ড. ইনামুল হক, মামুনুর রশীদের মতো বর্ষীয়ান শিল্পীদেরকেও রাস্তায় নামতে হয় অস্তিত্বের প্রয়োজনে! ২০১৫ সালের শেষ দিকে এসে কারওয়ানবাজারের রাস্তায় ঘটে যাওয়া এ ঘটনা টিভি নাটকে হয়তো কোনো বাঁকবদল এনে দিতে পারেনি, তবে এটা আশংকার বিষয় নিঃসন্দেহে। তারা নিজেরাই একেকটি প্রতিষ্ঠান।
কারণ একটাই, একটু ঘুরিয়ে বললে, ‘আমাদেরকে বাঁচাও’। এই ‘আমরা’ আসলে দুই বা ততোধিক ব্যক্তিবিশেষ নয়, গোটা টিভি অঙ্গন। টিভি মিডিয়া যে ভালো নেই, জ্বরে ভুগছে, সঙ্গে ভয়ানক কাশি, নিঃশ্বাস এই আছে এই নেই অবস্থা- এটা সবাই জানেন। যারা জানেন না এতোকিছু, তারা টের পান রিমোট চাপলেই। ভালো নাটক নেই, ভালো অনুষ্ঠান নেই, চ্যানেল এতোগুলো, কিন্তু নির্দিষ্টকরণ বলে কিছু নেই। সবই চলছে গৎবাঁধা মুখস্ত ফর্ম্যাটে। স্বাভাবিকভাবেই দর্শক তাই দেখছে না। দেখতে চাইছে না আসলে। ঝুঁকছে বিদেশি চ্যানেলে। বিশেষ করে যারা নাটকের দর্শক, তাদের একটা বড় অংশ ‘নেশাগ্রস্ত’ ভারতীয় সিরিয়ালে।
এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে আন্দোলনকারী শিল্পীদের দাবি অনেক। তবে সব দাবিকে একমোড়কে প্যাঁচিয়ে দিলে একটা পয়েন্টই দাঁড়াবে- ভারতীয় চ্যানেল ঠেকাও। তারা আমাদের স্পন্সর নিয়ে যাচ্ছে, দর্শক তো নিয়ে গেছে অনেক আগেই, সুকৌশলে তাদের সংস্কৃতি ঢুকিয়ে দিচ্ছে একটু একটু করে গল্প বলায়-নির্মাণে-অভিনয়ে। তাই আন্দোলনকারীদের যুক্তি, ‘তাদেরকে ঠেকাতে না পারলে আমাদের নিজস্বতা টিকবে না। ’ ফলে তারা অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে দাবি তুলেছেন- পদক্ষেপ নিতে হবে।
কী পদক্ষেপ? ‘বিদেশী টিভি চ্যানেলে বাংলাদেশি পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রচার বন্ধ, ক্যাবলে বাংলাদেশি চ্যানেলগুলোর সিরিয়াল ১ থেকে ২৫-এর মধ্যে নিয়ে আসা, আর সবচেয়ে ভালো হয় বিদেশি (ভারতীয়) চ্যানেলগুলো বন্ধ করে দিতে পারলে!’ আন্দোলনকারীদের ভাষায়, তাতে লাভ অনেক। বিজ্ঞাপনদাতারা বাধ্য হয়ে দেশীয় চ্যানেলেই আগ্রহী হবেন, ভারতীয় সিরিয়ালের প্রভাবে বাংলাদেশি নাটক যে লোকে দেখে না, বা কম দেখে, অথবা দেখতে চায় না- সেটা ইতিবাচক জায়গায় ফিরবে। তাতে চ্যানেল মালিক-শিল্পী-নির্মাতা-লগ্নিকারী সবারই লাভ।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বিদেশি চ্যানেল বন্ধের এই যে দাবি তাদের, সেটা কতোখানি যৌক্তিক? অথবা যদি বন্ধ হয়ও, দেশীয় ছোটপর্দার শুকনো নদীতে জোয়ার বইবে ফের? প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে একটু পেছনে হাঁটতে হবে- ছোটপর্দায় কেনো এমন করুণ পরিস্থিতি তৈরি হলো? অপরিকল্পিত হারে টিভি চ্যানেল বৃদ্ধি তো অবশ্যই একটি কারণ। বেশিরভাগ চ্যানেলেরই কোনো নির্দিষ্ট পরিচিতি নেই। সবক’টাতেই ঘণ্টায় ঘণ্টায় খবর চলে, ব্রেকিং নিউজ, নাটক, টক শো, ফোনো লাইভ, স্ক্রল, আর বিজ্ঞাপন! অনুষ্ঠান দিয়ে চ্যানেল চেনার উপায়টা খুব কম!
