শুদ্ধ সংগীতসুধায় মনপ্রাণ উজাড় করে রাখতে তৈরি হচ্ছেন সংগীতপিপাসু মানুষ। বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সংগীত উৎসব শুরু হলো বলে! পাঁচ রাতের কোন দিন প্রিয় শিল্পীর পরিবেশনা থাকছে, সেই হিসেব কষে রেখেছেন কেউ কেউ।
ওস্তাদ জাকির হোসেন (তবলা)
তিনি কথা বলেন আঙুলে! মানে ডুগি-তবলার টোকায়। শৈশব থেকে তবলা বাজানোয় অসামান্য দক্ষতা অর্জন করেন। খুব অল্প সময়ে সবার কাছে ‘শিশু বিস্ময়’ হিসেবে আবির্ভূত হন। মাত্র ১২ বছর বয়সে এক অনুষ্ঠানে তবলা বাজানোর নিমন্ত্রণ পান। ১৯ বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। তখনই শুরু হয় তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার। বছরে দেড়শ’টি কনসার্টে যোগ দেওয়ার রেকর্ডও আছে তার। তিনি ওস্তাদ আল্লারাখার সুযোগ্য সন্তান ওস্তাদ জাকির হোসেন।
ওস্তাদ জাকির হোসেনের জন্ম ১৯৫১ সালে, মুম্বাইয়ে। বাবার আল্লারাখার পথেই হেঁটেছেন তিনি। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই শিল্পী বেশিরভাগ সময় যুক্তরাষ্ট্রে কাটিয়েছেন। পড়াশোনা করেন মাহিম সেন্ট মাইকেল হাইস্কুলে, এরপর সেন্ট জেভিয়ার্স মুম্বাই থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন। বাজিয়েছেন জর্জ হ্যারিসনের মতো বিখ্যাত শিল্পীর সঙ্গে। মাঝে মধ্যে ভারতে এসেছেন, করেছেন চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনার কাজ। ৬৪ বছর বয়সী এই শিল্পী শখের বসে মাঝে মধ্যে অভিনয় করেন। সাঁই পরাঞ্জপের 'সাজ' (১৯৯৮) ছবিতে তাকে দেখা গেছে যন্ত্রশিল্পী হিসেবেই। তার সহশিল্পী ছিলেন অরুণা ইরানি ও শাবানা আজমি। এ ছাড়াও জেমস আইভরির 'হিট অ্যান্ড ডাস্ট' (১৯৮৩) ছবিতেও অভিনয় করেন জাকির হোসেন। ২০০৬ সালে পেয়েছেন গ্র্যামি পুরস্কার। তার উল্লেখযোগ্য সাউন্ডট্র্যাকের মধ্যে আছে ‘সাজ’ (১৯৯৮), ‘ওয়ান ডলার কারি’ (২০০৩), ‘মি. অ্যান্ড মিসেস. আইয়ার’ (২০০২), ‘দ্য মিস্টিক ম্যাজিউর’ (২০০১), ‘বানাপ্রাসথাম’ (১৯৯৯), ‘লিটল বুদ্ধা’ (১৯৯৩), ‘ইন কাস্টডি’ (১৯৯৩), ‘অ্যাপোক্যালিপস নাউ’ (১৯৭৯) প্রভৃতি।
জাকির হোসেন সময় পেলেই বাংলাদেশে এসেছেন। এবার উৎসবের চতুর্থ দিনে (৩০ নভেম্বর) থাকছে তার একক তবলা পরিবেশনা। ওইদিনের শেষ আকর্ষণ তিনি। এদিন মঞ্চে নিজেদের পরিবেশনা নিয়ে হাজির হবেন- গুরু রাজা ও রাধ রেড্ডি (কুচিপুডি নৃত্য), গণেশ ও কুমারেশ রাজাগোপালন (কর্ণাটক বেহালা), পণ্ডিত শিবকুমার শর্মা (সন্তুর), পণ্ডিত তেজেন্দনারায়ণ মজুমদার (সরোদ) ও পণ্ডিত উল্লাস কশলকর (খেয়াল)।
পণ্ডিত শিবকুমার শর্মা (সন্তুর)
