‘পৃথিবীতে মা-বাবার কাছে নিজের সুখ ও আনন্দের চেয়ে সন্তানের সুখ আর আনন্দ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমার মেয়ে অনন্যা আমার জীবনের সবকিছু’- এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বললেন ১২ বছরের কন্যা অনন্যার বাবা আজম খান।
গত বছরের নভেম্বরের কথা। একদিন এটিএন বাংলার চন্দন সিনহা ফোন দিলেন দেখা করার জন্য। তার পরিবারের সঙ্গে আমাদের পরিবারের দারুণ সম্পর্ক। এটিএন বাংলায় যাওয়ার পর চন্দনদা বললেন, ‘ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের হেড অব মার্কেটিং তোমাকে ফোন দেবেন। ’ হেসে জানতে চাইলাম, ‘কেনো? আমার তো ঋণ বা প্রযোজক লাগবে না, তাছাড়া তাকে তো অামি চিনি না। ’
চন্দনদা বললেন, ‘ধুর বউদি, ওসব কিছু না। আজম খান দারুণ এক মানুষ। ১২ বছরের একটা মেয়ে আছে তার। তার শখ মাঝে মধ্যে ভালো পরিচালকের সঙ্গে কাজ করা। শখের কাজ। তোমার নাটকে কর্পোরেট লুক হ্যান্ডসাম বাবা লাগে না? তিনি আমাদের কাছে খুবই সম্মানিত। তাই তোমাকেই বললাম। ’
চন্দনদা আমাকে আজম খানের নম্বর টেক্সট করলেন। দু’দিন পর আবার তার কল- ‘তোমাকে এতো করে বললাম, একটা কল দিলা না ওনাকে!’ ১০ নভেম্বর তার কথামতো হ্যান্ডসাম আজম খানের সঙ্গে আমার দেখা হলো। সারামাস শুটিং ছিলো চট্টগ্রাম, রাঙামাটি আর নেপালে। এর মধ্যে সময় বের করলাম, কথাও হলো। নভেম্বর থেকে জুন- সাত মাস ধরে তাকে চিনি। খুবই ভদ্র, নম্র, মার্জিত এবং হ্যান্ডসাম মানুষ আজম খান। তবে আজও কোনো নাটকে তাকে নেওয়া হয়নি।
সেদিনের পর থেকে আজম খানের সঙ্গে আমার ফোনে কথা হয়। দেখা হয়। তার পরিবারের সঙ্গেও পরিচয় হয়েছে পারিবারিক অনুষ্ঠানে। তার রুটিন ততোদিনে আমার মুখস্ত হয়ে গেছে। ভোরে নামাজ পড়ে মেয়েকে তুলে নাস্তা করিয়ে ধানমন্ডিতে স্কুলে দিয়ে আসা, অফিসে যাওয়া, সারাদিন ব্যস্ত সময় কাটান তিনি। এর ফাঁকে মেয়ের ঘরে ফেরা, দুপুরের খাবার, হোমওয়ার্কের খোঁজ নিতেও ভোলেন না। অফিসিয়াল কোনো অনুষ্ঠান না থাকলে তিনি কাজ শেষে সোজা বাসায় চলে যান। তার একটাই ভাবনা- অনন্যা অপেক্ষা করছে।
এক সকালে আজম খানের ফোন এলো- ‘শুনেছি আপনার ছেলেমেয়ে তুখোড় পড়াশোনায়। আমাকে একটা টিচার ঠিক করে দেবেন প্লিজ!’ বাসায় ফিরে আমার মেয়েকে সব বললাম। ও নিজেই পড়ানোর আগ্রহ দেখালো। অনুলেখা এর আগে পরিচালক শিহাব শাহীনের মেয়ে সফেনকে পড়িয়েছে। কিন্ত অনন্যাকে বাসায় আসতে হবে শুক্র ও শনিবার। পরে আজম খান নিজেই অনুলেখার সঙ্গে ঠিক করলেন, বাকি দু’দিন এনএসইউ থেকে আমার মেয়ের সুবিধা অনুযায়ী তাদের গাড়ি ওকে আনতে যাবে। আবার পড়া শেষে বাসায় দিয়ে আসবে। আমি তো অবাক!
শুরু হলো বাবা আজম খানের নতুন ছুটির দিন। শুক্র-শনি আমাদের বাসায় মেয়েকে নামিয়ে দিয়ে তিনি চলে যান তার মা-বাবার কবরস্থানে। পরে মেয়েকে নিয়েই তার দিনরাত কাটে। নিজের জন্য তার কোনো সময় নেই। জীবনের অনেক লোভনীয় আড্ডা তিনি এড়িয়েছেন। মেয়ের ব্যাপারে তিনি খুব আন্তরিক, যত্নবান ও বিশ্বস্ত। কেনাকাটা করা, সিনেমা দেখা, বই কেনা, ডাক্তার দেখানো- বাবা হিসেবে সব পালন করেন তিনি।
একদিন আমাকে দুপুরে খাওয়ার নিমন্ত্রণ জানালেন আজম খান। খাওয়ার পর তিনি বললেন, ‘স্বপ্ন দেখি অনন্যা একদিন বড় হবে, দেশকে ভালোবাসবে। আমি তো বৃদ্ধ মানুষ! (এই কথাটা তিনি মজা করে বলেন) তাই অনন্যার জন্য একটি অ্যাপার্টমেন্ট কিনছি। ওই মায়াঘরে থাকবে ও। আর আমার কথা মনে করবে। আমি তো আর সারাজীবন এই পৃথিবীতে থাকবো না। অনন্যা যেন তার নামের মতোই আলো ছড়ায় চারপাশে, ভালো মানুষ হয়। বাবা হিসেবে ওর জন্য হয়তো অনেক কিছু করতে পারিনি, কিন্ত চেষ্টা করেছি। ’
আজম খানের কাছে জানতে চাইলাম, নতুন করে জীবন সাজানোর ইচ্ছা হয় না? তিনি দৃঢ় কন্ঠে বললেন, ‘যদি বলি ইচ্ছে করে না তাহলে মিথ্যে বলা হবে। কিন্ত অনন্যার মতো যার দারুণ একটি রাজকন্যা আছে তার আর কিছু চাইতে নেই। ’
সন্ধ্যা হয়ে গেলো। রাতের সোডিয়াম লাইটের আলোয় ঘরে ফিরছিলাম। কখন যে নিজের অজান্তে দু’চোখ ভিজে জল পড়লো টের পেলাম না! আজম খানের মতো বাবা পাওয়া সত্যি ভাগ্যের। অনন্যা তুমি বড় হও। বাবার ইচ্ছা পূর্ণ করো। তুমি সত্যিই ভাগ্যবতী।
* লেখক : নাট্য নির্মাতা
বাংলাদেশ সময় : ১০২৯ ঘণ্টা, জুন ২০, ২০১৬
জেএইচ