ফুলবাড়িয়া (ময়মনসিংহ) থেকে ফিরে : সিনেমা হলের টিকিটের মূল্য সাধারণ ২০ টাকা আর ডিসি ৪০ টাকা। কাউন্টার বন্ধ।
তার ঠিক ডান পাশের একটি দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। ওই দরজার উপরে লেখা ‘মহিলাদের প্রবেশ পথ। ’
তবে ওইখানটায় ঢুকতে পারেন পুরুষরাও! এজন্য অবশ্য গুণতে হয় মাত্র দেড়শ’ কী দুইশ’ টাকা। সেখানে দু’টি বেঞ্চ পাতা। এর ঠিক সামনেই আলাদা পার্টিশনের দু’টি কক্ষের দরজাও বাইরে থেকে আটকানো।
কৌশল করে সেখানে গিয়ে উঁকি দিতেই ঘুটঘুটে অন্ধকারে বোরকা পরিহিত দু’নারী দর্শকের জড়োসড়ো উপস্থিতি টের পাওয়া গেলো। কিছু জিজ্ঞাসা করতেই যেন ভ্যাঁবাচ্যাকা খেলেন। পাশের কেবিনে পা রাখতেই চোখের পলকে চম্পট দিলেন।
বয়স্ক লাইটম্যান চানু মিয়া এগিয়ে এসে জানান, সিনেমার বিরতি চলছে। এ দু’দর্শক আগের শোও দেখেছেন। এ কারণেই হয়তো চলে গেছেন ! তবে সিনেমা হলের ঠিক পাশের হোটেল কর্মচারী গাজী কালু পুরো বিষয়ে নজর রাখছিলেন।
আগ বাড়িয়ে এগিয়ে কালবিলম্ব না করে ক্ষোভ মিশ্রিত কন্ঠে বললেন, ‘কে বললো তারা দর্শক। ওরা অভদ্র মেয়ে মানুষ। অনৈতিক কর্মকাণ্ড করে ওরা যুব সমাজ নষ্ট করছে। ’
বৃহস্পতিবার (১১ ফেব্রুয়ারি) ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার অন্তর সিনেমা হলে বিকেল সাড়ে ৪ টার দৃশ্যপট ছিল এমনই। একই রকম দৃশ্য পরদিন শুক্রবারও (১২ ফেব্রুয়ারি)।
এ সিনেমা হলে প্রদর্শিত হচ্ছে প্রায় এক যুগ আগের আলেকজান্ডার-শাপলা-অমিত হাসান অভিনীত রগরগে অশ্লীল সিনেমা ‘ওরা গাদ্দার। ’ আর এ হলের ওইসব কক্ষে ঘুঁটঘুঁটে অন্ধকারে চলছে অনৈতিক বাণিজ্য।
স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রায় বছর তিনেক ধরে এ সিনেমা হল ‘নিরাপদ’ জায়গা হয়ে উঠেছে বটে। নিত্যদিন দুপুর থেকে বিকেল অবধি এখানে রাখঢাক না করেই চলে ভদ্রবেশী-ছদ্মবেশীদের মহড়া।
সিনেমার আড়ালে অবৈধ কার্যকলাপ করে চুটিয়ে ব্যবসা করছেন হল মালিক বানু। মাঝে মধ্যে স্থানীয় প্রশাসন অভিযান চালালেও ক’দিন বিরতির পর আবারো পুরনো স্টাইলেই চলে এমন কারবার।
এক সময় দেশের সিনেমা হলগুলোতে ছিল দর্শক উপচানো ভিড়। গ্রামগঞ্জের সাধারণ নারীরাও সিনেমা দেখতে হলমুখী হতেন। সিনেমায় অশ্লীল যৌনতা ও অসুস্থ রুচির কারণে নারীরা এখন আর হলমুখী নন। ফলে শহরে কী গঞ্জের সিনেমা হলও আর দর্শক টানতে পারছে না।
সুস্থ রুচির দর্শকরাও সিনেমা হলের চৌকাঠ না মাড়ানোর ফলে দর্শকের অভাবে খাঁ খাঁ করছে সিনেমা হলগুলো। অন্তত ফুলবাড়িয়া উপজেলার অন্তর সিনেমা হলে গিয়ে এমন দর্শক খরাই চোখের সামনে ভেসে উঠলো।
