ে যৌথ প্রযোজনার মাধ্যমে শ্যাম রাখার চেষ্টা হলো। ’
তবে যৌথ প্রযোজনাকে ‘রণকৗশল নয়, বাস্তবানুগ রোডম্যাপ হিসেবে দেখা দরকার’ এমনটাই বলে গেছেন তারেক মাসুদ। তিনি লিখেছেন, ‘ভারত-বাংলাদেশের আন্তঃদেশীয় চলচ্চিত্র পরিবেশনার প্রক্রিয়াকে সবল ও সফল করতে যৌথ প্রযোজনা কেবল রণকৌশল নয়, বাস্তবানুগ রোডম্যাপ হিসেবে দেখা দরকার। সারা পৃথিবীতে আঞ্চলিক যৌথ প্রযোজনা চলচ্চিত্রের বৃহত্তর বাজার ও দর্শক সৃষ্টির কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আশির দশকের গোড়ায় ‘কেয়ামত সে কেয়ামত তাক’-এর মাধ্যমে কপিরাইট সিনেমার যে বিকৃত হাস্যকর মেধাহীন সংস্কৃতি শুরু হয়েছে, তা কখনওই স্বাভাবিক আন্তঃদেশীয় চলচ্চিত্র বিনিময়ের বিকল্প হতে পারে না। ভিডিও পাইরেসি, ডিভিডি-ভিসিডির বিস্তার, আকাশ সংস্কৃতির আগ্রাসন, ক্যাবল টেলিভিশনের সর্বগ্রাসী ক্ষুধার প্রতিকূলে চলচ্চিত্র সংস্কৃতি ও শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে ভারসাম্যমূলক প্রতিযোগিতার খোলা আকাশের কাছে চলচ্চিত্রমাধ্যম ও শিল্পকে মুক্ত করে দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। ’
বাংলাদেশ সময়: ১৭৪০ ঘণ্টা, আগস্ট ১২, ২০১৫
কেবিএন/জেএইচ