চট্টগ্রাম থেকে : বন্দরনগরীর নন্দনকাননের প্রথম গলিটা মূল সড়ক থেকে একটু নেমে গেছে। ঢালুমতো সেই গলির ডানে লোকনাথ ধাম, পালভবন কিংবা পাহাড়িকা স্কুল।
মন্দির এলাকা বলে, সন্ধ্যা পেরিয়েছে বলে ধূপের গন্ধ বেশ প্রকট। পূজারী কিংবা দর্শনার্থীর ভিড়ও চোখে পড়ার মতো। ঢাক ও অন্যান্য যন্ত্রানুষঙ্গ ঢুকে পড়ছে কানে, মাইকেও কিছু একটা বেজে চলার আওয়াজ, ঠিক স্পষ্ট নয়, এ অবস্থাকে যথার্থ কোলাহল বলা যায়। সেই সন্ধ্যায় গন্তব্য যখন পায়ের কাছে, সব কোলাহল থেমে যায়। জীর্ণ একটা দুয়ার, মনে হলো একটা দিগন্ত এবার খুলে যাবে চোখের সামনে। হলোও তা-ই। শেফালী ঘোষের চিরপুরাতন থাকার ঘরটিতে প্রবেশের অনুমতি মিললো, আহা…।
তিনি নেই। এই না থাকা ঠিক শুন্যতায় পূর্ণ নয়। কারণ তিনি আছেন, তার সান্নিধ্য টের পাওয়া যায়, চাইলে বা না চাইলেও। তার সুর বলয় তৈরি করে। কর্ণফুলী কিংবা সমুদ্রতীরের হাওয়া নিয়ে সেই সুর ছোটে, আঞ্চলিকতা ছাপিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। এসব কারণে তার না থাকা প্রমাণ করা বেশ কঠিন। তাই, চট্টগ্রাম শহরের ছোট্ট একটি ঘরে শেফালী ঘোষ আছেন কি নেই, নতুন গান বাঁধছেন কি-না, মঞ্চ মাতাচ্ছেন কি-না সেটা প্রাসঙ্গিক নয়। প্রসঙ্গ তবে কী?
মূল রাস্তার কাছ থেকে এতোদূর নিয়ে এসেছেন কিংবদন্তি শেফালী ঘোষের একমাত্র ছেলে ছোটন। মোবাইল ফোনে তিনিই নির্দেশনা দিচ্ছিলেন। তার কথা ছিলো বের হয়ে যাওয়ার, পূর্ব নির্ধারিত কাজে। কিন্তু সুদূর ঢাকা থেকে আসার ব্যাপারটিকে ছোট করে দেখতে পারেননি তিনি। তার ওপর মায়ের প্রসঙ্গ…!
দুই তলার ফাউন্ডেশন হলে কী হবে, একতলায় কান্ত। এই ভবনের দুটি কক্ষের আকার কয়েক মুঠো হবে। এই কয়েক মুঠো জায়গাতেই দীর্ঘদিন ধরে ‘আছেন’ শেফালী ঘোষ। ‘আছেন’ এই অর্থে যে, দুটো ঘরের দেয়ালজুড়েই তার সব ছবি, তার ব্যবহৃত পুরনো মডেলের সোফাসেট, তাক, তার ক্রেস্ট ও অন্যান্য আসবাবপত্র। স্মৃতিধন্য এসব জিনিসে ধুলো জমেছে, প্রাচীন একটা গন্ধও টের পাওয়া যায়। যে কোনো নতুন অতিথির কাছে এ গন্ধ উটকো লাগতে পারে। প্রকৃতপক্ষে, ছোটনের কাছে এটা স্বাভাবিক, কেননা এতে জড়িয়ে আছে তার মায়ের স্পর্শ ও ঘ্রাণ। ‘সামান্য’ অতিথির জন্য তিনি এই গন্ধ দূর করতে নারাজ। কথা বলে এমনটাই মনে হলো।
ছোটন মায়ের ঘর ঘুরিয়ে দেখাতে দেখাতে বলেছিলেন, ‘এটা আমাদের স্থায়ী বাড়ি। এখানে, এই ঘরেই মা থাকতেন। এখান থেকেই দেশ-বিদেশের শোতে অংশ নিতেন। স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে এখন আমি থাকি। ’
ছোটন জানান, তার মায়ের শিল্পী হয়ে ওঠার পেছনে বাবার অবদান অনেক বেশি। ১৯ বছর বয়সে শেফালী ঘোষ গান শেখার জন্য চট্টগ্রাম শহরে আসেন। সেখানে তার পরিচয় ঘটে সংগীতানুরাগী ননী গোপাল দত্তর সঙ্গে। পরে পরিচয়ের সূত্র ধরে তাদের বিয়ে। ছোটন জানান, চট্টগ্রামের মানুষের ভালোবাসার কারণেই শেফালী ঘোষ এই স্থান ত্যাগ করেননি। ঢাকামুখী হওয়ারও ইচ্ছে ছিলো না তার।
ছোটনের পুরো নাম সুকণ্ঠ দত্ত ছোটন। তিনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করছেন, আছে ব্যবসাও। চট্টগ্রাম বেতার ও টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত শিল্পী। তার গানের ধারাও মায়ের মতোই, আঞ্চলিক ভাষার গান। এ ছাড়া অন্যান্য গানও করেন তিনি।
ছোটন বলেন, ‘আমার মা সবার জন্য গান করতেন। গান গেয়ে রোজগার করার নেশা তার ছিলো না। লোকজন ভালোবেসে, সম্মান করে যা দিতো মা তা-ই নিতেন। টাকা-পয়সা নিয়ে কারও সঙ্গে তার সমস্যা হতো না। বড় কিংবা ছোট অনুষ্ঠান- সবখানে মা আন্তরিকতার সঙ্গে গান গাইতেন। ’
