সাদিকা স্বর্ণার সঙ্গে আড্ডায় বসলে বিষয়ের অভাব পড়ে না। তার অভিনয় তো আছেই, আঁকাআঁকি, লেখালেখিও।
বাংলানিউজ : ফরমাল ইন্টারভিউ না, আজকে আড্ডা হোক। আপনার সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিলো ‘সাতটি তারার তিমির’-এর সংবাদ সম্মেলনে।
সাদিকা স্বর্ণা : সাতটি তারার তিমিরেই প্রথম নাকি? ও আচ্ছা।
বাংলানিউজ : কেমন আছেন বলেন?
স্বর্ণা : ভা-লো।
[‘লো’র ওপর ইচ্ছাকৃত বাড়তি জোর দিয়ে, খানিকটা টেনে, ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বললেন তিনি। ]
বাংলানিউজ : আপনি ‘প্রাচ্যনাট’-এর সঙ্গে তো অনেক আগে থেকে, নাকি?
স্বর্ণা : হ্যাঁ। অনেক বাচ্চাকাল থেকে।
বাংলানিউজ : কী করতেন ‘বাচ্চাকাল’ থেকে?
স্বর্ণা : বাচ্চাকাল থেকে কী করতাম? আমি খুব দুষ্টু ছিলাম। মাকে জ্বালাতন করতাম। ঘর ভর্তি ছবি এঁকে রাখতাম। এসব কাণ্ড করতাম। আর একটু কিছু হলেই চোখে পানি আনতে পারতাম। খালামনি এটা নিয়ে কবিতাও বানিয়ে ফেলেছিলো। আমি চাইলাম, আর চোখে পানি চলে এলো! প্রধানত ছবি আঁকার দিকে ঝোঁক ছিলো।
বাংলানিউজ : এ তো একেবারেই ছোটোবেলায় চলে গেলেন। ভালোই হলো। আমি জানতে চাচ্ছি- যখন প্রাচ্যনাটে যোগ দিলেন। তখন তো বোধহয় চারুকলায়ও ভর্তি হননি...
স্বর্ণা : না, চারুকলায় মাত্র ঢুকেছি। প্রাচ্যনাটে যখন কোর্স করি, মনে আছে, নিজে নিজে আমার জীবনের প্রথম ও শেষ ‘খ্যাপ’টি মেরেছিলাম। যেটার মাধ্যমে আমি কিছু টাকা পাই। ওই টাকা দিয়ে কোর্সটা করেছিলাম। সাল বলতে পারবো না। সাল জিজ্ঞেস করবেন না।
[‘খ্যাপ’ বলে একটি টার্ম চালু আছে বিভিন্ন পেশায়। ফরমালি যেটা ‘ফ্রিল্যান্সিং’-এর মতো। স্বর্ণার ‘খ্যাপ’টি কীসের ছিলো সেটা জিজ্ঞেস করা হয়নি। আঁকাআঁকি-ডিজাইন সংক্রান্তই কিছু হবে, খুব সম্ভবত। ]
বাংলানিউজ : সাল জিজ্ঞেস করলে, বয়স বেরিয়ে আসার সম্ভাবনা আছে বলে?
স্বর্ণা : বয়সের জন্য না। মানে, এমনিতেই আমার দিন-তারিখ মনে থাকে না। তখন কোর্সটা এতো আগ্রহ নিয়ে করেছি! মনে আছে, শুধুমাত্র একটা ক্লাস মিস করেছিলাম। এতো মনোযোগ দিয়ে করেছি যে, প্রথম হয়েছিলাম। তারপরে আমাদের শো হলো, ইন্টারভিউ দিলাম (প্রাচ্যনাটের সদস্য হওয়ার জন্য), ইন্টারভিউতে চর্যাপদ পড়তে দিলো। সবার তো দাঁত-মুখ খুলে আসছে (পড়তে গিয়ে)! কিন্তু আমার পরিবারের অনেকেই বাংলার শিক্ষক তো, খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। এরপর আমাকে প্রাচ্যনাটের সদস্য হিসেবে নেওয়া হলো।
বাংলানিউজ : কোথায় থাকতেন তখন?
স্বর্ণা : শামসুন্নাহার হলে।
বাংলানিউজ : শামসুন্নাহার টু শিল্পকলা? রিহার্সেল কি শিল্পকলায় হতো?
