‘আগুনের পরশমনি’কে ঘিরে আছে অনেক ঘটন-অঘটনের গল্প। একে তো হুমায়ূন আহমেদের প্রথম সিনেমা, যতোখানি নেশা- অনভিজ্ঞতা তারও বেশি।
চরিত্র: রাত্রি
অভিনেত্রী: বিপাশা হায়াত
রাত্রি রূপবতী, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। ফলে রাতদিন ঘরেই কাটাতে হচ্ছে রাত্রিকে। স্বপ্নচারী এই মেয়েটির চরিত্রে বিপাশা হায়াতকেই পছন্দ ছিলো হুমায়ূন আহমেদের। কিন্তু তাকে নেওয়ার কথা ভাবতেই বেশকিছু প্রতিবন্ধকতা ছুটে এলো এদিক ওদিক থেকে। ছবিতে রাত্রির সংলাপ বেশি নেই, অভিব্যক্তিই সব কথা বলে দেয়।
বিপাশা হায়াত তখন টিভি নাটকের ব্যস্ত তারকা। সংলাপ প্রধান কাজ করেই অভ্যস্ত। তাই বাধা এলো, ‘নাটকের জন্য তা ঠিক আছে। চলচ্চিত্রের জন্য একেবারেই মানানসই নয়। চলচ্চিত্রে কথা বলতে হবে চোখেমুখে। তাছাড়া মেয়েটির গলার স্বর মিষ্টি নয়। একটু খসখসে, চোখের মণিও কালো নয়, খানিকটা বাদামি। বড়পর্দায় যখন চোখ দেখা যাবে তখন সেই বাদামী চোখ মায়াটা তৈরি করতে পারবে না। ’
হুমায়ূন আহমেদ কারও কথা শুনলেন না। বিপাশাকেই নিলেন। কারণ একটাই, ‘আগুনের পরশমনি’ বিপাশার খুব প্রিয় উপন্যাসের একটি। আর এই তথ্য হুমায়ূন আহমেদ জানতেন। পরবর্তীতে ছবিটিতে তার অভিনয় দেখে, হুমায়ূন আহমেদের মা আয়েশা ফয়েজ নিজের হাতে উলের ব্যাগ বানিয়ে বিপাশাকে উপহার দিয়েছিলেন। আর সরকার দিয়েছিলো ১৯৯৪ সালের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র অভিনেত্রীর পুরস্কার।
চরিত্র: বদিউল আলম
অভিনেতা: আসাদুজ্জামান নূর
আসাদুজ্জামান নুর ছিলেন হুমায়ূন আহমেদের প্রিয় অভিনেতা। চলচ্চিত্রের বদিউল আলম চরিত্রে তাকেই নিলেন হুমায়ূন আহমেদ। কিন্তু বয়স মিললো না। গল্পে চরিত্রটি টগবগে তরুণ, আর আসাদুজ্জামান নূরের বয়স তখন পঞ্চাশ প্রায়। চেহারায় বয়সের ছাপ পড়ে গেছে, মাথার চুলও কমেছে। স্বাভাবিকভাবেই তাই প্রশ্ন এলো, পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়সের একজন মানুষ তেইশ বছরের যুবকের অভিনয় কীভাবে করবে?
হুমায়ূন আহমেদের উত্তর ছিলো, ‘পারবে। নূর হচ্ছে নূর। বাজারে বিকল্প ট্যাক্সি পাওয়া যায়। বিকল্প নূর কোথায় পাবো?’
চরিত্র: রাত্রির বাবা-মা
অভিনেতা-অভিনেত্রী: আবুল হায়াত ও ডলি জহুর
এ দু’টো চরিত্র নিয়ে হুমায়ূন আহমেদের অতৃপ্তি ছিলো। যে ধরনের অভিনয় আশা করেছিলেন, সেটা পাননি। তবে হুমায়ূন আহমেদ তার দায়ভার নিজের কাঁধে নিয়েছিলেন, ‘সমস্যাটা তাদের নয়, আমার। আমি অভিনয় আদায় করতে পারিনি। এই দু’জন এতোই শক্তিমান অভিনেতা যে তাদের কাছ থেকে যা চাওয়া হবে তারা তাই দেবেন। আমি চাইতে পারিনি কিংবা নিজে বুঝতে পারিনি ঠিক কি চাইছি। ’
চরিত্র: অপলা
অভিনেত্রী: শীলা
ছবিতে অপলা হচ্ছে রাত্রির ছোটবোন। হুমায়ূন আহমেদ তার মেয়ে শীলাকেই এ চরিত্রে নিলেন। এ বিষয়ে হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন, ‘রাত্রির ছোটবোন পাগলাটে অপালার ভ‚মিকায় আমি পক্ষপাতমূলক আচরণ করলাম। নিলাম আমার কন্যা শীলাকে। একেই বোধহয় বলে স্বজনপ্রীতি। এই মেয়ে ন্যাচারালিস্টিক অভিনয়ে ওস্তাদ। চোখেমুখে কথা বলে। মনে হয় জন্মসূত্রে সে এই ক্ষমতা নিয়ে এসেছে। ’ এর আগে শীলা কখনও চলচ্চিত্রে অভিনয় করেনি। কিন্তু সেটা নিয়ে তার মধ্যে কোনো জড়তা ছিলো না। এ ছবিতে অভিনয়ের জন্য শীলা ওই বছর শ্রেষ্ঠ শিশু অভিনেত্রীর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলেন।
চরিত্র: বিন্তি
অভিনেত্রী: পুতুল
বিন্তি কাজের মেয়ে। এ চরিত্রে পুতুলকে নেয়ার পেছনে দারুণ একটা গল্প আছে। তখন ‘কোথাও কেউ নেই’ ধারাবাহিকের জন্য অভিনেত্রী খুঁজছেন হুমায়ূন আহমেদ। ধারাবাহিকটিতে তিনটি চরিত্র আছে, যারা পতিতা। ওই চরিত্র করবে, এমন তিনজন মেয়ে দরকার। একজন পুতুলকে নিয়ে এলেন, ‘এই মেয়েটাকে দিয়ে চলবে? এর নাম পুতুল। গাজীপুরে থাকে। ’ হুমায়ূন আহমেদ এক ঝলক দেখেই বললেন, ‘চলবে। ’
পুতুল ধারাবাহিকটিতে অভিনয় করলেন। ধারাবাহিকটি শেষও হলো। এর বহুদিন পর গাজীপুরে আবার হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে তার দেখা। ‘কবি’ নামে একটি তথ্যচিত্র বানাচ্ছিলেন তিনি, পুতুল সেটা দেখতে এসেছেন। হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘এই মেয়ে তুমি কি তোমার চুলগুলি কেটে কদমছাঁট করতে রাজি আছো?’
