ঈদকে সামনে রেখে এবার একাধিক নাটক ও টেলিছবি তৈরি হয়েছে পুরান ঢাকার প্রেক্ষাপটে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এবারের ঈদের একডজন নাটক-টেলিছবির গল্প পুরান ঢাকাকেন্দ্রিক।
এ তালিকায় আছে সুমন আনোয়ারের ‘ক্ষয়ে যাওয়া বুকের ভেতর’, সাগর জাহানের ধারাবাহিক ‘অ্যাভারেজ আসলাম’, ইমরাউল রাফাতের ‘গর্ভধারিনী’, অঞ্জন আইচের ‘তক্ষক’, নাজনীন হাসান চুমকির ‘বেবী আপা’, তানিম রহমান অংশুর ‘দুই অংশের শেষ এখানেই’, আশফাক নিপুণের ‘বাহানা’, রূপক বিন রউফের ‘হোন্ডাগিরি’, শিবলী শাখাওয়াতের ‘দুঃখিত’, জাকারিয়া সৌখিনের ‘পবিত্র প্রেম’, গোলাম মোক্তাদির শানের ‘ইতি ফরহাদ’, সাদাত রাসেলের ‘ওল্ড টাউন লেন’ প্রভৃতি।
একই ঈদে একটি নির্দিষ্ট এলাকাকে ঘিরে দেশের বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে এতোসংখ্যক নাটক প্রচারের প্রস্তুতি নেওয়ার ঘটনা আগে খুব একটা দেখা যায়নি। আগামীতে এ সংখ্যা আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। নাট্যকাররাও এই জায়গাটিকে মাথায় রেখে গল্প সাজাচ্ছেন।
পুরান ঢাকার প্রেক্ষাপট নিয়ে নাটক নির্মাণের প্রবণতার নেপথ্য বিষয়গুলো জানতে বাংলানিউজ কথা বলেছে সংশ্লিষ্ট নির্মাতাদের সঙ্গে। তাদের প্রায় সবারই ভাষ্য, গল্পের প্রয়োজনেই মূলত পুরান ঢাকাকে বেছে নিচ্ছেন তারা। এ ছাড়া স্থানীয় ভাষা, স্থাপত্য ও মহল্লা পর্দায় বাড়তি মাত্রা যোগ করে বলে দাবি তাদের।
আগ্রহ বাড়ছে
ঢাকার উত্তরার বিভিন্ন শুটিং লোকেশন কিংবা বাড়িগুলোতে বছরের পর বছর দেদার নাটকের কাজ হওয়ার কারণে দর্শকদের কাছে একঘেঁয়েমি লাগে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। লোকশনে ভিন্নতা আনতেই মূলত পুরান ঢাকাকে বেছে নিচ্ছেন নির্মাতারা।
পরিচালক অঞ্জন আইচ বলেন, ‘পুরান ঢাকার বাড়িগুলো যে দিন দিন ভেঙে ফেলা হচ্ছে, আমার গল্পের বিষয়বস্তু সেটাই। ফলে পুরনো বাড়িগুলো পেতে আমার এই লোকেশনই দরকার ছিলো। ’ তিনি মনে করেন, গল্পের প্রয়োজনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ভিন্নতা রাখার লক্ষ্যে পুরান ঢাকার প্রতি দিন দিন নির্মাতাদের আগ্রহ বাড়ছে।
গল্প অনুযায়ী চিত্রায়ন যেন প্রাসঙ্গিক হয় সেদিকটা মাথায় রেখেই পুরান ঢাকাকে বেছে নেওয়া হচ্ছে। পুরান ঢাকার প্রেক্ষাপটে বানানো নাটকগুলো তুমুল জনপ্রিয়তাও পাচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে ‘আরমান ভাই’ সিরিজের কথা বলা যায়। এর নির্মাতা সাগর জাহান বললেন, ‘পুরান ঢাকার ভাষায় প্রথম ‘আরমান ভাই’ নাটকটি তৈরি করেছিলাম। এরই রেশ ধরে এবার ‘অ্যাভারেজ আসলাম’ বানিয়েছি। দুটিতেই পুরান ঢাকার ভাষা রয়েছে। গল্পের প্রাসঙ্গিকতা ধরে রাখার জন্য আমরা এখন পুরান ঢাকাকে বেছে নিচ্ছি। আমাদের আগ্রহটাও দিন দিন বাড়ছে পুরান ঢাকার প্রতি। ’’
একঘেঁয়েমি কাটানো
উত্তরার বিভিন্ন শুটিংবাড়ি, দিয়াবাড়ি কিংবা পূবাইলেই সাধারণত নাটক-টেলিছবির দৃশ্যায়ন হয়। এ কারণে দর্শকদের মধ্যে একঘেঁয়েমি চলে আসার কথা দীর্ঘদিন ধরেই শোনা যাচ্ছে। এটা কাটাতেই চ্যানেল ও নির্মাতারা পুরান ঢাকাকেন্দ্রিক গল্পগুলো নির্বাচন করছেন। আশঙ্কার কথা হলো, পুরান ঢাকার ব্যবহার যে হারে বাড়ছে তাতে উত্তরার মতো না আবার দর্শকদের মধ্যে একঘেয়েমি চলে আসে!
