ডাকনাম পুলক। নব্বইয়ের দশক থেকে দেশের প্রথম সারির অভিনেতাদের কাতারে আছেন তিনি।
সম্প্রতি চট্টগ্রামে ওপার বাংলার শিল্পী অনুপম রায়ের কনসার্টে অংশ নিতে গিয়েছিলেন জাহিদ হাসান। বন্দরনগরীর প্রতি তার আলাদা ভালো লাগা রয়েছে। সেজন্যই তার যাওয়া। তাকে পেয়ে চাঁটগাইয়ারা বলেছিলেন, ‘এতোদিনে জীবন্ত দেখা গেলো!’ উত্তরে রসিকতার সুরে তিনি বলেন, ‘টিভিতে কি মৃত মৃত দেখা যায়?’ কনসার্টের পরদিন ঢাকায় ফেরার আগে সকালে বেশ কিছুক্ষণ বাংলানিউজের সঙ্গে আড্ডা দিলেন জাহিদ।
বাংলানিউজ : ঢাকার বাইরে কি চট্টগ্রামেই প্রথম মঞ্চনাটক করতে এসেছিলেন?
জাহিদ হাসান : হ্যাঁ। সিরাজগঞ্জে আমার মঞ্চজীবন শুরু। ছোটবেলা থেকে নাটকের প্রতি ঝোঁক ছিলো আমার। তাই স্কুলে থাকতেই সিরাজগঞ্জ তরুণ সম্প্রদায় নাট্যদলে সম্পৃক্ত হই। এরপর ঢাকায় এসে যোগ দেই নাট্যকেন্দ্রে। ঢাকার বাইরে দলটির হয়ে প্রথম নাটক করতে এসেছিলাম চট্টগ্রামে। ১৯৯১ সালে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে মঞ্চস্থ হয় ‘বিচ্ছু’ নাটকটি। সেজন্য এখানকার প্রতি আমার আলাদা একটা টান আছে। তাছাড়া চাঁটগাইয়া ছেলে রানা সিনহাকে আমি স্নেহ করি। ওর অনুরোধ আর দর্শকদের প্রতি ভালোবাসার জন্যই চট্টগ্রামে এলাম।
বাংলানিউজ : ওপারের শিল্পীরা এপারে আসেন, এপারের শিল্পীরাও ওপারে যাচ্ছেন। কিন্তু আমাদের টিভি চ্যানেল কলকাতায় অবহেলিত। অনুপমের কনসার্টে এক প্রবীণ দর্শক এ নিয়ে প্রশ্নও করেছেন, তার মতো অনেকের দাবি- বাংলাদেশের চ্যানেল দেখার সুযোগ দেওয়া হোক...
জাহিদ : একজন শিল্পী হিসেবে এটা আমারও চাওয়া। এখানে ব্যবসায়িক, আইনি বা মন্ত্রণালয়ের কি জটিলতা আছে আমি জানি না। কিন্তু আমি দর্শকদের সঙ্গে একমত, বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল পশ্চিমবঙ্গে অবাধ করা হোক। কারণ ওদের অনেক চ্যানেল আমাদের দেশে আসে, তেলেগু ভাষারও আসে। অথচ এ ভাষা বুঝি না আমি। তাহলে আমাদের চ্যানেল যাবে না কেনো? তেলেগুতে না হোক, বাংলাদেশি টিভি চ্যানেল অন্তত কলকাতায় বাংলা ভাষাভাষী দর্শকদের কাছে যাক। আমি একা নই, এটা আমরা সবাই চাই।
বাংলানিউজ : এখন যে বাজেটে নাটক তৈরি হয় তা কি যথাযথ?
