আশপাশের লোকজন, যারা পরিচিত- ওয়াহিদ আনামকে জানে-চেনে-গতিবিধি মুখস্ত; তারা রহস্যচ্ছলে ‘পানির অপর নাম ওয়াহিদ আনাম’ বললেও, রসিকতাটিকে যে একেবারেই হাসি দিয়ে উড়িয়ে দেয়া চলে, তা কিন্তু নয়। ধরা যাক, তিনি যেখানে ঘুমান-চিন্তা করেন-বিশ্রাম নেন; ফ্ল্যাটটি বাড্ডার মতো ঘনবসতির জায়গায় হলেও, শহর ঢাকায় হলেও, বেশ খোলামেলা।
কথা শেষ না করে ওয়াহিদ আনাম ‘বিষয়’টিকে হালকা হাসি দিয়ে, চোখের ইশারা দিয়ে বুঝিয়ে দিতে চান। ওই সময় তার ডান ভ্রুঁ যেদিকে বেঁকে ঢেউয়ের মতো হয়ে থাকে অনেকটা, ওই পথ ধরে তাকালেই গুলশান লেক। শ্রোতা ধরতে পেরেছে, বুঝে গেলে, তারপর আবার মুখ খোলেন, ‘ম্যাজিকটা দেখেছেন?’ ডাবল বেড লাগোয়া বেলকনি- দু’টোর মাঝখানে স্বচ্ছ কাঁচের দরজা। তারপর অনেকটা জায়গা জুড়ে ফাঁকা। গুলশান লেক। পানির রাজত্ব। দেখে-শুনে এমন লোকেশনেই ওয়াহিদ নিজের ‘আশ্রম’ বানিয়েছেন।
প্রসঙ্গ উঠিয়ে দিলে তিনি মুচকি হাসেন। তার হাসি মানে শুধু ঠোঁট বক্রাকৃতি হয়ে বাঁ দিকে ছড়িয়ে যাওয়া নয়। সঙ্গে দীর্ঘ শরীরটাও দুলে দুলে ওঠে বারকয়েক। প্রসঙ্গ যাতে এতো দ্রুত শেষ না হয়ে যায়, সে কারণেই হয়তো একটু জুড়ে দেন, ‘পানি আমার ভীষণ প্রিয়। আই লাভ ওয়াটার। ’ তার ফ্ল্যাটের মেঝেতেও পানির উপস্থিতি আছে। মেঝেতে চিকন রেখার মতো করে একটা অ্যাকুরিয়াম বানানো। তাতে রঙিন মাছ সাঁতরে বেড়াচ্ছে কৃত্রিম সামুদ্রিক আবহে।
এই যে ‘পানির অপর নাম’ বলে লোকজন রসিকতা করে তার নাম ধরে, সেটা ওয়াহিদের যাপন-শখ-ঘোরাঘুরি দেখেই নয় শুধু। কাজেও ছাপ আছে। তিনি নির্মাতা। নাটক-টেলিছবি বানান, এবং পরবর্তীতে বিজ্ঞাপনও। তার নাটকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গল্প হয়ে উঠে আসে গ্রাম-মফস্বল। গ্রামের প্রান্তিক প্রেম-সংসার-স্বপ্ন। আর প্রতারণা। এখানেই একটা বিস্ময় চিহ্ন টুপ করে বসে পড়ে চেহারায়। রাজধানী ছাড়িয়ে, বহু কিলোমিটার পেছনে, বরিশালে তার জন্ম। এর বছর কয়েক পর থেকে শহুরে জীবন শুরু। একপর্যায়ে প্রবাসী। বহুবছর নিউইয়র্কে কাটিয়ে ঢাকায় ফেরা। তারপর নাটক নির্মাণ।
বিস্ময়টা এখানেই, এমন একজন ব্যক্তিত্বের প্রিয় প্রেক্ষাপট হিসেবে গ্রাম চলে আসা, প্রায় অসম্ভবই, যার স্মৃতিতে গ্রাম বলে না থাকার মতো করে একটা অঞ্চলের অস্পষ্ট চেহারাটা আছে। তাও আবার বহু আগের। ওয়াহিদ আনামের পুরুষ হয়ে ওঠার এতো বছরে গ্রামীণ চরিত্র পাল্টেছে অনেকগুণ। সুতরাং পরিবর্তনটা ধরতে পারার একটা বিষয় থেকেই যায়। মানা গেলো, এ সবই ঠিকঠাক আছে। কিন্তু এতো বছর প্রবাসকাল কাটিয়ে ফেরার পর, গ্রামীণ জীবনই প্রিয় বিষয় হিসেবে থেকে যাবে- এটা সাধারণ ‘ধরে নেয়া’র বাইরেই পড়ে। ওয়াহিদ আনামকে তাই যখন প্রশ্ন করা হয়, ‘এই কর্পোরেট কালচার, নগরায়নের ঝলমলে বাতি, পার্টি-হ্যালুইন-ডিজে- র্যাম্প টানলো না আপনাকে?’
ওয়াহিদ আনাম হাসতে গিয়েও সামলে নেন। যতোখানি সম্ভব গলায় আবেগ ঢেলে দিয়ে বলেন, ‘গ্রামই টানে আমাকে। ’ তার গল্পে তাই বরিশাল আছে, কুয়াকাটা, গ্রাম্য রাজনীতি, ‘মধ্যবিত্ত ভীরু প্রেম’, টানাটানির সংসার, একলা নারীর সংগ্রাম আছে। আর আছে পানি। তিনি টেলিছবি ‘পাড়ি’ বানালেন সমুদ্রপথে আদম পাচার নিয়ে। ‘ছিন্ন’ সে-ও পানিপথে দু’বন্ধুর দূরে মাল পৌঁছে দেয়ার যাত্রা। সর্বশেষ ‘চক্র’তে আবার নতুন করে উঠে এলো নারী-শিশু বিদেশে পাচারের বিষয়টিও। সেটিও সমুদ্রপথে। এই তালিকার আগেও ওয়াহিদ আনামের গোটাদশেক একক আছে, ধারাবাহিকও।
আড্ডার একেবারে শেষদিকে এসে, তার প্রতিষ্ঠান শুণ্য এন্টারটেইনমেন্টের সোফায় বসে, নির্মাতা ওয়াহিদ আনাম যে কথাটি শোনালেন, মন খারাপ করে ফেলার মতো। দিন দিন বিজ্ঞাপন নির্মাণে ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন তিনি। মন খারাপের খবর এটা নয়। খবরটা হচ্ছে, আর কখনই নাটক নির্মাণ করবেন না ওয়াহিদ আনাম! ‘চক্র’ই ছিলো তার শেষ ফিকশন! আনন্দের সংবাদও আছে, চলচ্চিত্র শুরু করতে যাচ্ছেন তিনি। লঞ্চডুবি নিয়ে গল্প। চিত্রনাট্য লেখাও শেষ করে এনেছেন প্রায়। বললেন, ‘আগামী বছরই সিনেমাটার কাজ শুরু করে দেবো। ’
বাংলাদেশ সময়: ১৩১০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১০, ২০১৫
কেবিএন/এসও