স্বর্ণা : না। তখন হতো দিলু রোডে। এখন সেটা কাঁটাবনে চলে এসেছে।
বাংলানিউজ : তখন শো করেছিলেন কোনটা?
স্বর্ণা : আমি যোগ দেওয়ার সময় ‘রাজা এবং অন্যান্য’র কাজ ধরা হচ্ছিলো। ‘রাজা’র জন্য তো অনেকদিন ধরে, অনেক রকম প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। আমরা প্রচুর গ্রুমিং করেছি। পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গেই ছিলাম।
বাংলানিউজ : স্বর্ণা, এই যে আপনি অভিনয় করছেন, আঁকছেন, লেখালেখিও; সবই তো প্রকাশের জায়গা থেকে। মানে, আপনি সবসময় কিছু বলতে চান- কিছু বলার আছে বলেই শিল্প মাধ্যমে জড়িয়ে গেলেন। তো, আপনার ভাবনায় কী আসে মানুষ নিয়ে-সমাজ নিয়ে-নিজেকে নিয়ে?
স্বর্ণা : আমার কাছে মনে হয়, হিউম্যান বিং ইটসেলফ ইজ অ্যান আর্ট। আমি কয়েকদিন আগে স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম, মাই লাইফ ইজ অ্যান আর্ট। আমার যে জার্নি, আমার জীবনের যে জার্নি, আমার অভিজ্ঞতা- এ সবকিছুই আসলে কী কাজ করবো না করবো; তার ওপর প্রভাব ফেলবে। আমি সব সময় খুব এক্সপ্রেসিভ। ভেতরে কিছু চেপে রাখতে পারি না। মন খারাপ থাকলে সেটা চেহারায় দেখা যায়।
বাংলানিউজ : মানে একটা স্বচ্ছ কাঁচের বাক্স...
স্বর্ণা : মানে আমাকে দেখা যায়। বোঝা যায়। তো, আমার কাছে মনে হয়েছে যে, প্রকাশ করতে ভালো লাগে। আমি কবি না, কিন্তু ধরো, কিছু একটা বলতে ইচ্ছা করছে। কোনো একটা ভাবনা। সেটা কীভাবে বললে রিলিফ লাগবে, বুঝি না। কিন্তু সেটা প্রকাশ না করা পর্যন্ত অস্থির লাগে। বুঝেছো? মানে এখানে এক ধরণের জার্নি আছে। একটা দহনের জায়গা আছে। ফাইনালি ধরো লিখলাম, এমনভাবে শব্দ চয়ন করলাম, কবিতা তো শুধু বর্ণনা না, শব্দচয়নেরও ব্যাপার আছে। এমনভাবে শব্দচয়ন করলাম, যেটা করার পরে আমার রিলিফ হলো, মনে হলো, হ্যাঁ, যেভাবে ফিল করছি, লেখায় হয়তো সেটা ধরতে পারলাম। ওইরকম যখন আমি কোনো ক্যারেক্টার প্লে করি, যখন অন্য চরিত্র হয়ে উঠি ওই চরিত্রের সুখ-দুঃখ-বেদনা এবং ধরণ, সবকিছুকে ধারণ করে। এখানে এক ধরণের খেলা আছে, শিল্প তো মূলত এই খেলাটাই।
[পরবর্তীতে ‘রেকর্ডেড’ আড্ডা শেষ হওয়ার পরে, স্বর্ণা তার কিছু লেখা পড়ে শোনাবেন। নিজের লেখা কিছু ইংরেজি-বাংলা কবিতা। বলা দরকার, আঁকাআঁকির মতো-অভিনয়ের মতো তার লেখার হাতও ভালো। ]
চারুকলায় ভর্তি হওয়ার আগে আমার এক ধরণের দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো, চারুকলায় পড়তে পড়তে আমার দেখা তো বদলে গেছে। থিয়েটার করতে করতে আরও বদলেছে। [মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে] তুমি এটাকে একটা মোবাইলই দেখছো শুধু, আমি হয়তো এখানে আরও অনেক কিছু খুঁজে বের করবো। হয়তো একটা মানুষের একাকীত্ব খুঁজে বের করবো। এই যে দেখার বদলটা, এগুলো তো কাজ করতে করতেই।
আবার আমাদের এখানে তো ভিন্ন জার্নিও আছে। এক ধরণের স্ট্রাগলের গল্প আছে। তো পুরোটাই একটা গেম।
বাংলানিউজ : এই যে বললেন ‘একটা গেম’। খেলার জন্য তো প্রস্তুতির দরকার পড়ে। আলাদা করে কোনো প্রস্তুতি ছিলো আপনার?
