ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

তারার ফুল

‘শঙ্খচিল’ দুই দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি ছবি : প্রসেনজিৎ

জনি হক, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৩০ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৬, ২০১৬
‘শঙ্খচিল’ দুই দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি ছবি : প্রসেনজিৎ প্রসেনজিৎ-ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার লাইনটা ধরিয়ে দিলাম প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়কে- ৩৩ বছর কাটলো... রূপালি পর্দায় ৩৩ বছর কাটিয়ে দিলেন তিনি। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে ভারতের বাংলা ছবির শিল্পে রাজত্ব করেছেন, গত কয়েক বছর নিজেকে ভাঙচুর করছেন।

এর মধ্য দিয়ে এসেছে বাঁকবদল। সে ধারাবাহিকতায় নতুন সংযোজন ‘শঙ্খচিল’।  

গত ১৪ এপ্রিল বাংলা নববর্ষে দুই বাংলায় একসঙ্গে মুক্তি পেয়েছে গৌতম ঘোষ পরিচালিত যৌথ প্রযোজনার ছবিটি। এ উপলক্ষে ১২ এপ্রিল ঢাকায় এসেছিলেন প্রসেনজিৎ। সংবাদ সম্মেলন, মধ্যাহ্নভোজ ও ‘তৃতীয় মাত্রা’ অনুষ্ঠানের দৃশ্যধারণ শেষে বাংলানিউজের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বললেন তিনি।  
 
বাংলানিউজ : প্রসেনজিৎ নামটা তো হারিয়েই গেলো!
প্রসেনজিৎ :
তা বলতেই পারেন। আসলেই বুম্বাদার কাছে প্রসেনজিৎ নামটা অফ হয়ে গেছে!
 
বাংলানিউজ : এখন তো অনেক প্রচারণা করতে হয়, ক্লান্ত লাগে না?
প্রসেনজিৎ :
এই সময়ে এসে দুই দেশে একটি ছবিকে মুক্তি দেওয়াটা সহজ কাজ নয়। ফলে দৌড়-ভাগের মাত্রাটা বেশি বেড়ে গেছে আমার। দৌড়-ভাগ না করে উপায়ও নেই। নিজে প্রচারণা চালানোর পাশাপাশি প্রচারণা কেমন হচ্ছে তা দেখতে কাজ শেষে রাত্রি দুইটা অবধি রিমোটে চেপে ঘুরতে থাকি। বাংলাদেশি একটা চ্যানেলেও প্রচারণা দেখেছি।

বাংলানিউজ : কি বলেন! ওপার বাংলায় তো বাংলাদেশি টিভি চ্যানেল ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না বলে একটা কথা বহু বছর ধরেই শুনছি...
প্রসেনজিৎ:
না-না এরকম কোনো ব্যাপার নেই। শিলিগুড়িতে কিন্তু আপনাদের চ্যানেল চলে। আমি ঠিক সাতদিন আগে সেখানে ‘মহানায়ক’ সিরিয়ালের শুটিং করতে গিয়ে এটা দেখেছি। ‘শঙ্খচিল’-এর প্রচারণার চিত্র দেখতে গিয়ে বাংলাদেশি একটা চ্যানেল চোখে পড়েছে আমার। দুই বাংলাতেই চ্যানেল চালাতে এক ধরনের কারিগরি শর্তাদি আছে, আমি সেটা পুরোপুরি জানি না, ওই প্রক্রিয়া মেনে উদ্যোগ নিলে কোনো অসুবিধে নেই কিন্তু। এ ক্ষেত্রে চ্যানেল কর্তৃপক্ষকে লগ্নি করতে হবে। একসময় তো বিটিভি ও এটিএন নিয়মিত দেখতাম আমরা। টিভি চ্যানেল পৃথিবীর কোথাও কেউ আটকাতে পারবে না। এটা আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি।  

