ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

তারার ফুল

চট্টগ্রাম থেকে সোমেশ্বর অলি

চট্টগ্রামে ব্যান্ডসংগীতের চিত্র আশা জাগানিয়া

সোমেশ্বর অলি, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩১৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১০, ২০১৬
চট্টগ্রামে ব্যান্ডসংগীতের চিত্র আশা জাগানিয়া (বাঁ থেকে) সাসটেইন ও নাটাই ব্যান্ডের সদস্যরা/ছবি : নূর/বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চট্টগ্রাম থেকে : ব্যান্ডসংগীতের ঊর্বর ভূমি চট্টগ্রাম। বাংলাদেশের সমবয়সী চট্টগ্রামের ব্যান্ডসংগীত।

এটা সবাই স্বীকার করেন যে, দেশের সেরা দলগুলোর বেশিরভাগই জন্ম বা বেড়ে ওঠা চট্টগ্রামে। এদিক দিয়ে বন্দরনগরীকে বলা হয় ব্যান্ডসংগীতের সুতিকাগার।

বাংলাদেশের সংগীতাঙ্গনে কুমার বিশ্বজিৎ, তপন চৌধুরী, নকীব খান, আইয়ুব বাচ্চু, জেমস, পার্থ বড়ুয়ার প্রত্যেকেরই উত্থান চট্টগ্রাম থেকেই। তাদের মধ্যে বেশিরভাগেই জন্ম চট্টগ্রামেই। এ ছাড়া ব্যান্ডসংগীতের তারকা নাসিম আলী খান, সুব্রত বড়ুয়া রনি, মোহাম্মদ আলী, আহমেদ, নেওয়াজ, পিলু খান, এসআই টুটুলও চট্টগ্রাম থেকেই জনপ্রিয়তা পেয়েছেন ব্যান্ডসংগীতকে।

১৯৭৫-এর পর চট্টগ্রামে আত্মপ্রকাশ করা কিছু ব্যান্ডের মধ্যে ফিলিংস, রানার সেভেন্টি ফাইভ, রিদম সেভেন্টি সেভেন, জ্যামিং, নাট ক্র্যাকার্স, রিসেন্ট রোল উল্লেখযোগ্য। আশি ও নব্বই দশকে চট্টগ্রামের ব্যান্ডসংগীতে নতুন এক জোয়ার আসে। সে জোয়ারে তৈরি হয় অনেক ব্যান্ড। ম্যাসেজ, জেনারেশন, ব্লু হরনেট, রিদম, রেইনবো, স্পার্ক, রুটস, ব্লুবার্ডস, সাসটেইন, ডিউড্রপস, সফটটাচ, রিভার্ব, ইন চিটাগাং, এ-৭৭, রিভাব, নভেম্বর ইলেভেন ইত্যাদি।

চট্টগ্রামের উল্লেখযোগ্য ব্যান্ডগুলো হলো- এ-৯৯ বি.হর্নেট, অরণ্য, আর্তনাদ, অন্থিম, অন্বেষণ, আমুস, এ্যামিথিউর, বিন্দু, ব্লাক হার্ট, বর্ণ, ব্লাক ওয়ারিয়র্স, ব্লু বার্ডস, ব্লাক সিন, বিস্বর্গ, বনসাই, কেকটাস, কেসকাড, ড্রীমস, দ্রাঘিমা, দিশারী, দ্বিতীয় পৃষ্ঠা, ডিবাইন, ডেজার্ট, ইস্কপ, আর্থ, এনার্জি সোল, ফেরারী, ফেইথ, প্রিডম, জিপসী, হেভেন, হার্ট রিলেশান, ইন চিটাগাং, জোবিয়াল, এলএসবি, লাইনার্স, মিলেনিয়াম, মুখোশ, মেনগ্রোব, নেক্সাস, নভেম্বর-১১, অব ট্রাক, অসময়, প্লেজার রক, প্রান্তর, রিভার্ব, রিসেন্ট, রোজেস, স্পাইডার, স্পার্ক, সিক্রোসেন্ট, স্টীলার, সাসটেইন, শরঋতু, সোলডার্স, স্বপ্ন, স্ট্রীম, সোয়েভ, সরগম, স্লাক, স্যাডো, স্কাই টাচ, সীমান্তহীন, রুটস, রাইজিং ফোর্স, রেইনড্রপস, রিয়ার, রেইন, রেইন ম্যাকার, রেসিটাল, রেবিলিয়াস, ট্রিও, ট্রাংগেল, তৃষ্ণার্ত, তেপান্তর, টানট্রিক, তিরন্দাজ, টিউন, উইংস, ওয়্যারিওর, উইলস, ওয়্যারফেয়ার, ওয়াইআরবি, ফিউচার, নাটাই ইত্যাদি।