ছবিতে অভিনয় করার খবর শুনে পুতুল চুল কাটতে রাজি। কিন্তু বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো তার এসএসসি পরীক্ষা। হুমায়ূন আহমেদ সান্ত্বনা দিলেন, ‘পরীক্ষা অনেক বড় ব্যাপার। তুমি ভালোমতো পরীক্ষা দাও। পরে কোনো এক সময় আমি তোমাকে সুযোগ দেবো। ’ কিন্তু পুতুল নাছোড়বান্দা, “এসএসসি পরীক্ষা প্রতিবছর একবার করে আসবে, কিন্তু ‘আগুনের পরশমনি’ তো আর আসবে না। ” আরও অনেক অনুরোধের পর হুমায়ূন আহমেদ রাজি হলেন। পুতুলের পরীক্ষার সূচি মাথায় রেখেই ছবির শিডিউল করা হয়েছিলো। আর হ্যাঁ, তার চুল কেটে কদমছাট করতে হয়নি। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার তিনিও পেয়েছিলেন। ছবিটি যখন জাপানে প্রদর্শিত হয়, তখন জাপানস্থ ফ্রেন্ডশিপ সোসাইটির আমন্ত্রণে তিনিও গিয়েছিলেন জাপানে।
চরিত্র: পান দোকানদার
অভিনেতা: সালেহ আহমেদ
চরিত্রটিতে সালেহ আহমেদকে নিয়ে নিশ্চিন্তই ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। হাসিখুশি মানুষ। রসিকতা করেন, রসিকতায় হেসে গড়িয়ে যান। হুমায়ূন আহমেদ জানতেন, তার অংশটি তিনি চমৎকারভাবেই করবেন। তাকে বলেছিলেন একমাস দাঁড়ি না কাটাতে। অথচ শুটিংয়ের দিন সালেহ আহমেদ আসলেন ‘ক্লিন সেভ’ হয়ে। খুব রাগ করলেন হুমায়ূন আহমেদ। নকল দাঁড়ি দিয়ে নানাভাবে চেষ্টা করা হলো। কিন্তু কোনোটিই পছন্দ হলো না তার। শেষ পর্যন্ত দাঁড়ি ছাড়াই অভিনয় করতে হলো। এ বিষয়ে হুমায়ূন আহমেদ বলছেন, ‘তার অভিনয় চমৎকার হওয়া সত্ত্বেও গেটআপের ত্রুটি আমি ভুলতে পারিনি। গলায় বিঁধে থাকা কৈ মাছের কাঁটার মতো এই ত্রুটি আমাকে ক্রমাগত খুঁচিয়েছে। ’
চরিত্র: পাকিস্তানি কর্নেল
অভিনেতা: ওয়ালিউল ইসলাম
তিনি নিজেই ছিলেন নৌবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত অফিসার। কর্নেলের ভূমিকায় খুব দারুণ অভিনয় করেছিলেন তিনি। হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন, ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার তাকে না দেয়াটা খুব অন্যায় হয়েছে। ’ এমনকি এটাও বলেছিলেন, “আমাকে যদি বলা হয় ‘আগুনের পরশমনি’তে সবচেয়ে ভালো অভিনয় কে করেছেন? আমি বলবো-ওয়ালিউল ইসলাম ভূঁইয়া। আমার কথায় অনেকেই হয়তো রাগ করবেন, কিন্তু কথাটা সত্যি। ”
আগামী ১৩ নভেম্বর নন্দিত কথাশিল্পী-নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন। প্রয়াত এই শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তার লেখা গ্রন্থ ‘ছবি বানানোর গল্প’ থেকে দেওয়া হলো এসব তথ্য।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৫২ ঘণ্টা, নভেম্বর ১১, ২০১৫
কেবিএন/এসও/জেএইচ