সন্তুর বাদক হিসেবে দেশ-বিদেশে পেয়েছেন বিপুল খ্যাতি। শিবকুমার শর্মার জন্ম ১৯৩৮ সালে, ভারতের জম্মু-কাশ্মিরে। তার বাবা উমা দত্ত শর্মা ছিলেন সংগীতশিল্পী। শিবকুমার শর্মার বয়স যখন মাত্র পাঁচ বছর, তখন থেকেই তার কণ্ঠসংগীত ও তবলার তালিম শুরু হয়। এদিকে উমা দত্ত ততদিনে সন্তুর নিয়ে ব্যাপক গবেষণা শুরু করেছেন। সন্তুরে উচ্চাঙ্গসংগীত বাজানোর কথা প্রথম তিনিই মাথায় আনেন। পুত্র শিবকুমারকে তিনি সন্তুর শেখানো শুরু করেন।
পিতার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেন শিবকুমার শর্মা। তিনিই সন্তুরকে একটি উচ্চাঙ্গ যন্ত্র হিসেবে জনপ্রিয় করেন। বিভিন্ন আসরে তিনি সন্তুরে প্রাচীন রাগ-রাগিনী বাজিয়ে দর্শক-শ্রোতাদের মুগ্ধ করেন। বংশীবাদক পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার সঙ্গে যুগলবন্দি বাজিয়ে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। বাংলাদেশেও তিনি একাধিকবার এসেছেন, তার সুরে মুগ্ধ করেছেন এ দেশের সুরপিপাসু মানুষকে।
বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সংগীত উৎসবের চতুর্থ দিনে (৩০ নভেম্বর) থাকছে শিবকুমার শর্মার একক সন্তুর পরিবেশনা। এদিন তার আগে-পরে মঞ্চ আলোকিত করবেন গুরু রাজা ও রাধ রেড্ডি (কুচিপুডি নৃত্য), গণেশ ও কুমারেশ রাজাগোপালন (কর্ণাটক বেহালা), পণ্ডিত তেজেন্দনারায়ণ মজুমদার (সরোদ), পণ্ডিত উল্লাস কশলকর (খেয়াল)ও ওস্তাদ জাকির হোসেন (তবলা)।
ওস্তাদ রশিদ খান (খেয়াল)
উপমহাদেশের প্রখ্যাত খেয়াল গাইয়ে ওস্তাদ রশিদ খান। তার জন্ম ১৯৬৬ সালে। পিতামহ রামপুর সাহাসওয়ান ঘরানার সুরস্রষ্টা ওস্তাদ নিসার হোসেন খানের হাত ধরে দীর্ঘ সময়ের তালিম তাকে ধীরে ধীরে করে তুলেছে এই ঘরানার এক দক্ষ শিল্পী। তার নিজস্ব ঘরানার প্রতি অনুগত থেকে তিনি অন্যান্য ঘরানার প্রতিও আকৃষ্ট, যা তার সংগীত পরিবেশনায় সুস্পষ্ট। পদ্মশ্রীসহ বহু পুরস্কারে ভূষিত এই শিল্পী আবারও এসেছেন বাংলাদেশে।
উৎসবের পঞ্চম দিনে (১ ডিসেম্বর) থাকছেন রশিদ খান। তার আগে-পরে মঞ্চ মাতাবেন- গীতবিতান বাংলাদেশ (ধামার), অনিমেষ বিজয় চৌধুরী ও তার দল, বিদুষী আলারমেল ভাল্লি (ভরতনাট্যম), ইরশাদ খান (সুরবাহার), সামিহান কশলকর (খেয়াল), ওস্তাদ সুজাত খান (সেতার) ও পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়া (বাঁশি)।
পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়া (বাঁশি)
উপমহাদেশের বিখ্যাত বাঁশিবাদক ও সংগীতশিল্পী পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া। ১৯৩৮ সালের ১ জুলাই ভারতের এলাহাবাদ রাজ্যে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন কুস্তিগির। মাত্র ৬ বছর বয়সে মাকে হারান তিনি। এরপর বাবা তাকে কুস্তিবিদ্যা চর্চা করার জন্য আখাদায় ভর্তি করিয়ে দেন। কিন্তু ছেলের মন ছিল সংগীতে, তা বাবা জানতেন না। তাই বাবাকে লুকিয়েই বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে সংগীতচর্চা করতেন চৌরাসিয়া।