চট্টগ্রামে এখন কয়েক ঘরানার কয়েক ডজন ব্যান্ড কাজ করছে। চট্টগ্রাম মিউজিক্যাল ব্যান্ড অ্যাসোসিয়েশনের (সিএমবিএ) তালিকা অনুযায়ী, এখানে দু’শতাধিক ব্যান্ড রয়েছে। এর মধ্যে অধিকাংশই সক্রিয়। নিয়মিত স্টেজ শোতে অংশ নেয় তারা। চট্টগ্রামের ব্যান্ডের যে সুনাম ছিলো সেটা ধরে রেখেছে সমকালীন দলগুলো।

পশ্চিমা ও বলিউড ছবির গানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে ব্যান্ডগুলোর কার্যক্রম। শুরুতে সামাজিক বাধা-বিপত্তি ডিঙাতে হলেও এখন যুদ্ধ করতে হচ্ছে বিদেশি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে। সব মিলিয়ে চট্টগ্রামে ব্যান্ডসংগীতের চিত্রটা ঠিক সুখকর নয়, তবে আশা জাগানিয়া।

সমকালীন ব্যান্ডগুলো নিয়ে বাংলানিউজে প্রতিবেদন হবে না- এটা তো পারে না। স্বল্প সময়ের নোটিশে শিল্পীদের সাড়াও মিলল। তাদের আন্তরিক অংশগ্রহণে উঠে এসেছে এ সময়ের চিত্র। আড্ডায় যোগ দিয়েছে চট্টগ্রামের জনপ্রিয় দুটি গানের দল। তারা হলো সাসটেইন ও নাটাই। সাসটেইন একটু পুরনো দল, নাটাই একদম তারুণ্যদীপ্ত…

সাসটেইন
সাসটেইনের যাত্রা শুরু বেশ আগে, ১৯৯৬ সালে। ভাঙা গড়ার মধ্য দিয়ে তারা এগিয়েছে। ২০০৫ সাল থেকে তারা পুরোদমে আবার শুরু করে। মেলো রক ঘরানার ব্যান্ড সাসটেইন। তাদের প্রিয় বা আদর্শ ব্যান্ড হচ্ছে সোলস, এলআরবি, ওয়ারফেইজ, অর্থহীন, মাইলস প্রভৃতি। গানের এই দলটি চায় দেশের শীর্ষস্থান দখল করতে। তবে তারা কখনও চট্টগ্রাম ছাড়তে চায় না।

ব্যান্ডের নাম সাসটেইন কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে সদস্যরা জানান, সবাই নিজেদের জায়গা থেকে টিকে থাকার লড়াইটা করছে। গানের এই দলটিও এর ব্যতিক্রম নয়। এ কারণেই নামটি দেওয়া। আর কে না জানে, টিকে থাকলেই কেবল জয় করা সম্ভব।
 
চট্টগ্রামে ব্যান্ডসংগীত চর্চা নিয়ে সাসটেইনের অভিমত, বেশকিছু ব্যান্ড ভালো করছে, জনপ্রিয়ও হচ্ছে। তাদের উদ্যম চোখে পড়ার মতো। তবে পৃষ্ঠপোষকতা বাড়লে ব্যান্ডের গানে নতুন করে জোয়ার আসবে। ঢাকার ব্যান্ডগুলো এদিক দিয়ে এগিয়ে আছে বলেই তারা মনে করেন।
 
নিয়মিত মঞ্চ পরিবেশনার পাশাপাশি সাসটেইন বিভিন্ন টেলিভিশনে সরাসরি সংগীত পরিবেশন করছে। এর মধ্যে একুশে টিভি, আরটিভি ও এসএ টিভিতে বাজিয়েছে, গেয়েছে। এ যাত্রা অব্যাহত থাকবে বলে তারা মনে করেন।  

‘পবিত্র প্রেম’ সাসটেইনের অভিষেক অ্যালবাম। ঢাকার ওয়ার্ল্ড মিউজিক থেকে এটা বের হয় ২০০৪ সালে। চট্টগ্রামে থেকেও দলটি ঢাকায় অ্যালবাম বের করার বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবেই দেখছে। এরপর সাউন্ডটেক থেকে বের হয় দ্বিতীয় অ্যালবাম ‘একাত্তর’। ২০০৯ সালে আসে তাদের সবশেষ অ্যালবাম ‘রহস্য’। এটা বের করে ফাহিম মিউজিক। তারা এখন পর্যন্ত তিনটি অ্যালবাম প্রকাশ করেছে। সাসটেইনের কয়েকটি গানের ভিডিওচিত্র দেখা যাচ্ছে ইউটিউবে।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, ব্যান্ডের সদস্যরা মিলে অভিনয়ও করেছেন একটি নাটকে। শখের বশে হলেও তাদের উদ্দেশ্য ছিলো পরিস্কার। কী সেটা? সদস্যরা জানান, ব্যান্ডের ভাঙন, আচমকা শো বাতিল হয়ে যাওয়া, ব্যান্ড দুনিয়ার রাজনীতি প্রভৃতি বিষয়গুলো তারা তুলে এনেছেন সেই নাটকে। নিজেদের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনারই নাট্যরূপ ছিলো নাটকটি। সাসটেইন মনে করে, একটি বেসরকারি টিভিতে প্রচারিত নাটকটি নতুন ব্যান্ডের জন্য একটি সুন্দর বার্তা। এ থেকে তারা উপকৃত হতে পারবে।