বাংলানিউজ : বাংলাদেশ নিয়ে কোন কথাটার পুনরাবৃত্তি করবেন?
প্রসেনজিৎ :
আমি বারবার বলেছি, হাজারবার বলেছি এবং হাজারবার বলে যাবো, আমার কাছে পশ্চিমবাংলা এবং এই বাংলাকে তফাত মনে হয় না। আগেরবার ‘মনের মানুষ’-এর কাজ করেছিলাম। ওই ছবির প্রায় একই টিম ‘শঙ্খচিল’-এ কাজ করেছে। গৌতমদা, হাবিব ভাই, সাগর ভাই, যৌথ প্রযোজনা- সবই এক। ‘মনের মানুষ’-এর পর থেকে তাদের সঙ্গে আমার অদ্ভুত একটা মনের যোগাযোগ হয়ে গেছে।

বাংলানিউজ :  ‘মনের মানুষ’-এ নিজেকে কি দারুণভাবেই না ভেঙেছিলেন...
প্রসেনজিৎ :
আমি নিজেকে ভাঙাচোরা করছি গত আট-দশ বছর ধরে। গৌতমদা তখনই আমার কাছে লালন চরিত্রটা নিয়ে এসেছিলেন। আমাদের ওখানে এমনকি বাংলাদেশেও হিরো বা হিরোইনের চেহারাটা তৈরি করে দেওয়া হয়। সেখানে আমি অল্প বয়সে নিজেকে ভাঙতে শুরু করেছি। এটা আমি অনেক আগে থেকে করে আসছি। এজন্যই ‘বাইশে শ্রাবণ’ কিংবা ‘মনের মানুষ’-এর মতো ছবি পেয়েছি। ‘মনের মানুষ’-এ কাজ করতে গিয়ে ভয় লেগেছিলো এই ভেবে- আমি বোধহয় পারবো না! কিন্তু গৌতমদা বিশ্বাস ধরিয়েছিলেন, আমি পারবো।  পরিশ্রম করে খাটতে খাটতে ‘মনের মানুষ’ করে ফেললাম। পরে লোকজন তো আমাকে বলতে শুরু করলো- ‘আপনি অস্কার পেয়ে গেছেন! কারণ বাংলাদেশের মানুষরা আপনাকে লালন হিসেবে মেনে নিয়েছে। ’ তবে লালনকে আমার মধ্য থেকে বের করতে সময় লেগেছিলো।  এ ছবির কারণে ৯ মাস আমি কোনো কাজ করতে পারিনি।  
 
বাংলানিউজ : ‘মনের মানুষ’-এর পর বাংলাদেশে ‘শঙ্খচিল’-এর কাজ করলেন। সাতক্ষীরায় শুটিংয়ের অভিজ্ঞতা কেমন ছিলো?
প্রসেনজিৎ :
এটা একটা নতুন অভিজ্ঞতা। গৌতমদা আমাকে যখন বললেন সাতক্ষীরায় কাজ হবে তখন জানতে পেরেছি, কলকাতা থেকে ঢাকা হয়ে সাতক্ষীরায় যেতে অনেক সময় লাগে। আর কলকাতা থেকে সাতক্ষীরায় যেতে তিন ঘণ্টা লাগে, কিন্তু সড়কপথে যেতে হবে। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, গাড়িতে চড়েই যাবো। এবারই প্রথম বিদেশে কোনো ছবির শুটিং করতে গিয়ে উড়োজাহাজে উঠিনি!
 
প্রথম একটা অভিজ্ঞতা হলো- গাড়ি থেকে নামলাম, নেমে পাঁচ’পা হাঁটলাম, তারপর ব্রিজ পার হয়ে একটা দেশ থেকে আরেকটা দেশে পৌঁছে গেলাম৷ দেখলাম ওখানেও আমাকে বুম্বাদা বলছে এবং আমাকে দেখার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। মানুষের ভালোবাসা অনেক পেয়েছি, অনেক রকমের ভালোবাসা পেয়েছি, কিন্তু রাত্রি সাড়ে তিনটা-চারটায় বের হয়ে দেখেছি, মহিলারা বেনারসি পড়ে দাঁড়িয়ে আছেন! যে রাস্তাটা দিয়ে আমি যেতাম, সেখানে অসংখ্য মানুষ ছিলো। আমি যাবো জেনে গিয়ে প্রত্যেকটা গ্রামের মোড়ে মোড়ে মানুষ দাঁড়িয়ে থাকতো।
 
