যেন একজন গ্রিক মাস্টার! লম্বা শরীর, এলোমেলো চুল, একটা ঝোলা কাঁধ বেয়ে নেমে ঝুলে পড়েছে, পাঞ্জাবি- তার ওপর খাদির জ্যাকেট- বোতাম খোলা। আর জ্বলজ্বলে বুদ্ধিদীপ্ত দু’টো চোখ, যেন ধরে রাখছে সব।
যখন আমার ‘তিতাস’ (তিতাস একটি নদীর নাম) করার কথা আসে, তখন এ দেশটা সবে স্বাধীন হয়েছে। এবং মোস্ট আনসেটেলড। এখনও যে খুব একটা স্বাধীন হয়েছে তা মনে হয় না। কিন্তু তবু তখন একেবারে কিছুই বোঝা যাচ্ছিলো না কী চেহারা নেবে।
সব শিল্পই দু’রকমভাবে করা যায়। একটা হচ্ছে খবরের কাগুজে শিল্প। সেটা করতে পারতাম। আর একটা হচ্ছে উপন্যাস, যেটা লাস্টিং ভ্যালু। সেটার জন্য থিতোতে দিতে হয়। নিজের মাথার মধ্যে অভিজ্ঞতা খরচা করতে হয়। টাইম দিতে হয়। ভাবতে হয়। ইট টেকস টু-থ্রি ইয়ারস, ফোর ইয়ারস অ্যান্ড দেন অনলি ইউ ক্যান মেক সাচ অ্যা ফিল্ম, আদারওয়াইজ ইউ ক্যান নট বি অনেস্ট। তুমি খবরের কাগুজেপনা করতে চাও করতে পারো। আমি খবরের কাগুজে তো নই। আমি অনেক গভীরে ঢোকার চেষ্টা করি। কাজেই তখন ফট করে এসে- পঁচিশ বছর যেখানে আসিনি, সেখানে এসে কিছু বুঝতে না বুঝতে, নাড়ির যোগ করতে না করতে, দেশের মানুষকে গঞ্জে, বন্দরে, মাঠে, শহরে যাদের দেখি না, জানি না, চিনি না- আমি পাকামো করতে যাবো কোন দুঃখে? আমার কোনো অধিকারই নেই।
এই হচ্ছে এক। আর দু’নম্বর হচ্ছে, তখন কন্ডিশন কেমন ফাস্ট চেঞ্জিং, এটা, ওটা, সেটা, নানারকম, তার মধ্যে থেকে একটা প্যাটার্ন আস্তে আস্তে বেরোক। আমি ভাববার সুযোগ-সুবিধা পাই। ফরমায়েশ দিয়ে শিল্প হয় না। তুমি হুকুম দিলে ‘দরবেশ’ খাবো, কী ‘রাঘবশাহি’ খাব, কী ‘রসকদম্ব’ খাবো, তা নয়। ‘দৈ দাও মরণ চাঁদের’ এ ব্যাপারটা নয়, ব্যাপারটা হচ্ছে যে আমার ভেতর থেকে যখন ইচ্ছে আসবে, তখন করবো। আর দ্বিতীয় কথা হচ্ছে যে সেইটে করার পক্ষে, ‘তিতাস’টা আমার পক্ষে আইডিয়াল, কারণ ‘তিতাস’ ছিলো একটা সাবজেক্ট, যে সাবজেক্ট মোটামুটি যে বাংলাটা নেই আর, আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগেকার বাংলা। তার ওপর তো পটভ‚মিটা। এর সাবজেক্টটা হচ্ছে এমন যা বাংলাদেশের সর্বত্র ঘোরার সুযোগ দেয়- গ্রামবাংলাকে বোঝার সুযোগ দেয়।
