গত ১৩ নভেম্বর ছিলো নন্দিত কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন। তারই উপন্যাস অবলম্বনে এদিন শিল্পকলা একাডেমীর জাতীয় নাট্যশালায় ‘দেবী’ নাটকের শততম মঞ্চায়ন করলো নাট্যদল বহুবচন।
বাংলানিউজ: ‘দেবী’ তথা মিসির আলীর সঙ্গে পথচলা কেমন উপভোগ করছেন?
তৌফিকুর রহমান: হুমায়ুন আহমেদ কতো বড়মাপের কথাসাহিত্যিক সেটা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। তিনি নিজস্ব শক্তির জোরে কিংবদন্তি ও সর্বজন শ্রদ্ধেয়। তবে তার সাহিত্যকর্ম নিয়ে মঞ্চ মাধ্যমে পথচলায় নাট্যদল বহুবচন সংগত কারণে গৌরবের অংশীদার। ১৯৭৫ সালের শেষ নাগাদ আমরাই মঞ্চে আনি ‘নন্দিত নরকে’ উপন্যাসের নাট্য প্রযোজনা। উপন্যাস থেকে নাট্যরূপের জটিল কর্মটি কীভাবে করা হবে প্রশ্নে হুমায়ূন আহমেদের সমাধান ছিলো, ‘জাফর ইকবালকে বলে দেব, ও-ই নাট্যরূপ দেবে’। সত্যি সত্যি তখন আমরা ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের নাট্যরূপে নাটকটি মঞ্চে আনি। নারী হৃদয়ের রক্তক্ষরণের এই নাটকটি একদিকে যেমন দর্শকপ্রিয়তা পায় অন্যদিকে আমরা ধারাবাহিকভাবে অনেক প্রদর্শনী করতে পারি। এরপর আমরা দলীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নিই, হুমায়ুন আহমেদের জনপ্রিয় উপন্যাস ‘দেবী’ মঞ্চায়ন করবো। একদিন আমরা লেখকের গ্রিনরোডের বাসায় হাজির। আমাদের চাওয়ার বিপরীতে তার অভিব্যক্তি ছিলো প্রাণবন্ত, নান্দনিক ও অকৃত্রিম। তিনি বলেছিলেন, ‘আমার নাটক লেখার অনুপ্রেরণা তো বহুবচন। আমার যে কোনো নাটক আপনারা নাট্যরূপ দিয়ে মঞ্চস্থ করতে পারেন। আপনাদের প্রতি আমার বিশ্বাস আছে। ’ এরপর আমাদের দলের এক সময়ের সভাপতি ও আজীবনের নাট্যকর্মী বন্ধু মো. ইকবাল হোসেনের নাট্যরূপে আর আরহাম আলোর নির্দেশনায়, দেড় বছরের মহড়া শেষে ১৯৯৪ সালে মঞ্চে আসে ‘দেবী’। এটি দেশ ও কলকাতায় নাট্যানুরাগী এবং নাট্যবোদ্ধাদের কাছে বহুল প্রশংসিত প্রযোজনা। ২১ বছর ধরে এটি মঞ্চায়ন হচ্ছে।
বাংলানিউজ: বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে ‘দেবী’ কেমন?
তৌফিকুর: অতীত মানুষকে তাড়িয়ে বেড়ায়। এরকম এক ভয়ংকর অতীত থেকে ষোল-সতের বছর বয়সী রানুর প্রানান্তকর বাঁচার লড়াইয়ের প্রশ্নে দেবী সত্ত্বাকে আঁকড়ে ধরা আর রহস্যভেদী মিসির আলীর বাস্তবতা অন্বেষণের টানাপোড়েনের নাটক ‘দেবী’। মনস্তাত্বিক এই নাটক মনেই বেশি বিবেচ্য।
বাংলানিউজ: বহুবচন দলের পথচলা নিশ্চয়ই ঘটনাবহুল। এতদিন পেরিয়ে কী মনে হয়?