এ সিনেমা হলের দু’তলা ও নীচতলার কক্ষগুলো ঘুরে ঘুরে দেখা গেলো, গোটা সিনেমা হলে বিকেলের এ শো’তে সাকুল্যে ১০ কী ১২ জন দর্শক। এর মধ্যে আবার কেউ কেউ বিনা টিকিটেই সিনেমা দেখছেন। তাদেরই একজন আফছর আলী।
থাকেন উপজেলা সদরেই। চল্লিশের কোটায় বয়স। সিনেমার বিরতির আগেই চাদর মুড়িয়ে হল থেকে বের হচ্ছিলেন। ‘সময় কাটাইবার লেইগ্যা হলে আইছি। ছবি দেখতে টিকিট লাগে না। ’
দর্শকশূন্যতার মাঝেও এতো বড় সিনেমা হল চলে কীভাবে প্রশ্ন করতেই নিচু স্বরে বললেন, ‘আরে সিনেমা হল তো শো (আইওয়াশ)। দেহেন না কয় বছর আগের সিনেমা চালাইতাছে। হল চলতাছে তো অন্য ব্যবসা দিয়া। ’ কথার ভেতর রহস্য রেখেই হল ছাড়লেন এ ক্ষুদে দোকানি।
মিনিট দশেক আগেও টিকিট কাউন্টারে বসে যিনি টিকিট বিক্রি করছিলেন তিনি ‘সাংবাদিক’ পরিচয় পেয়েই সটকে পড়লেন তিনি। একই কারণে অনেক খোঁজাখুঁজির পরেও আর দেখা মিললো না সেই বয়স্ক লাইটম্যান চানু মিয়ারও।
পুনরায় ‘মহিলাদের প্রবেশ পথ’ নামের ওই গোপন কক্ষগুলোতে গিয়ে আলো জ্বালিয়ে দেখা গেলো সেখানকার মেঝেতে পড়ে আছে সিগারেটের শেষ অংশ। পাশের করিডোরের ডাস্টবিনের মুখ সিনেমার পোস্টারে ঢেকে রাখা হয়েছে। পোস্টার সরাতেই চোখ ছানাবড়া। অস্তিত্ব মিললো নিরোধের প্যাকেট আর ইনজেকশনের।
আশরাফ উদ্দিন নামে স্থানীয় একজন এসে বললেন, ‘অনৈতিক বাণিজ্যের সঙ্গে এসব কক্ষে মাদকসেবীদেরও আসর বসে। প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করলেও কোন কাজ হয় না। তাই এসব আমাদের গা সওয়া হয়ে গেছে। ’
এখানে অবস্থানের সময়েই আরেকজনকে সঙ্গে নিয়ে এবার এলেন হল মালিকের ছেলে। নিজের নাম না বললেও তিনি দাবি করলেন, ‘তার বাবা বানু সিনেমা হল বন্ধ করে দেয়ার পক্ষে। কিন্তু এ হল বন্ধ করে দিলে হল কর্মচারীদের না খেয়ে মরতে হবে।
আর এ কারণেই কর্মচারীরা এমন অনৈতিক কর্মকাণ্ডের পথ বেছে নিয়েছেন। ’ এ ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে হলের বিপক্ষে না লেখারও অনুরোধ করেন তিনি।
স্থানীয় এ সিনেমা হলে এমন অরাজকতার বিষয়ে ফুলবাড়িয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রিফাত খান রাজিব বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমরা ক’দিন আগেও অভিযান চালিয়েছিলাম। এখনো যদি এসব চলে তবে অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে। ’
একই ব্যাপারে ফুলবাড়িয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বনানী বিশ্বাস বাংলানিউজকে বলেন, ‘একাধিকবার আমরা এ সিনেমা হলে অভিযান চালিয়ে জেল-জরিমানা করেছি। এবারো কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। ’
বাংলাদেশ সময়: ১৪০১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০১৬
জেডএম/