জাহিদ : না। আমরা যে বাজেটে, যে সময়ে, যে অবস্থানে কাজ করি; এখানে অনেক ভালো কিছু করা সম্ভব না। আমরা অনেক বড় বড় জিনিস চিন্তা করি, কল্পনা করি; কিন্তু বাজেট একটা ব্যাপার। আপনাকে ১০০ টাকা দিয়ে যদি বলা হয় প্রচুর তরকারি নিয়ে আসেন, সেটা কিন্তু পারবেন না। আবার কাউকে আধঘণ্টা সময় দিয়ে পাঁচটা তরকারি রান্না করতে বললেও সম্ভব হবে না। তারপরও টুকটাক যেটুকু করার আমরা চেষ্টার ত্রুটি রাখছি না। এ ক্ষেত্রে দর্শকদের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। কারণ তারা কিন্তু পোলাও চায় না। তারা অল্প টাকার রুটিই চায়। শুধু এটুকু চায়, রুটিটা যেন বেশি পোড়া না হয়! সেদ্ধ যেন হয়। এটা আমরা যারা চেষ্টা করি, তাদেরকে দর্শক এখনও গ্রহণ করে। এই হচ্ছে ঘটনা।
বাংলানিউজ : দর্শকরা এখন টিভি দেখে না বলে একটা কথার চল শুরু হয়েছে। আসলেই কি দেখে না?
জাহিদ : কিছু দেখে, অনেক সময় দেখে না। আসলে অনেক চ্যানেল তো, তাই কিছু সময় খবর, কিছু সময় নাটক আবার কিছু সময় আমাদের দর্শকরা জি বাংলা বা অন্য দেশের চ্যানেল দেখছে। নাটক প্রচারের সময় দেখা গেলো খবর বা অন্য দেশের চ্যানেলে দর্শক থাকছে। তবে আগের মতো মানুষ এখন টিভি দেখে না। এটা সত্যি।
বাংলানিউজ : টিভি অনুষ্ঠানে বিজ্ঞাপন নিয়ে আপনার মন্তব্য কী?
জাহিদ : আমাদের দেশে চ্যানেল অনেক। কিন্ত বিজ্ঞাপন যারা দেন তাদের একটা নির্দিষ্ট বাজেট থাকে। টিভি চ্যানেলও কী করবে? ধরুন আপনার পরিবারে লোকসংখ্যা চারজন, চারটা রুটি হলে সমান ভাগ করে খেতে পারবেন। কিন্তু লোকসংখ্যা যখন ৩০ জন হয়ে যাবে, রুটি তো চারটাই! তখন কিন্তু অল্প অল্প করে পাবেন। তারপরও কিছু কিছু নীতিমালা থাকলে সুবিধা হয়। আমি নীতিমালার পক্ষে। একটা নীতিমালা থাকলে যাদের কনটেন্ট ভালো থাকবে তারা টিকবে, যাদের গড়পড়তা মান থাকবে তারা টিকবে না। আমি মনে করি, বিজ্ঞাপনের একটা নীতিমালা থাকা উচিত।
বাংলানিউজ : আপনি দীর্ঘ সময় ধরে অভিনয় করছেন। কয়েক প্রজন্ম আপনার কাজ দেখেছে, এখনও দেখছে। অভিনয়ের মজা কোথায়?
জাহিদ : যখন মানুষ আমাকে ভালো বলে। এই যে কষ্ট করি রাতদিন গ্রামে, শহরে; শরীর খারাপ থাকলেও কাজ করি, তারপরও মানুষ যখন বলে- ‘ভাই আপনার অভিনয়টা ভালো লেগেছে, এই জায়গাটা ভালো লেগেছে’; তখন মজা লাগে। তাই আবার কাজে নেমে পড়ি। এটা অনেকটা নেশার মতো।
বাংলানিউজ : আপনি মানুষটা মজার! আপনার রসবোধের উৎস কী?
জাহিদ : সততা। আসলে সততার সঙ্গে একটু রস যোগ করে দিলেই মানুষ মজা পায়। আমরা সবসময় চাই নিজেকে লুকিয়ে রাখতে। সততার সঙ্গে যদি কোনো কথা বলা যায়, সম্মান দেখানো যায়, ভালো ব্যবহার করা যায়; তখন মানুষ মজা পায়। খুব রূঢ় হয়ে বললে কারও কথায় কেউ মজা পায় না। আন্তরিক হলেই একজনের সান্নিধ্য আরেকজন উপভোগ করে। এটা আমার কাছে মনে হয়। আপনি কারও সঙ্গে আন্তরিকভাবে কথা বললে দু’জনই আলাপ করে মজা পাবেন।
বাংলানিউজ : আমরা আপনাকে অভিনেতা-নির্মাতা হিসেবে পেয়েছি। ছোটবেলায় জাহিদ হাসান কী হতে চেয়েছিলো?