স্বর্ণা : বিষয়টি আলাদাভাবে ভাবিনি। প্রস্তুতি বলো, বা যেটাই বলো, এটা অটোমেটিক্যালি হয়েছে। মানে এমন না যে, আমি থিয়েটার করতে ঢুকেছি কোনো সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে। বিষয়টা হচ্ছে, ভেতর থেকে আমি তাড়না বোধ করেছি যে, আই ওয়ান্ট টু ডু দ্যাট, তো আমি করছি। মানে আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, মনের বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু করতে পারি না।
বাংলানিউজ : আপনি ঢাকায় আসলেন কবে?
স্বর্ণা : আমি ঢাকাতেই বড় হয়েছি। বড় খালামনির কাছে থেকেছি এখানে।
বাংলানিউজ : থাকে না মানুষের? একটা গ্রামের বাড়ি? জন্মস্থানে বেড়ে ওঠার স্মৃতি?
স্বর্ণা : আমার স্মৃতিতে এ রকম কিছু নেই। যেটা হয়েছে, আমার বাবা-মা বরং শিফট করে কাপ্তাইয়ের দিকে চলে গেছে। আমি ঢাকাতেই রয়ে গেছি।
বাংলানিউজ : ছবি আঁকছেন এখন?
স্বর্ণা : যদিও আমার সাবজেক্ট হচ্ছে গ্রাফিক্স ডিজাইন, কিন্তু আমি এটাকে পেশা হিসেবে নিইনি। ছবি আঁকি, নিজের জন্য আঁকি। যেহেতু অভিনয়ের জন্য দৌড়ের ওপর থাকতে হয় সময়, আঁকাআঁকিতে গ্যাপ তৈরি হয়েছে। একটা স্টুডিও দেয়ার পরিকল্পনা করছি। এখন তো স্কেচ করি...
বাংলানিউজ : আপনার আঁকা কোনো স্কেচ আছে সঙ্গে?
স্বর্ণা : সঙ্গে? আমার খাতায় আছে কিছু। ফেসবুকে আছে। আর আমি তো মোবাইলে অ্যাপস ডাউনলোড করে ওখানেই ছবি আঁকি।
[মোবাইলে মনোযোগি হয়ে পড়লেন স্বর্ণা। হয়তো স্কেচ দেখাতে চাইছিলেন! আঁতকে উঠলেন খানিকটা- ‘আমাকে ফেসবুকে দেখাচ্ছে কেন? ডি-অ্যাক্টিভেট করে দিয়েছি তো। এই, দেখো না, কী করা যায়!’]
বাংলানিউজ : ডি-অ্যাক্টিভেট কেন করেছিলেন?
স্বর্ণা : ফেসবুকটা নিজেদের মধ্যেই রাখতে চাই। ফ্যানপেজ করার পরিকল্পনা করছি। সবাই ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে! জীবন দিয়ে দেবো- এইসব। আমি আবার লিখি যে, জীবন দরকার নাই। জীবন দিয়ে আমি কী করবো? পাগল হয়ে গেছে! এ রকম প্রচুর আছে তো। আমার আসলে ওই লাইক কমেন্ট গোণা- এক ধরণের প্রতিযোগিতামূলক ব্যাপার আছে না? ওসব পছন্দ না। ফেসবুক অনেক সময় নিয়ে নেয়।
বাংলানিউজ : দিব্যি তো মঞ্চে কাজ করছিলেন, আঁকছিলেন। লাক্স-চ্যানেল আই সুপারস্টার প্রতিযোগিতায় গেলেন কী মনে করে?