এদিকে ভালো না লাগলেও বাবার মন রক্ষার্থে আখাদায় নিয়মিত কুস্তিবিদ্যারও চর্চা করতেন হরিপ্রসাদ। কিন্তু এখন বাবার ওপর অনেক বেশি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। কারণ তখন কুস্তিবিদ্যা চর্চার কারণে আজও নিরলস বাঁশি ও সংগীতচর্চা করতে পারেন তিনি।
১৫ বছর বয়সে হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া প্রতিবেশী পণ্ডিত রাজারামের কাছ থেকে ভোকাল সংগীতে শিক্ষাগ্রহণ করেন। এরপর বেনারসে পণ্ডিত ভোলানাথ প্রসন্নের ছায়ায় দীর্ঘ আট বছর বাঁশি বাজানো শেখেন। ১৯৫৭ সালে তিনি অল ইন্ডিয়া রেডিও, কুট্টাক ও ওড়িষ্যাতে একই সঙ্গে কম্পোজার ও পারফর্মার হিসেবে কাজ করেন। ধ্রুপদি সংগীতে পারদর্শী হলেও তিনি শিবকুমারের সঙ্গে যৌথভাবে বলিউডের হিন্দি ছবির সংগীত পরিচালক হিসেবেও প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। বাঁশি বাদনের মাধ্যমে দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে গেছেন বিদেশেও। বাঁশি তাকে এনে দিয়েছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি দু’বার বিয়ে করেন, এখন তিন পুত্র সন্তানের জনক।
উৎসবের পঞ্চম দিনে (১ ডিসেম্বর) থাকছে হরিপ্রসাদের বাঁশিবাদন। তার আগে মঞ্চে আসবেন গীতবিতান বাংলাদেশ (ধামার), অনিমেষ বিজয় চৌধুরী ও তার দল, বিদুষী আলারমেল ভাল্লি (ভরতনাট্যম), ইরশাদ খান (সুরবাহার), সামিহান কশলকর (খেয়াল), ওস্তাদ সুজাত খান (সেতার) ও ওস্তাদ রশিদ খান (খেয়াল)।
বিদুষী বোম্বে জয়শ্রী (কর্ণাটক সংগীত)
বিদুষী বোম্বে জয়শ্রী কলকাতার মেয়ে। সংগীত পরিবারে তার জন্ম। বেড়ে উঠেছেন মুম্বাইয়ে। কর্ণাটক সংগীতে ছেলেবেলায় দীক্ষা নেন মা শীতা ও বাবা এনএন সুব্রামানিয়ামের কাছে। হিন্দুস্তানি সংগীতেও চর্চা করেছেন। ছয় বছর ধরে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন অজয় পহাঙ্করের তত্ত্বাবধানে।
বোম্বে জয়শ্রী প্রথম কনসার্ট করেন ১৯৯২ সালে। গেয়েছেন বিভিন্ন উৎসবে। ভারত-বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের কুড়িটিরও বেশি দেশ ঘুরেছেন সংগীত নিয়ে। অস্কারজয়ী ছবি ‘লাইফ অব পাই’র ঘুমপাড়ানি গানটি তারই গাওয়া। এজন্য ২০১২ সালে অস্কারে মনোনয়ন পান তিনি।
উৎসবের প্রথম দিনে (২৭ নভেম্বর) কর্ণাটক সংগীত শোনাবেন বোম্বে জয়শ্রী। এদিন আরও থাকছে পল্লবী ড্যান্স সেন্টার (ভরতনাট্যম), বেঙ্গল পরম্পরা (তবলা কীর্তন), জয়াপ্রদা রামমূর্তি (কর্ণাটক বাঁশি), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগ (ধ্রুপদ), রাহুল শর্মা (সন্তুর), পণ্ডিত কুশল দাস (সেতার) ও কোশিকী চক্রবর্তীর (খেয়াল) পরিবেশনা।