জাহিদ : ছোটবেলায় অনেক কিছু হতে চেয়েছিলাম। ফুটবল খেলোয়াড় হতে চেয়েছি, পাইলট হতে চেয়েছি, হাডুডু খেলতে চেয়েছি। মেলা কিছু হতে চেয়েছি। অভিনেতাও হতে চেয়েছি। শেষমেষ অভিনেতা হতে পেরেছি।
বাংলানিউজ : অভিনেতাদের জীবনে অনেক উত্থান-পতন থাকে। অভিনয় করে তো প্রচুর টাকাও আসে না। খারাপ লাগে না?
জাহিদ : মাঝে মধ্যে খারাপ লাগে। বিরক্তও লাগে। তখন ব্যবসায়ী হয়ে যেতে ইচ্ছে করে। তবে আমার সবচেয়ে বেশি ভালো মানুষ হতে ইচ্ছা করে।
বাংলানিউজ : আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বা সমাবেশে অনেক প্রতিশ্রুতি দেন। এই যেমন চট্টগ্রামের মেয়রও কয়েকটা লক্ষ্যমাত্রার কথা বললেন। আপনিও ছিলেন তখন। আপনার কি মনে হয়, রাজনীতিবিদদের পক্ষে সব পূরণ করা সম্ভব?
জাহিদ : আমাদের দেশের মানুষগুলো অনেক ভালো। সেটা যে দলেরই হোক; হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান- যে ধর্মেরই হোক। সাময়িক রাগে, ক্ষোভে, অভিমানে, যন্ত্রণায় হয়তো অনেকে প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে ওঠেন, হতাশা প্রকাশ করেন। তবুও দেখবেন, আমাদের দেশ অনেক বড় দেশ হবে একসময়। আমাদের দেশে অনেক গুণী গুণী মানুষ আছে, অনেক বড় বড় মানুষ আছে। তাদের অবদানে আমাদের দেশ অনেক বড় হবে। আমি এটা বিশ্বাস করি।
বাংলানিউজ : মৃত্যু নিয়ে ভাবেন?
জাহিদ : হ্যাঁ। এটা নিয়ে ভয় লাগে অনেক সময়। আমার মা-বাবা বেঁচে নেই, তাদের কবরস্থানে যাই। তখন ভাবি, আসলে মৃত্যুই সত্যি। এর চেয়ে বড় সত্যি আর নেই। এটাকে মেনে নিতে হবে। মৃত্যু থেকে পিছিয়ে যাওয়ার উপায় নেই। আমি এখন পালিয়ে হিমালয়ে গেলাম, ওখানেও কিন্তু মরে যেতে পারি। এই যে চট্টগ্রামে এসেছি, আবার ঢাকায় যাবো, কিংবা আমেরিকা, ফ্রান্স-সহ বিশ্বের যে কোনো প্রান্তেই ঘুরে বেড়ালাম, আমাকে মরে যেতেই হবে। এই সত্যিটার মুখোমুখি হতে হয় সবাইকে। আপনি-আমি সবাই মরে যাবো...
বাংলানিউজ : সাংবাদিক হলে জাহিদ হাসানকে আপনি কোন প্রশ্নটা করতেন?
জাহিদ : এটা কখনও ভাবি নাই যে ভাই! তবে হ্যাঁ, সাংবাদিক হলে জাহিদ হাসান সম্পর্কে পড়াশোনা করে দেখতাম তার ভালোটা কি আর মন্দটা কি। তারপর সেটা প্রশ্ন করতাম। এখনকার সাংবাদিকদের বেশিরভাগই পড়াশোনা করে না। আমি একজনকে যখন ধরবো তখন জানতো তো হবে। ভালোটাও জানতে হবে, তার খারাপটাও জানতে হবে। সবাই এটা করে না। অনেক সময় আমাকে হাতের কাছে পেয়ে অনেক সাংবাদিক প্রশ্ন করে বসেন- আপনার প্রিয় রঙ কি, প্রিয় ফুল কি!
বাংলাদেশ সময় : ১৭৪৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৪, ২০১৫
জেএইচ