ওই সময়ে যাওয়ার কারণ গৌতমদা খুব ভোরের আলোটা ধরতে চাইতেন৷ কিছু কিছু জায়গায় আমার প্ল্যাকার্ড নিয়ে কিছু জায়গায় আমার ব্যানার আবার কিছু জায়গায় আমার ছবি নিয়ে দাঁড়াতে দেখেছি তাদেরকে। ওখানে ১৫-১৬ দিন শুটিং করেছি৷ যে ক’দিনই কাজ করেছি, আমি যাওয়ার পথে গাড়ি থামিয়ে তাদের সঙ্গে দেখা করতাম, কথা বলতাম, তারপর যেতাম। এতোটুকু পাওয়াও তো আমার মনে হয় ভাগ্যের ব্যাপার। বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) অনেক সহযোগিতা করেছে।  নয়তো শুটিং করতে পারতাম না।  তাদের সঙ্গে বসে সকালে চা আর বড়া ভাজা খেতাম।
 
বাংলানিউজ : জীবনানন্দ দাশের ‘আবার আসিবো ফিরে’ কবিতা নিয়ে সাজানো গান রয়েছে ‘শঙ্খচিল’-এ। ছবিটিতে কবিতার প্রভাব কতোটা?
প্রসেনজিৎ :
আমাদের ছবিতে কবিতা ব্যবহার করা হয়েছে। কখনও কখনও চিঠি ব্যবহার করা হয়েছে। যেহেতু আমার চরিত্রটি শিক্ষকের, তাই গৌতমদা একটা আদল তৈরি করেছেন কবিতার মাধ্যমে। কখনও কখনও একটা দৃশ্যকে বলে দিতে পারে কবিতা। ফলে গল্পটার অনেকটা মানে বেরিয়ে আসে, গভীরতা বেরিয়ে আসে। এজন্য আমাকে একটা প্রস্তুতি তো নিতেই হয়েছে। কারণ এটা অনেকটাই নতুন আমার কাছে।

বাংলানিউজ : বাদলের মতো চরিত্রে কাজ করাটাও তো আপনার জন্য নতুন অভিজ্ঞতা। এ চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তুতি হিসেবে আপনি বই পড়েছেন জেনেছি। কাদের বই পড়েছেন?
প্রসেনজিৎ :
আমাকে গৌতমদা কিছু বই দিয়েছিলেন। ইতিহাস জানার জন্য সেগুলো কিছু সহযোগিতা করেছে। আসলে আমাদের ছবিটা দেশভাগের আবহ নিয়ে তো, তাই আমি সেই ইতিহাস বহন করে বেড়ানো মানুষদের সম্পর্কে জানতে সময় নিয়েছি। আমার চরিত্রটা এমন একটা জায়গা থেকে উপস্থাপন করা হয়েছে যে, ফেলে আসা জায়গার প্রতি মানুষের যে টান, ইতিহাস, দুঃখ সেগুলো কেমন তা জানা জরুরি ছিলো। আমি যদি দশটা পরিবারের সঙ্গে কথা বলে থাকি, তাহলে আটটা পরিবারের কাছ থেকে কিছু না কিছু গল্প পেয়েছি। কারও বাড়ি নিয়ে, কারও বন্ধু, মা, বাবা, জমি নিয়ে; কিন্তু গল্প একটা না একটা আছেই।  