স্বর্ণা : কিছু মনে করে যাইনি। অনলাইনে ঘোরাঘুরি করেছিলাম। বিজ্ঞাপন দেখে, ফরম পূরণ করেছি। পাঠিয়েছি, সেটা গেছে কিনা- জানতামও না। তারপর তো ভুলেই গিয়েছিলাম। হঠাৎ করে একদিন দেখি এসএমএস এলো। তারপর যেটা মনে হলো, ওকে লেটস সি, লেটস হ্যাভ ফান। ইন্টারভিউতে ডাকলো। গেলাম। মেকাপ দিলো। আমার খুব বিরক্ত লাগলো। মুখ ধুয়ে আসলাম। কথাবার্তা হলো। তারপর মনে হলো, গ্রুমিং তো ভালো। গ্রুমিং করতে মজা লাগবে। আসলে পুরো প্রতিযোগিতাটি আমি অনেক উপভোগ করেছি। এমন কোনো টেনশন ছিলো না তো যে, আমাকে সুপারস্টার হতেই হবে।
বাংলানিউজ : আপনার নাটকের তালিকা পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, কিছু নির্দিষ্ট পরিচালকের সঙ্গেই ঘুরে ফিরে কাজ করছেন, যারা প্রধানত থিয়েটারকেন্দ্রীক। কেন বলেন তো?
স্বর্ণা : আমার যেহেতু বাইরে মুভ করার অথবা হ্যাংআউট করার অভ্যাস কম, সেজন্য হয়তো এ রকম। আমার ক্ষেত্রে যেটা হয়, বন্ধুবান্ধব বা পরিচিতদের মধ্যেই কাজ করা হয়। আমি আবার নির্দিষ্ট কিছু লোকজনের সঙ্গে চলাফেরা করতে পছন্দ করি তো! তবে যদি কেউ বলে, যদি চরিত্র পছন্দ হয়, করবো না কেন!
[এই সূত্র ধরে কাজ নিয়ে তার সন্তুষ্টির প্রসঙ্গও আসে। স্বর্ণাই তোলেন। সঙ্গে এটাও বলে দেন যে, দেখা গেলো, কোনো দৃশ্যে ঠিকঠাক অভিনয় করতে পারলেন না। অথবা যেটা হওয়া উচিত বলে মনে হয়েছিলো তার, পারলেন না ফুটিয়ে তুলতে। তখন তার নাকি খুব আফসোস লাগে। ঘরে ফিরে কান্নাকাটিও করেন!]
বাংলানিউজ : আপনাকে দেখে মনে হয় না যে, কান্নাকাটি করতে পারেন!
স্বর্ণা : এটাই হচ্ছে আমার প্লাস পয়েন্ট। আমি এখন তো অনেক ঠিক হয়েছি। আগে হতো যে, ধরো, মেকাপরুমে বসে কেউ গসিপ করছে- এটা শুনলেও কান্না পেতো। আপনার কেন মনে হয় আমি কান্নাকাটি করতে পারি না?
বাংলানিউজ : কেন মনে হয় জানি না। তবে আপনাকে দেখলে মনে হয়, ভীষণ রাফ, জেদি।
স্বর্ণা : রাফ লাগে? কেন?
বাংলানিউজ : রাগী মনে হয়, কিছু উল্টাপাল্টা বললে, থাপ্পড় একটা বসিয়ে দেন। এ রকম নাকি?
স্বর্ণা : কাইন্ড অব সত্যি!
বাংলানিউজ : ভয় পায় আপনাকে লোকজন?
স্বর্ণা : ভয় পায়। তবে একটু মিশলে আর পায় না। বুঝে ফেলে, আমি কতোটা ওয়ার্ম! বন্ধু হিসেবে আমি খুব ভালো। নিজের ঢোল নিজে পেটাচ্ছি!
আর বাংলাদেশে একটা গৎবাঁধা ধারণা আছে না? একটু ওয়েস্টার্ন ড্রেস-গেটাপ দেখলে মনে করে খুব বোল্ড?
বাংলানিউজ : ওই জায়গা থেকে না। রাফ মানে বোল্ড বোঝাইনি। খুব বেশি মায়াবী না আরকি!
স্বর্ণা : মায়ার কী দরকার? এটা অনেক বাজে জিনিস।
বাংলানিউজ : কিন্তু এটারও তো দরকার আছে, ধরেন, একটা ইমেজ আপনি দেখলেন, একটা মোমেন্ট, ক্যারেক্টার। তো ওটার মায়ায় না পড়লে, সৃষ্টি কীভাবে সম্ভব?
স্বর্ণা : দেখে মায়ায় পড়ার চেয়ে, মিশে মায়ায় পড়া ভালো না?
বাংলাদেশ সময়: ১৬৫০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৬, ২০১৫
কেবিএন/