দেশীয় সংগীতাঙ্গনে আসিফ আকবরের উত্থান ও সাফল্য অনেকের কাছেই বিস্ময়। অপ্রত্যাশিত! যেন হুট করে কোত্থেকে লিকলিকে এক ছোঁকড়া এসে সব জয় করে ফেললেন! সেই ছোঁকড়াই দিনে দিনে হয়ে উঠলেন আধুনিক বাংলা গানের যুবরাজ।
২০০১ সালের কথা। বাজারে এলো ‘ও প্রিয়া তুমি কোথায়’। আসিফের প্রথম একক অ্যালবাম। ঘরে-বাইরে, গ্রামে-গঞ্জে, হাট-বাজারে যেখানে যাই ক্যাসেট প্লেয়ারে বাজতো এর গানগুলো। সবার মুখে মুখে ‘ও প্রিয়া তুমি কোথায়’। অডিও বাজারে ইতিহাস সৃষ্টিকারী অ্যালবাম বলা হয়ে থাকে এটাকেই।
অল্প সময়ে প্রেমে ব্যর্থ জাতির কাছে যেন আসিফের গানই হয়ে উঠলো বেদনা সংগীত! এসব গান শুনে শ্রোতারা যেমন কেঁদেছেন, তেমনি খুঁজে নিয়েছেন আশ্রয়। তার গানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই প্রজন্মের অসংখ্য তরুণের দুঃখ, যন্ত্রণা ও বেদনার গল্প। হোক প্রেমে ব্যর্থতার কথামালা, গানে গানে প্রেমের জয়গানই তো গেয়েছেন তিনি। এখনও মাঝে মাঝে তার পুরনো গানগুলো নাড়া দেয়। বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যা কিংবা একাকী গভীর রাতে তিনি ঠিকই হাজির হন শ্রোতার কানে কানে!
সবশ্রেণীর শ্রোতার জন্য গান করেছেন আসিফ। ভাবাতে চাননি কাউকে। তাই সহজবোধ্য গানই বেছেছেন বেশি। সহজ কথায় গাওয়া গানগুলোতে অনেকেই খুঁজে নিয়েছেন নিজের জীবনের গল্প। তার গান বুঝতে দার্শনিক হওয়া লাগে না। সেজন্যই তো তিনি আপামর জনসাধারণের গায়ক।
‘সাদামাটা’ তকমা লাগিয়ে আসিফের গানকে এড়িয়ে যেতে চাইলেও তার গায়কীকে তা করা যায় না! এমন কণ্ঠ আর ক’জনেরই বা আছে। তিনি কেনো বাংলাদেশের সংগীতাঙ্গনে আশীর্বাদ, তা ১৫ বছর ধরেই দেখা যাচ্ছে। যদিও দেশীয় সংগীতাঙ্গনের সোনালি সময়ের শেষভাগে পদার্পণ তার। অনেকে মনে করেন, এ গলাটা নব্বই দশকে খুব দরকার ছিলো। চলচ্চিত্রের গানেও দাপটের সঙ্গে বিচরণ করেছেন তিনি।
কারও মতে- ব্যান্ড, পপ, আধুনিক গান, ফোক গানের বাইরে দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আরও এক ঘরানার গান। সেটা হলো আসিফের গান। পাছে লোকের মুখের একঘেয়ে কথা আর বৈচিত্রহীন সুরের সমালোচনা তোয়াক্কা না করেই এগিয়েছেন তিনি। তার হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন অনেক সুরকার, গীতিকার, যন্ত্রশিল্পী।
প্রতিষ্ঠিত সংগীতশিল্পীরাও কাজে লাগিয়েছেন আসিফের গায়কীকে। প্রথম সারির প্রায় সব শিল্পীর সঙ্গেই তার দ্বৈত নতুবা মিশ্র অ্যালবাম বেরিয়েছে। অনেকে নিজের সুরেই গাইয়েছেন তাকে দিয়ে। ওপার বাংলার শিল্পীদের সঙ্গেও একই অ্যালবামে গেয়েছেন তিনি। এভাবে একে একে তার অজস্র জনপ্রিয় গানে সমৃদ্ধ হয়েছে দেশীয় গানের ভান্ডার।