তৌফিকুর: সবে দেশ স্বাধীন হলো। রণাঙ্গনের পালা সাঙ্গ হলো। এবার ভাঙা দেশটাকে গড়ে তোলার পালা। মতিঝিল নিপুনা পেট্রোল পাম্পে দিনের পর দিন আড্ডা চলতো। অবশেষে সবাই সিদ্ধান্ত নিলাম নাটক করব। সেলিম, মোতাহার, আরমান, বিন হক, নওশাদ, ঝিনু, মাজহার, বিপ্লব, দুলাল, দুলু আর আমি মিলে কন্ঠে তুলে নিলাম এই স্লোগান- ‘আমাদের নাটক মানে শুধু নাটকীয়তা নয়, নাটকের চিরচারিত আঙিকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ’। দলের নাম রাখা হলো বহুবচন। ‘প্রজাপতির লীলালাস্য’ নাটক দিয়ে যে আমাদের দলীয় যাত্রা শুরু, সে দলীয় যাত্রায় ৪৩ বছরে ২২টি নাটক প্রযোজনা করা হয়েছে। চলতি পথ কখনও দ্রুত ধাবমান, কখনও ছিলো ধীরলয়। শেষাবধি বহুবচন কখনও মঞ্চ ছাড়েনি, ছাড়বেও না। এই অনুকুল-প্রতিকূল উভয় অবস্থায় বহুবচন বিকশিত হয়েছে আবার নান্দনিকতা অক্ষুণ্ন রেখে প্রকাশিত হয়েছে। এটাই আমাদের আনন্দ ও গর্ব।
বাংলানিউজ: অভিনয়ে আপনার শুরুটা কীভাবে?
তৌফিকুর: যখন নটরডেম কলেজে বিজ্ঞান কিংবা ঢাকা বিশ্বাবিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান নিয়ে পড়ছি, তখন আমাদের চেতনায় ছিলো পড়াশোনার পাশাপাশি দিনে খেলা আর রাতে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ। ফলে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়েই আমার অভিনয়ে হাতেখড়ি। সে হিসেবে আবদুল্লাহ আল মামুনের ‘সেনাপতি’ নাটকে আব্বাস আলী তালুকদার হচ্ছি তো মমতাজ উদ্দিন আহমেদের ‘জমিদার দর্পন’ নাটকে জমিদার মিরাজ আলী হচ্ছি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অভিনয়ে মগ্ন হলাম আমার দল বহুবচনে। ‘নেকড়ে’ নাটকে জোতদার, ‘যন্ত্রতন্ত্র’তে স্বৈরাচারী, ‘ইডিপাস’-এ ক্রেয়ন, ‘তিন পয়সার পালা’য় রজভ আলী, ‘স্বদেশী’তে স্যার উইলিয়াম, ‘স্বপ্নলোকের চাবি’তে ‘অশরীরী আত্মা’, ‘দায়বদ্ধ’তে ট্রাক চালক গগন আর ‘দেবী’ নাটকে মিসির আলীসহ কত নাটকে যে অভিনয় করেছি সব আর মনে পড়ছে না। তবে যে চরিত্র পেয়েছি সেটিকেই ভালোবেসেছি।
বাংলানিউজ: মিসির আলী চরিত্রটি নিয়ে বলুন।
তৌফিকুর: মিসির আলী হুমায়ুন আহমেদের সৃষ্টি এমন এক চরিত্র যাকে যে কোনো পোশাকে, যে কোনো স্থানে, যে কোনো সমাজে জীবন্ত করে তুলে ধরা যায়। অভিনেতা হিসেবে মিসির আলী চরিত্র পাওয়া আনন্দের। কিন্তু অভিনয় শেষে আরও কিছু করতে না পারার অতৃপ্তি বেদনার। এই আনন্দ-বেদনার, আলো-আঁধারি অভিনয় জীবন নিয়ে ভালোই আছি। বলে রাখি যে, আমার পাশে স্ত্রী শারমিনা তৌফিক না থাকলে অভিনয় করা বুঝি হতোই না!
বাংলাদেশ সময়: ১৫৫৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৫, ২০১৫
এসও/জেএইচ