বিদুষী শুভা মুডগাল (খেয়াল)
হিন্দুস্তানি ধ্রপদী সংগীত, খেয়াল, ঠুমরি, দাদরা ও পপসংগীতে সুনাম কুড়িয়েছেন বিদুষী শুভা মুডগাল। স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি ‘অমৃত বীজ’-এর সংগীত পরিচালনার জন্য ১৯৯৬ সালে পেয়েছেন ভারতের জাতীয় পুরস্কার। ১৯৫৯ সালে এলাহাবাদের এক বিদ্যান পরিবারে জন্মেছেন শুভা। সংগীতে তার যাত্রা শুরু ১৯৮০ সালে। খেয়াল ও ঠুমরি প্রিয় হলেও সংগীতের অন্যান্য শাখায় রয়েছে বিচরণ। তিনি স্টার প্লাসের ধারাবাহিক ‘দিয়া অউর বাতি হাম’-এর শিরোনাম গান গেয়েছেন কৈলাশ খেরের সঙ্গে।
বিদুষী শুভা মুডগাল খেয়াল শোনাবেন উৎসবের তৃতীয় দিন (২৯ নভেম্বর)। এদিন তার পাশাপাশি অন্যান্য পরিবেশনা নিয়ে হাজির থাকবেন ওয়ার্দা রিহাব ও তার দল (মণিপুরী নৃত্য), ওস্তাদ ওয়াসিফ ডাগর (ধ্রুপদ), ইউসুফ খান (সরোদ), ড. এন রেজা (বেহালা), বিদুষী শ্রুতি সাদোলিকর (খেয়াল) ও গুরু কড়াইকুডি মানি (মৃদঙ্গ)।
কৌশিকী চক্রবর্তী (খেয়াল)
নবীন শিল্পী কৌশিকী চক্রবর্তী। উচ্চাঙ্গ সংগীতে মাতাচ্ছেন উপমহাদেশ। জন্ম ভারতের কলকাতায়, ১৯৮০ সালে। চন্দনা চক্রবর্তী ও বিখ্যাত উচ্চাঙ্গ সংগীতশিল্পী অজয় চক্রবর্তীর কন্যা তিনি। সাত বছর বয়সে পন্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের সংগীতশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তালিম নেন। পরে আইসিটি সংগীত গবেষণা একাডেমীতে গান শেখেন। স্কুলজীবন শেষ করেন কলকাতার পাথা ভবন বিদ্যালয় থেকে।
২০০২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক স্বীকৃত যোগময় দেবী কলেজ থেকে দর্শনে প্রথম শ্রেণীতে স্নাতক অর্জন করেন কৌশিকী। ভারতের দোভার লেন মিউজিক কনফারেন্স, দ্য আইটিসি সংগীত সম্মেলন, ক্যালিফোর্নিয়ার দ্য স্প্রিং ফেস্টিভাল অব মিউজিক ও লস এঞ্জেলেসের পরম্পরা অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন বড় কনসার্টে অংশ নেন তিনি। বিয়ে করেছেন পার্থসারথী দেশিকানকে। তাদের একমাত্র পুত্রসন্তানের নাম রিশিথ।
উৎসবের প্রথম দিনে (২৭ নভেম্বর) খেয়াল শোনাবেন কৌশিকী। এদিন আরও থাকছে পল্লবী ড্যান্স সেন্টার (ভরতনাট্যম), বেঙ্গল পরম্পরা (তবলা কীর্তন), জয়াপ্রদা রামমূর্তি (কর্ণাটক বাঁশি), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগ (ধ্রুপদ), রাহুল শর্মা (সন্তুর), পণ্ডিত কুশল দাস (সেতার) ও বিদুষী বোম্বে জয়শ্রীর (কর্ণাটক সংগীত) পরিবেশনা।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৩৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৪, ২০১৫
এসও/জেএইচ