গাঁয়ে গিয়ে শুটিং করাটা বড় কথা নয়। শুটিং করার ফাঁকে ফাঁকে মানুষের সঙ্গে মেশা, নাড়ির স্পন্দনটাকে বোঝার চেষ্টা করা। কাজেই ‘তিতাস’টা একটা অজুহাত এদিক থেকে। এবং ওই অবস্থায় ‘তিতাস’ ধরে করলে হয় কী, সেই মাকে ধরে পুজো করা হয়। তা এতোগুলি কারণেই এই ‘তিতাস’ হতে পারতো না। এখনও ‘তিতাস’ আমার কাছে একটা স্টাডি আর আমার একটা ওয়ারশিপ হিসেবে দেখা যেতে পারে। দিস রিভার, দিস ল্যান্ড, দিস পিপল এদের মধ্যে যাবার একটা ব্যাপার আছে। আবার আছে এর সঙ্গে নিজেকে রিএস্টাবলিশ করা। আর শেষ কথা হচ্ছে, ও সময়টা ওটা টাইম ছিলো না এবং টাইম এখনও আসেনি। এখনও সিরিয়াস স্টাডি করে সিরিয়াস ওয়ার্ক, যেটা আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পরে লোকে দেখে কিছু বুঝবে, সেরকম ছবি করার অবস্থা এখনও আমার আসেনি। মানে আমি এখনও এতোটা বুঝে উঠতে পারিনি- কোনদিকে যাবে ইতিহাস। আমি যেদিন তাগিদ বোধ করবো, আমি ঠিক জুড়ে দেবো।
‘তিতাস’-এর শুটিং অনেক আগে আরম্ভ হয়, কিন্তু কথাবার্তা পাকা হয় আগে ‘যুক্তি তক্কো’র। কিন্তু সরকারি ব্যাপার, ছবিটা এফএফসির টাকা নিয়ে করা, ওই টাকা-ফাকা পেতে দু’চার মাস লেগে যায়, ওরই ফাঁকে তিতাসের লোকেরা এসে যায়, আমি ঢাকায় গিয়ে ছবির কাজ আরম্ভ করি।
বাংলাদেশ বলতে আমার যা ধারণা ছিলো, ওই দুই বাংলা মিলিয়ে, সেটা যে ৩০ বছরের পুরনো, সেটা আমি জানতাম না। আমার কৈশোর এবং প্রথম যৌবন পূর্ব বাংলায় (বাংলাদেশ) কেটেছে। সেই জীবন, সেই স্মৃতি, সেই নস্টালজিয়া, আমাকে উন্মাদের মতো টেনে নিয়ে যায় তিতাসে। তিতাস নিয়ে ছবি করতে। তিতাস উপন্যাসের সেই পিরিয়ডটা হচ্ছে চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগেকার, যা আমার চেনা, ভীষণভাবে চেনা। ‘তিতাস’ উপন্যাসের অন্যসব মহত্ত্ব ছেড়ে দিয়েও এই ব্যাপারটা আমাকে প্রচণ্ডভাবে টেনেছে। ফলে তিতাস একটা শ্রদ্ধাঞ্জলি গোছের, সেই ফেলে আসা জীবনস্মৃতির উদ্দেশ্যে। এ ছবিতে কোনো রাজনীতির কচাকচি নেই, উপন্যাসটা আমার নিজের ধারণায় এপিকধর্মী। এ ছবিতে আমি প্রথম এই ঢংটা ধরার চেষ্টা করেছি। আমার শৈশবের সঙ্গে তিতাসের বহু ঘটনা জড়িয়ে আছে। অনেক কিছু আমি নিজে চোখে দেখেছি। ওই যে বললাম, এই ৩০ বছর মাঝখানে ব্ল্যাঙ্ক, আমি যেন সেই ৩০ বছর আগেকার পূর্ব বাংলায় ফিরে যাচ্ছি।
একুশে ফেব্রুয়ারি ওরা আমাকে, সত্যজিৎবাবুকে এবং আরও কয়েকজনকে স্টেট গেস্ট করে নিয়ে গিয়েছিলো ঢাকায়। প্লেনে করে যাচ্ছিলাম, পাশে সত্যজিৎবাবু বসে, যখন পদ্মা ক্রস করছি তখন আমি হাউমাউ করে কেঁদে ফেললাম। সে বাংলাদেশ আপনারা দেখেননি, সেই প্রাচুর্যময় জীবন, সেই সুন্দর জীবন, আমি যেন সেই জীবনের পথে চলে গেছি, সেই জীবনের মাঝখানে, এখনও যেন সব সে রকম আছে, ঘড়ির কাঁটা যেন এর মাঝে আর চলেনি। এই বোকামি নিয়ে, এই শিশুসুলভ মন নিয়ে ‘তিতাস’ আরম্ভ।