স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের এই শিল্পীর জনপ্রিয় গানের সংখ্যা অনেক। এর মধ্যে কালজয় করেছে অধিকাংশ। ‘ওরে সাম্পানওয়ালা’, ‘যদি সুন্দর একখান মুখ পাইতাম’, ‘ছোড ছোড ঢেউ তুলি’ প্রভৃতি গানগুলোর কথা না বললেই নয়। সংগীতে বিশেষ অবদানের জন্য তাকে নানা পুরস্কার ও সম্মাননা দেওয়া হয়। একুশে পদকও পেয়েছিলেন শেফালী ঘোষ।
কিংবদন্তি শেফালী ঘোষের এই উত্তরসুরী মনে করেন তার মা যথার্থ সম্মান নিয়েই পৃথিবীর মায়া ছেড়েছেন। আজকাল গুণীর কদর কমে গেলেও মাকে সেই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়নি। তার মা যেমন গুণের অধিকারী ছিলেন, মানুষের ভালোবাসায় জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সে সুখ উপভোগ করেছিলেন তিনি। ছোটনের কাছেও বিষয়টা বেশ সুখকর লাগে।
শেফালীর সঙ্গে দ্বৈত গান করতেন শ্যামসুন্দর বৈঞ্চব। এই জুটি এখন কিংবদন্তি। দীর্ঘদিন তারা আসর মাতিয়েছেন। ছোটনের হিসেব মতে, ১৯৭৬ সাল থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত তারা একসঙ্গে গেয়েছিলেন। শ্যামসুন্দর মৃত্যুবরণ করেন ২০০১ সালে। এই যুগলের ‘নাইয়র যাইয়ো বাপর বাড়ি আইসো তাড়াতাড়ি, ‘নাইয়র নিবা নিবা করি’, ‘আদর করি কতা কইলা’সহ অনেক গান এখনও মানুষের মুখে মুখে ফেরে।
পাঁচ দশকের সংগীতজীবনে শেফালী ঘোষের অ্যালবামের সঠিক হিসেব জানেন না ছোটন। তার ধারণা, এককের সংখ্যা হতে পারে ৫০-৭০টি। দ্বৈত হবে ১০-১২টি। এ ছাড়া বিভিন্ন মিশ্র অ্যালবামেও গেয়েছেন তিনি।
শেফালীর অধিকাংশ গান লিখেছেন আব্দুল গফুর হালি, সৈয়দ মহিউদ্দিন ও এম এন আক্তার। এই তালিকায় আরও আছেন রমেশ শীল, এয়াকুব আলী, অচিন্ত্য কুমার চক্রবর্তী, চিরঞ্জিত দাশ, মোহাম্মদ নাসির, মোহন লাল দাশ প্রমুখ।
এই বাসায় গীতিকবি ও কবিয়ালদের নিয়মিত আসা-যাওয়া ছিলো। স্বামী ও গীতিকারদের নিয়ে এভাবেই নতুন গান বাঁধা হতো। প্রিয় সঙ্গিনী চলে যাওয়ার দুই বছর পর ২০০৮ সালের ২৮ মে পৃথিবী ছেড়ে চলে যান ননী গোপাল দত্ত।
কর্ণফুলীপাড়ের দুই তীরের আনন্দ-বেদনার কথা নিয়ে সুর তুলেছিল শেফালী ঘোষের কণ্ঠ। ১৯৪১ সালের ১০ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ২০০৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর তার দেহাবসান ঘটে। অসুস্থ হওয়ার পর কলকাতার অ্যাপোলো হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিলো। সেখানে চার-পাঁচ মাস ছিলেন তিনি। পরে অবশ্য চট্টগ্রাম মেডিকেলে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে মারা যান জনপ্রিয় এই গায়িকা। তার মরদেহ দাহ করা হয় জন্মস্থান বোয়ালখালী উপজেলার কানুনগোপাড়ায়। বাবা ও স্বামীর এলাকাতেই চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন শেফালী।
ছোটন দীর্ঘদিন ধরে গান করলেও অ্যালবাম প্রকাশ করেননি। নানা কারণে সেটা সম্ভব হয়নি। ছোটনের ইচ্ছে মায়ের গানগুলো নতুন সংগীতায়োজনে কণ্ঠে তুলবেন। একটি অ্যালবামে মায়ের গানের পাশাপাশি রাখবেন নিজের মৌলিক গান। তার বিশ্বাস- এই স্বপ্ন সত্যি হবে। এদিকে তার অজানা নয় যে, শেফালী ঘোষের গান থেকে নানা উপায়ে অনেকে ব্যবসা করছেন। তার সন্তান হিসেবে সেখান থেকে কিছু পাবেন- এমনটা আশা নয় তার। কোনো সহৃদয়বান ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ছোটনের অ্যালবাম প্রকাশে এগিয়ে এলেই তার কৃতজ্ঞতার শেষ থাকবে না। শেফালী ঘোষের সন্তান আর যাই হোক, লোভ সংবরণ করতে শিখেছেন…
বাংলাদেশ সময়: ১৫২৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৯, ২০১৫
এসও/জেএইচ
** চট্টগ্রামে ভেঙে ফেলা হচ্ছে আরও দুটি প্রেক্ষাগৃহ
** বন্দরনগরীতে এখনও মুনমুন