সাসটেইন-এর লাইনআপ: আলমগীর (বেজ গিটার), সোহান (লিড গিটার), রানা (কিবোর্ড),আরশাদ (ড্রামস), ইমরান ও রাসেল (ভোকাল)।

নাটাই
সুরে ও গানে মাটির গন্ধ ধরে রাখতে চায় নাটাই। ব্যান্ডের নামকরণে তেমন শব্দই নির্বাচন করেছেন সবাই মিলে। নতুন গানের দল হলেও অভিজ্ঞতায় অনেকদূর এগিয়েছেন তারা। মঞ্চ মাতাতে তাদের জুড়ি নেই। নাটাই মনে করে, ব্যান্ডসংগীতের চর্চা এখন অনেকটা সহজতর। কারণ আগের প্রজন্ম এই পথটা অনেকদূর এগিয়ে দিয়েছেন। এখন ওই ধরনের প্রতিবন্ধকতা না থাকলেও সংকট আছে, অন্যখানে। ২০০০ সাল থেকে যে ব্যান্ডসংগীতে ধস নেমেছে সেটা মেনে নিয়েই উত্তরণের পথ খুঁজছে সবাই। এখন অবশ্য পরিস্থিতি এতোটা খারাপ নয়।

সংগীতচর্চার পাশাপাশি পড়াশোনা ও চাকরি সামলাতে হয় নাটাইওয়ালাদের। আছে পরিবারের চাপও। ব্যান্ডের অধিকাংশ সদস্য ছাত্র, কেউ কেউ চাকরি ও ব্যবসায় যুক্ত। শুধু ব্যান্ডের রোজগার দিয়ে চলা সম্ভব নয়। নির্দিষ্ট রোজগারের রাস্তাটা তাই খোলা রাখতে হয়। তাদের কাছে, অনেকটা ঘরের খেয়ে মোষ তাড়ানোর আরেক নাম ব্যান্ড করা!

নাটাইয়ের আনুষ্ঠানিক যাত্রা ১৯ জুলাই, ২০১২। সাউদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি কনসার্টের মাধ্যমে নাটাই আত্মপ্রকাশ করে। ১৯ জুলাই তারিখটি তাদের জন্য আনন্দের হলেও, এর সঙ্গে মিশে আছে একটি জাতীয় বিয়োগান্তক ঘটনা। কিংবদন্তি লেখক হুমায়ূন আহমেদ ওই বছরের ওইদিনেই মৃত্যুবরণ করেন।
ফোক ফিউশন ঘরানার গান করছে নাটাই। এর মধ্যে দুটি সিঙ্গেলস বাজারে ছেড়েছে তারা। দুটিই মৌলিক গান। এগুলোর অডিও রয়েছে ইউটিউবে। অন্যদিকে ভিডিওর জন্য পরিকল্পনা ও অভিষেক অ্যালবামের কাজও এগিয়ে নিচ্ছেন তারা।

নাটাই দেশের বিভিন্ন স্থানে গান করে। গত বছরের ১৬ অক্টোবর ছিলো তাদের জন্য স্মরণীয় দিন। চট্টগ্রাম চারুকলা ইনস্টিটিউটে সেই পরিবেশনা তাদের মনে থাকবে। এখানে গান করেছিলো তাদের প্রিয় ব্যান্ড লালন। এ ছাড়া ২০১৪ সালে টি-টোয়েন্টির কাউন্টডাউন শোতেও অংশ নিয়েছে নাটাই। এটাও তাদের জন্য উল্লেখযোগ্য ঘটনা।

নাটাই গান নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পৌঁছতে চায়, ছড়িয়ে দিতে চায় বাংলার সুর। সাম্প্রতিক সময়ে চিরকুটের পরিবেশনা তাদের ভালো লাগে। এই দলটির এগিয়ে চলা তাদের অনুপ্রাণিত করে। অন্যদিকে লালন ব্যান্ড তো আছেই। এদিকে সাসটেইন ব্যান্ডের মতো নাটাইও চট্টগ্রামেই থাকতে চায়। কর্ণফুলীর পাড়ে থেকেই তারা দেখিয়ে দিতে চায় রাজধানী ও বিশ্ববাসীকে। সাসটেইন ও নাটাইয়ের জয় হোক।

নাটাই-এর লাইনআপ: রানা (কিবোর্ড),পারভেজ (লিড গিটার), নাহিদ (বেজ গিটার), রাজু (ড্রামস), মুন্না ও আল তুষি (ভোকাল)।   

বাংলাদেশ সময়: ১৩১২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১০, ২০১৬
এসও/জেএইচ

** শেফালী ঘোষের ভিটেমাটি ঘুরে
** চট্টগ্রামে ভেঙে ফেলা হচ্ছে আরও দুটি প্রেক্ষাগৃহ
** বন্দরনগরীতে এখনও মুনমুন

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

তারার ফুল এর সর্বশেষ