ছবি করতে করতে বুঝলাম সেই অতীতের ছিটেফোঁটা আজ আর নেই, থাকতে পারে না। ইতিহাস ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর, ও হয় না, কিসসু নেই, সব হারিয়ে গেছে। এ ছবির স্ক্রিপ্ট লেখা থেকে শুটিংয়ের অর্ধেক পর্যন্ত আমি মানুষের সংস্পর্শে প্রায় আসিনি। ঢাকায় আমি থাকতাম না, এখান থেকে (কলকাতা) ঢাকায় টাচ করে চলে যেতাম ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া, নইলে কুমিল্লা, নইলে আরিচাঘাট, পাবনা, নারায়ণগঞ্জ, বৈদ্যর বাজার এইসব, মানে গ্রামে-গঞ্জে, ছবিটা তো গ্রাম-গঞ্জ-নদী নিয়েই, কাজেই সমস্ত সময়েই গ্রামে থেকেছি। ঢাকায় একদিন রেস্ট নিয়েই চলে গেছি, কারও সঙ্গে দেখা করিনি, মিশিনি। ওদের রাজনীতি কী হচ্ছে না হচ্ছে তাকিয়ে দেখিনি, খবরের কাগজ পর্যন্ত সবসময় দেখে উঠিনি।
কাজেই ছবি করার ফার্স্ট হাফ পর্যন্ত এখনকার বাংলাদেশের যা চেহারা তার থেকে কম্পিলিটলি বিচ্ছিন্ন ছিলাম। আমি নিজেকে সমস্ত কিছু থেকে সরিয়ে রেখেছিলাম। তারপর ঢাকায় গিয়ে কয়েকদিন থাকতে হলো, ছবির এটা-ওটা-সেটার জন্য। তখন ক্রমশ দেখলাম সমস্ত জিনিসটা ফুরিয়ে গেছে, মানে একেবারেই গেছে, আর কোনোদিন ফিরবে না। এটা খুবই দুঃখজনক আমার কাছে, কিন্তু দুঃখ পেলে কী হবে, ছেলে মারা গেলে লোকে শোক করে, কিন্তু ইট ইজ ইনিভাইটেবল।
মানুুষের চিন্তাধারা পাল্টে গেছে। মানুষের মন গেছে পাল্টে, মানুষের আত্মা গেছে পাল্টে। টাকাকড়ির সমস্যা, খাওয়া-দাওয়ার সমস্যা, দারিদ্র্য ওখানেও আছে। চুরি-জোচ্চুরি, বদমাইশি ওখানেও আছে, এখানেও আছে। এখানে চুরি-জোচ্চুরি, বদমাইশি পাইপগান-বোমা-পেটো এসব নিয়ে হয়। ওখানে একটা সুবিধে হয়েছে এ ব্যাপারে, খানসেনারা প্রচুর আর্মস ফেলে গেছে। সেসব দিয়ে ওইসব হচ্ছে। কিন্তু সমস্যাটা একই, মানুষের সাংস্কৃতিক মন পচে গেছে। অতীতের সঙ্গে নাড়ির যোগ একেবারে কেটে গেছে। অবশ্য আশার কথা, কিছু ইয়াং ছেলে সবে ইউনিভার্সিটিতে ঢুকছে, বেরিয়েছে বা বেরোচ্ছে, এমন সব ছেলে, তাদের মধ্যে একটা প্রচন্ড বোধ এবং অত্যন্ত সচেতনতা এসেছে। এরাই ভরসা, ওখানকার ভালো যা কিছু সবই এদের কনট্রিবিউশন।