কিছু পরিবারের অর্ধেক মানুষ বাংলাদেশে আছেন।  আবার বাংলাদেশের তেমন কিছু মানুষের আত্মীয়স্বজন হয়তো ভারতে থাকেন।  তাদের প্রত্যেকেরই যাওয়া-আসা আর নেই।  তবে মনের টানটা রয়ে গেছে।  এখনও সবাই সবার খবর রাখেন।  কীভাবে কাঁদছে দুই বাংলার মানুষ– ভেতরের সেই যন্ত্রণাটা বুঝতে চেষ্টা করেছি।  আমরা এবং পরের প্রজন্মেরও শেকড়ের ইতিহাসটা জানা থাকা দরকার। এটা গৌতমদা অসম্ভব সুন্দরভাবে এ ছবিতে তুলে ধরেছেন। সেজন্য আমাকে পড়াশোনা করতে হয়েছে। বেশি জানতে হয়েছে মানুষের আবেগ। কারণ আমি সবসময় একটা বিষয় মনে রেখেছি- যতোক্ষণ না আবেগটাকে নিজের মধ্যে আনতে পারবো, ততোক্ষণ বাদলের মতো চরিত্র হয়ে উঠতে পারবো না।  বাদল একটা বিশাল সংখ্যক বাঙালির প্রতিনিধি৷ গল্পে বাদল, লায়লা ও রূপসা- এই তিনজনের যে পরিবার, সেই পরিবার সীমান্তবর্তী এক বাঙালির সংসারের প্রতিচ্ছবি৷ তাদের জীবন, অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই, বহু বাঙালির সমস্যা৷ এখানে একই সঙ্গে আমি মাস্টার, বাবা, স্বামী৷ সকালে গুনগুন করে স্কুলে গিয়ে ছবি আঁকা, কবিতা পড়ানো মানুষটার জীবনে একটা সাংঘাতিক লড়াই আছে।  সেটা বিশালসংখ্যক বাঙালির লড়াই।

বাংলানিউজ : ‘শঙ্খচিল’ কি শুধুই গৌতম ঘোষের ছবি বলে করেছেন?
প্রসেনজিৎ :
গৌতম ঘোষ প্যাকেজিংয়ে বিশ্বাস করেন না। এটা কিন্তু সবাইকে বুঝতে হবে। শুধু গৌতম ঘোষ নন, তার মতো পরিচালকরা এই নীতিতে বিশ্বাসী। ‘মনের মানুষ’-এর মতো ছবি দুই বাংলাতেই আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। সুনাম, ব্যবসা, সবই করেছে। তারপরেই গৌতম ঘোষের উচিত ছিলো আরেকটা ছবি করে ফেলা। আমি তো গৌতমদাকে বলতে শুরু করেছি ‘পার’-এর সময় থেকে- আমাকে নাও, আমাকে নাও! তিনি ‘মনের মানুষ’-এ এসে নিয়েছেন। এরপর আমিই ঘ্যান ঘ্যান করেছি, ‘আমাকে দিয়ে ছবি করাও, আমাকে দিয়ে ছবি করাও’। পাঁচ বছর পর এসে ‘শঙ্খচিল’-এর সময় তিনি বললেন, ‘এবার একটা গল্প ভাবছি, এবার তোমাকে নিয়ে করা যায়। ’ এই মানুষগুলো সিনেমাটাকে যতোক্ষণ ভাবেন বা মাথায় আনেন, তখন কিন্তু একটা প্যাকেজের হিসেবে দেখেন না একটা ছবি করতে হবে ভেবে শুরু করে দেই! তাই এই পরিচালকরা মাস্টার হিসেবে থেকে যাবেন আমাদের সিনেমার ইতিহাসে।  ‘শঙ্খচিল’ও বাংলা ছবির ইতিহাসে একটা মাইলফলক হয়ে থাকবে। এই ধরনের ছবি করার আরেকটা কারণ আমি সীমানা পেরোতে চাই।  পেরোতে চাই নিজের পরিসর ও দেশের পরিধি।
 
বাংলানিউজ :  ‘শঙ্খচিল’কে আপনার জীবনের সেরা ছবি বলবেন?
প্রসেনজিৎ :
আপনারা এটা জানেন, গত ছয়-সাত বছর ধরে আমি কি ধরনের ছবি করছি। ৩৩ বছর ধরে কাজ করে আমি বুঝি, সবকিছুর ঊর্ধ্বে হলো পর্দায় আমরা কি দেখাবো। সেখান থেকে আমার মনে হয়েছে ‘শঙ্খচিল’ এমন একটা ছবি যেটা দুই বাংলাতে শুধু আজকে নয়, বহু বছর ধরে থাকবে। আমার জীবনে আমি যদি দশটা ছবির নাম বলি এই মুহূর্তে, যে দশটা ছবি আমার জীবনে থেকে যাবে, তার মধ্যে ‘শঙ্খচিল’-এর বাদল চরিত্রটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এটা আপনারা দেখলেই বুঝবেন। বাদল চরিত্রটা কোথাও মনে হয়েছে বাঙালির যন্ত্রণা, বাঙালির দুঃখ, বাঙালির রাগ, বাঙালির কষ্ট; ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’র কথা যদি বলি, একজন মহিলার মাধ্যমে তিনি লক্ষ লক্ষ মহিলার কথা বলতে চেয়েছেন। ছবিটা তাই আমরা ঋত্বিক ঘটককে উৎসর্গ করেছি।
 