এ প্রসঙ্গে পরিচালক সুমন আনোয়ার বলেন, ‘ঈদে প্রায় ৩০০-৪০০ নাটকের মধ্যে ১২টি নাটক বেশি নয় যে দেখতে একঘেঁয়েমি লাগবে। কারণ ওল্ড ইজ গোল্ড। আর পুরান ঢাকা হলেও সবাই কিন্তু একই জায়গায় কাজ করেন না। কেউ ছাদে, কেউ ঘরে, কেউ গলিতে, কেউ আবার বুড়িগঙ্গায় চিত্রায়ন করছেন। গল্প তো থাকেই, নাটক-টেলিছবি দর্শকদের কাছে আলাদা হবে কি-না তা নির্ভর করে লোকেশনের ওপরও। তবে প্রাসঙ্গিক না হওয়ার পরও যে কোনো গল্পের প্রয়োজনেই যদি আমরা পুরান ঢাকাকে বেছে নিই, তাহলে উত্তরার মতো একঘেঁয়েমি আসতে বেশিদিন লাগবে না। ’
সুবিধা-অসুবিধা
দর্শকদের কথা ভেবে অন্যরকম কাজ উপহার দিতে নানান সমস্যাকে উপেক্ষা করে পুরান ঢাকাকে বেছে নিচ্ছেন পরিচালকরা। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, পুরান ঢাকায় কাজ করার ক্ষেত্রে সুবিধার চেয়ে অসুবিধাই বেশি! বেশ কয়েকজন পরিচালক এমনটাই জানালেন।
সুমন আনোয়ার বলেছেন, ‘উত্তরায় অনেক শুটিংবাড়ি, কিন্তু পুরান ঢাকায় আছে একটি। ফলে সাধারণ মানুষ থাকেন তেমন বাড়ি ভাড়া করতে হয়। বিদ্যুতের অবস্থা খুব খারাপ থাকে। তাছাড়া রাস্তা নিয়েও ঝামেলা হয়। বেশিরভাগ সময় জেনারেটর ব্যবহার করতে হয়। তবে সুবিধা হলো এখানকার রাস্তাগুলো একেক রকমের, বাড়ির নকশাগুলো একইরকম মনে হলেও এক না। পুরান ঢাকা পুরনো হলেও শুটিং লোকেশনের ক্ষেত্রে এতো তাড়াতাড়ি পুরনো হওয়ার নয়। ’
পরিচালক তানিম রহমান অংশু বলেন, ‘পুরান ঢাকায় কাজ করলে ভিন্নরকম দৃশ্য ও গল্প দর্শকের কাছে উপস্থাপন করা যায়। এ ছাড়া বাকি সবকিছুতেই অসুবিধা। যেমন- বাসার লোকদের অনুমতি নিয়ে শুটিং করাটা অনেক সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। টয়লেট নেই, গলিগুলো অনেক ময়লা। বৃষ্টি এলে কোনো জায়গায় পাওয়া যায় না থাকার। গরমসহ বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে কাজ করতে হয়। ’
বাজেট স্বল্পতাও কারণ
গল্পে প্রাসঙ্গিক না হলেও অনেকে পুরান ঢাকাকে অন্য জায়গার বিকল্প হিসেবে বেছে নিচ্ছেন। এ কারণেও এই জায়গাটিকে নাটকে তুলে ধরার প্রবণতা বেড়েছে।
বাজেটের সীমাবদ্ধতা থাকায় মাঝে মধ্যে উপায় না পেয়ে নির্মাতারা পুরান ঢাকাতেই যাচ্ছেন ইউনিট নিয়ে। সাধারণত যেমন বাজেট থাকে তাতে অনেক ক্ষেত্রে পরিচালকরা সংকুলান করতে পারেন না। তাই প্রয়োজন থাকলেও ঢাকার বাইরে যেতে পারেন না তারা।
পরিচালক ইমরাউল রাফাত বলেন, ‘‘আমার ‘গর্ভধারিনী‘ নাটকের জন্য একটি খানদানি বাড়ির দরকার ছিলো। এজন্য মানিকগঞ্জ যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাজেটে ঘাটতির জন্য পুরান ঢাকাকেই বেছে নিতে হয়েছে। ’’
অন্য কয়েকজন পরিচালকও বাজেট প্রসঙ্গে প্রায় একই কথা জানালেন। তবে প্রাসঙ্গিকতা ছাড়া তারা অযথাই নিজেরাও পুরান ঢাকায় গিয়ে কাজ করার পক্ষপাতী নন। অপ্রাসঙ্গিকভাবে নাটক-টেলিছবি বানালে দর্শকরাই মুখ ফিরিয়ে নেয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৪০৭ ঘণ্টা, জুলাই ০৬, ২০১৬
জ়েএমএস/টিএস/জেএইচ