প্রেম-প্রীতিই নয়, বিষয়ভিত্তিক আর সচেতনতা বৃদ্ধির বার্তাও ছড়িয়েছেন আসিফ। গানকেই হাতিয়ার করেছেন তিনি। ‘যুবতীর লাশ’ গানটার কথাই ধরুন না। সে হিন্দু না মুসলমান, সে বিতর্কে মেয়েটার লাশ পরিত্যক্তই পড়ে রইলো। ধর্মের আগে যে মানুষ পরিচয় মুখ্য, আসিফের কণ্ঠে সেই বার্তা তার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বাড়িয়ে দেয়।
আসিফের কণ্ঠে ‘বেশ বেশ বেশ সাবাশ বাংলাদেশ’ গানটি তো বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অলিখিত থিম সং হয়ে গেছে! এই গান তরুণ প্রজন্মকে উদ্দীপনা জোগায়, অনুপ্রাণিত করে। ‘সবার বাংলাদেশ’ গানে তিনি রূপসী বাংলার গুনগান গেয়েছেন। ‘লাল সবুজ’ ছবিতে তার কণ্ঠে ‘স্বাধীন দেশে উড়বে সে তো স্বাধীন পতাকা’ শোনা গর্বেরও।
শুধু গায়ক নন, আসিফ হলেন আপন আলোয় উজ্জ্বল অসাধারণ সব চিন্তাধারা ও মানসিকতার একজন ব্যক্তি। তিনি একই সঙ্গে উদার, অভিমানী, প্রতিবাদী, নির্ভীক, দেশপ্রেমিক। প্রতিবাদী বলেই উড়ো মেঘে লাগাম দিতে চেয়েছেন তিনি। অভিমানী বলেই জিতেও হেরে যেতে রাজি আছেন তিনি। মাঝে অভিমানে গান ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু অজস্র শ্রোতার ভালোবাসায় দূরে থাকতে পারেননি। ফিরে এসেছেন।
অডিও শিল্পে আগের সেই সোনালি দিন নেই। ফিতার ক্যাসেট প্রজন্মের শেষ বংশধর বলা চলে আসিফকেই! তার পরে আর কারও অ্যালবামই মুড়ির মতো এতো বিক্রি হয়নি। এরকম রমরমিয়ে চলতে দেখা যায়নি কারও গান। ক্যাসেটের যুগও আর ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই, তার সেই রেকর্ডও ভাঙা হবে না কারও!
গান প্রকাশের মাধ্যম ক্যাসেট থেকে সিডিতে, সিডি থেকে মোবাইলে রূপান্তর হলেও, আসিফ ঠিকই দ্যুতি ছড়িয়ে যাচ্ছেন। এই পথচলা আরও অনেক বছর থাকবে বলে মনে করেন শুভানুধ্যায়ীরা। গানের ব্যবসা এ দেশে হারিয়ে গেছে ঠিকই, কিন্তু তিনি ঠিকই নটআউট থেকে গেলেন সংগীতের মাঠে। হারিয়ে যাওয়ার সময় যিনি সঙ্গে নিতে বলেছেন, তাকে শ্রোতারা ফেরান কীভাবে!
আজ ২৫ মার্চ আসিফের ৪৫তম জন্মদিন। এদিনে ভক্তদের পক্ষ থেকে জন্মদিনের শুভেচ্ছায় সিক্ত হচ্ছেন, পাচ্ছেন অভিনন্দন। তাকে বাংলানিউজ পরিবারের পক্ষ থেকেও জন্মদিনের শুভেচ্ছা।
বাংলাদেশ সময়: ১৫০৭ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০১৬
জেএইচ