বাংলানিউজ : ছবিটা কি নতুন প্রজন্মকে টানতে পারবে?
প্রসেনজিৎ :
‘শঙ্খচিল’-এর সময়টা এখনকার৷ কিন্তু এতে দেশভাগ আছে৷ এমন একটা জায়গায় আমরা শুটিং করেছি যেখান থেকে বাদল নিজের বাড়িতে দাঁড়িয়ে আরেকটা দেশকে দেখতে পায়।  আবার ওপারের বাড়িটা থেকে বাংলাদেশ দেখা যায়।  আর মাঝে বয়ে যাচ্ছে একটা নদী।  নদী কিন্তু ভাগ করা যায় না! সারা পৃথিবীতেই আজকে ভাগাভাগি এমন একটা জায়গায় গেছে, যেখানে ভাষার সমস্যা, পরিচয়ের সমস্যা হয়ে যাচ্ছে।

‘শঙ্খচিল’ কিন্তু শুধু ভারত-বাংলাদেশের ভাগের কথা বলেনি। এটা লাখ লাখ বাঙালির গল্প। এই প্রজন্মের কেউ যদি না-ও পারে, তাদের বাবা-মায়েরা এর সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পারবেন। সারা পৃথিবীই এখন সীমান্ত সমস্যায় ভুগছে। এটি এখন একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। দেশভাগের ইতিহাসটা এ ছবির সঙ্গে আছে। তবে এটা শুধু একটি পরিবারের গল্প থাকেনি, লক্ষ লক্ষ মানুষের বা পরিবারের বেদনার গল্প ও লড়াই হয়ে উঠেছে। তাই এ ছবির আবেগ সব প্রজন্মকে স্পর্শ করবে বলে আমি বিশ্বাস করি।

আমি ছোট্ট একটা উদাহরণ দেই। ‘শঙ্খচিল’-এর ট্রেলার দেখে দু’তিন দিন আগে কলকাতার এক নারী সাংবাদিক আমার সঙ্গে কথা বলতে এলেন। তিনি জানালেন, ১১-১২ বছরের একটা মেয়ে কলকাতায় এসেছে বেড়াতে। এখানে সে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। পিজিতে নেওয়ার পর চিকিৎসকরা জানান, আধঘণ্টার মধ্যে অস্ত্রোপচার করানো দরকার। কিন্তু ওইদিন তার ভিসার মেয়াদ শেষ। মেয়েটার মা-বাবার অবস্থাটা কি ভাবুন একবার। তারা ফোনে বারবার চেষ্টা করছেন ভিসার মেয়াদ যেন বাড়ানো যায়। এদিকে চিকিৎসক বলছেন সময় বেশি নেই। এটাকে আপনি কি বলবেন? এখানে মানবিকতাই সবকিছুর ঊর্ধ্বে। আমাদের যে পরের প্রজন্ম, আশা করি তাদের কাছ থেকে এর সুফল পাবো।