অনুষ্ঠানের ধরণও দায়ী। দেশীয় টিভি চ্যানেলগুলোর বেশিরভাগ বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানই বিদেশি, বিশেষ করে ভারতীয় চ্যানেলের কপি। একটা ‘হা-শো’ করতে গেলে ‘মীরাক্কেল’-এর হুবহু স্ক্রিপ্ট অনুসরণ না করলে যেন চলছে না! একটা ‘দিদি নাম্বার ওয়ান’কে অনুসরণ করে হচ্ছে ‘আজকের অনন্যা’। আর নির্মাণে-অভিনয়ে-গল্পে ভারতীয় টিভি সিরিয়ালের অন্ধ অনুকরণ করে ধারাবাহিক নির্মাণের প্রসঙ্গ তো রয়েছেই। ফলে, মৌলিকত্বের স্থান কিন্তু নেই আসলে।
আরেকটি বিষয় মহামারী আকার নিয়েছে গত কয়েক বছরে- এজেন্সি কালচার। নাটক নির্মাণ করে সেটি দেখানোর সুযোগ ভয়াবহ আকারে কমে এসেছে ইদানীং। এনটিভি ও মাছরাঙা এ দু’টো চ্যানেল বাদে দেখানোর সুযোগ নেই একেবারেই। বাদবাকি চ্যানেলগুলোকে গিলে খেয়েছে এজেন্সি। তারা সময় কিনে নিচ্ছে। তারাই গল্প, নির্মাতা এমনকি শিল্পীও বেছে নিচ্ছে। ইচ্ছেমতো অনুষ্ঠান-নাটক নির্মাণ করে চালিয়ে দিচ্ছে। টিভি চ্যানেলে প্রিভিউ কমিটি বলে যেটা ছিলো, সেটা বিলুপ্তপ্রায়। নির্মাতাদের তাই ধরণার জায়গা এখন এজেন্সিই। তাদের আঙুলের ইশারা অনুযায়ীই নাটক হচ্ছে, অনুষ্ঠান হচ্ছে। মুনাফা এখানে মুখ্য, দর্শকচাহিদা-শিল্প একেবারেই গৌণ।
এই যখন অবস্থা, তখন শুধু বিদেশি চ্যানেল বন্ধ করে, দর্শকদের দেশীয় চ্যানেলে বাধ্য করার চেষ্টা আসলে আদৌ ফলপ্রসূ হবে কি-না, সেটা নিয়েই বড় প্রশ্ন উঠেছে। এ যেন ‘কোটা’ সিস্টেমেই ভরসা রাখা! যেটা জরুরি সেটা হচ্ছে, মান বাড়ানো। কেন দর্শক দেশীয় চ্যানেল দেখছে না, কেন স্পন্সররা দৌড়ে যাচ্ছে ভারতীয় জি বাংলা কিংবা স্টার জলসায়- তার কারণ যেমন নির্ণয় করা গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি প্রতিকারের উপায়ও। সেদিকে মনোযোগ না দিয়ে, শুধু রাস্তায় নেমে ‘বন্ধ করো, বন্ধ করো’ গলা ফাটিয়ে আদৌ কোনো স্থায়ী সমাধান আসবে কি-না, সংশয় প্রকাশ করেছেন অনেকেই।
ড. ইনামুল হক-মামুনুর রশীদরা মাঠে নেমে হতাশার কথা শোনান- কেউ চায় না। তেমনি কাম্য নয়, সংস্কৃতি রক্ষা করতে গিয়ে তাকে অন্ধকূপে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টাও। সাধারণ দর্শকদের প্রতিক্রিয়ায় একটা কথাই ঘুরেফিরে আসছে তাই- অনুষ্ঠানের মান বাড়ান, দর্শকও বাড়বে আবার। এতেই হয়তো পাওয়া যাবে সব সমস্যার সমাধান!
বাংলাদেশ সময়: ১৬১২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০২, ২০১৫
কেবিএন/জেএইচ