ছবিতে ইন্টারফারেন্স সেরকম কিছু হয়নি। আর্থিক দিক থেকে যখন যা চেয়েছি তা এরা দিয়েছে। আশ্চর্য ঘটনা, শিক্ষাই হলো বলা যায়, কলকাতার এই হ্যাংলা জায়গায় থেকে আমার একটা ধারণা ছিলো যে, ছবির ব্যাপারে পয়সাটাই একমাত্র সমস্যা। পয়সার যদি সমাধান করা যায় অর্থাৎ পয়সাওয়ালা লোক যদি জোটে, তাহলে ছবির ক্ষেত্র নিশ্চিন্ত। এই প্রথম আমার অভিজ্ঞতা হলো, শুধু পয়সা থাকলেই ছবি হয় না। ওখানে যন্ত্রপাতি, ফিল্মের অভাব, আর্টিস্টের অভাব, সে যে কী অসুবিধে, কী কষ্ট, টেকনিশিয়ান ছাড়া কেউ বুঝবে না, যারা ওয়ার্কার তারাই বুঝবে। অসুবিধে এখানেও আছে, বোম্বেতেও আছে। আমি কলকাতা, বোম্বে, পুনা, সব জায়গাতেই ছবি করেছি। অসুবিধাগুলো আমি জানি। কিন্তু সমস্ত অসুবিধে হান্ড্রেড টাইম ম্যাগনিফাইড সেখানে। যন্ত্র চাই, যন্ত্র নেই, এডিটিংরুম চাই, নেই, পাওয়া যাবে না। সাউন্ড মেশিন এখানে হাত দিলে ওখানে ঝম করে ঝরে পড়ে। সব একেবারে ঝরঝরে হয়ে গেছে, মিসইউজ করে করে। ব্রিলিয়ান্ট সমস্ত মেশিন, এমন সব মেশিন বাপের জন্মে এখানে সেসব দেখিনি। কিন্তু বাজেভাবে ইউজ করে, মিসইউজ করে এমন কান্ড করেছে যে সেগুলো প্রপারলি ইউজ করা যায় না। ফলে প্রতিদিন প্রচণ্ড বিপদ এবং অসুবিধের মুখোমুখি হতে হয়েছে আমাদের।
কলাকুশলী, শিল্পীরা আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। ওদের পক্ষে ওর মধ্যে যা পসিবল তা ওরা করেছে। ছবির প্রডিউসার (হাবিবুর রহমান খান) সে-ও ইয়াং। অত্যন্ত বড়লোকের ছেলে, এসবের মধ্যে কখনও ঢোকেনি। ফিল্ম সম্পর্কে ওর ধারণা ঋত্বিকদা একটা ছবি করবে, কাট টু এয়ারকন্ডিশন্ড হলে বসে ছবি দেখছি। ছবি করা মানে যে এক বছরের প্রচণ্ড পরিশ্রম, সেটা ওর ধারণা ছিলো না। টাকা দিলাম, ঋত্বিকদা ছবি করবে, ছবি রিলিজ হবে, হলে বসে ছবি দেখবো, টাকা পেলাম নাকি না পেলাম বয়েই গেলো, ছবি না চললে কিছু এসে যায় না, ছবি ভালো করতে হবে। এরকম ছেলে আমি আগে পাইনি। অন্যান্য কলাকুশলী বা শিল্পীরা, সবাই চেষ্টা করেছে, খেটেছে- আবার সব জায়গাতেই কিছু ত্যাঁদড় থাকে, ওখানেও ছিলো।
...‘তিতাস’-এ আমি অসুস্থ হয়ে পড়লাম। আর এটাও এডিটিংয়ের মাঝখানে, অসুস্থ হওয়াতে গেলো পিছিয়ে। ... লাস্ট শট নেওয়া হলো বালির মধ্যে। বেলা দু’টোর সময়। তপ্ত বালির মধ্যে আমার হিরোইন মারা গেলো। সেই শটটা নিলাম। ছবির লাস্ট শট, সঙ্গে সঙ্গে বালির মধ্যে অজ্ঞান হয়ে গেলাম। শুটিং কমপ্লিট!
বাংলাদেশ সময়: ১৬৪৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৪, ২০১৫
কেবিএন/জেএইচ
তারার ফুল
ঋত্বিক ঘটকের ‘তিতাস’ বিষয়ক বয়ান
বিনোদন ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।