বাংলানিউজ : আপনি সাড়ে তিনশ’রও বেশি ছবিতে কাজ করেছেন। সেই অভিজ্ঞতা থেকে ‘শঙ্খচিল’ নিয়ে কতোটা প্রত্যাশা করেন? 
প্রসেনজিৎ :
কলকাতায় ছবিটি দেখানো হয়েছে গত ১১ এপ্রিল। তবে বাইরের কোনো লোক ছিলেন না, ওইদিন শুধু কলকাতার গভর্নরের জন্য আমরা প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছিলাম। উনি যথেষ্ট বয়স্ক একজন মানুষ। তিনি এসে আমাকে বললেন, ‘আমি আধঘণ্টার বেশি তো কোথাও বসতে পারি না। আমি আধঘণ্টা পর চলে যাবো প্রসেনজিৎ। ’ তাকে বললাম, ঠিক আছে আপনি দেখুন। কিন্তু তিনি পুরো ছবিটা তো দেখলেনই, এন্ড-টাইটেল কার্ড ওঠা অবধি বসে রইলেন।

এমন উদাহরণ দেখছি বলে আমি আশাবাদী। তার ওপর এটা গৌতমদার ছবি, তার কাজ সম্পর্কে জানেন। ভালো কাজ করার চেষ্টা ছিলো আমাদের। এতো বছর আমরা যেমন বাণিজ্যিক ছবিতে ব্যবসা দেখতে পেয়েছি, আবার এখনকার দিনে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারি, ভালো ছবি যেটার সঙ্গে মান আছে, সম্মান আছে, সেটার সঙ্গে কোথাও একটা বাণিজ্যিক সম্ভাবনা আছে। এদিক দিয়ে আমার কাছে মনে হয়, ‘শঙ্খচিল’ আমাদের দুই দেশের জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ ছবি।

বাংলানিউজ : ‘শঙ্খচিল’ ছবিতে আপনি প্রযোজকও। এ কারণে আলাদা দায়িত্ব অনুভব করেছেন?
প্রসেনজিৎ :
টাকা তুলতে হবে বলে প্রযোজনা করিনি। ‘শঙ্খচিল'-এর মতো সিনেমা করে যেতে চাই।  ৩০-৪০ বছর পরও যেন পরবর্তী প্রজন্ম বলতে পারে এমন একটা ছবি হয়েছিলো।  ইতিহাসে থেকে যাবে এ ধরনের একটা কাজের পাশে দাঁড়াব বলেই প্রযোজনায় যোগ দিয়েছি।  আপনারা জানেন, ভারতের জাতীয় পুরস্কারে সেরা বাংলা ছবি হয়েছে ‘শঙ্খচিল’।  এটা শুধু আমার একার অবদান নয়, টেকনিশিয়ান থেকে শুরু করে পুরো টিমের। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা থাকে বলে একটা ভালো ছবি হয়। তবে পুরস্কারের কথা ভেবে ছবি করি না। আসল হলো দর্শকের খুশি হওয়া।

বাংলানিউজ : দুই বাংলায় কি চলচ্চিত্রের বাজার বড় করা সম্ভব? 
প্রসেনজিৎ:
সম্ভব। আমি এটা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি। ‘শঙ্খচিল’-এর ফলে আগামী দিনে আরও বেশকিছু যৌথ প্রযোজনার ছবি হবে।  আমাদের এখানকার প্রথম সারির অভিনেতা-অভিনেত্রীরা বাংলাদেশে এসে কাজ করছেন। আবার বাংলাদেশের শিল্পীরা ওখানে গিয়ে কাজ করছেন। এই আদান-প্রদানটা খুব জরুরি।  আমি বহুদিন ধরেই বলছি।  এই বৃহৎ সংখ্যক বাঙালিকে আমরা দর্শক হিসেবে পাচ্ছি।  এটা খুব বড় একটা সুযোগ। বাংলা ছবির জন্য এই মার্কেটটা খুবই জরুরি।  

হয়তো বাধা-বিঘ্নতা থাকেই। সিনেমা, গান, নাটক এমন বিষয় যেগুলোকে কখনও আটকানো যায় না। বিনোদনই পারে সব বাঁধা আর বেড়াকে মুছে দিতে। সেটারই একটা প্রচেষ্টা আমাদের ‘শঙ্খচিল’। নামটি এখানে মুক্তির প্রতীক। পাখি যেখানে-সেখানে উড়ে যেতে পারে৷ তার কোনো পাসপোর্ট লাগে না।  

বাংলাদেশ সময় : ১৩১১ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৬, ২০১৬
জেএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

তারার ফুল এর সর্বশেষ