আজকাল আমরা সবাই সমালোচক। পত্রপত্রিকা, টিভি চ্যানেল তো বটেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমরা একেকজন মহাবোদ্ধা! কিন্তু গঠনমূলক সমালোচনা আমরা ক’জন করতে পারি? শত্রুর ভালো আর মিত্রের খারাপটা আমরা ক’জন বলতে পারি? কেনো জানি মনে হয়, আমরা সবকিছু চিন্তা করি ব্যক্তিগত অবস্থান থেকে।
আমি বরাবরই সমালোচনাকে দু’হাত ভরে গ্রহণ করি। আমার চিত্রনাট্যে সর্বশেষ ছবি ‘পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেম কাহিনি টু’ নিয়েও ভালো-মন্দ অনেকে লিখেছেন। সব-ই মন দিয়ে পড়েছি। তবে সবচেয়ে হাস্যকর ছিলো একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত একটি লেখা, যেখানে একজন সাংবাদিক তার ব্যক্তিগত আক্রোশ ফুটিয়ে তুলেছিলেন।
ঘটনার সূত্রপাত ২০১৪ সালে। এ ছবিতে একজন সাংবাদিকের চরিত্রে অভিনয়ের জন্য তাকে ব্যক্তিগতভাবে আমরা চূড়ান্ত করি। প্রযোজককে তিনি কথা দেন, ছবিতে তিনি অভিনয় করবেন, তবে তার অভিনয়ের খবরটি সাধারণ কায়দায় প্রকাশ করলে হবে না। স্টেডিয়ামে বিশাল কেক কেটে, কনফেডি ও ফায়ার ওয়ার্কসের স্ফূরণ ঘটিয়ে ধুমধাম করে তার চলচ্চিত্রে অভিষেক ঘটাতে হবে। পত্রপত্রিকায় একযোগে খবর আসবে, অমুকের চলচ্চিত্রে বর্ণাঢ্য অভিষেক। মোটামুটি তার অভিনয়ের ব্যাপারটি যেন জাতীয় খবরে পরিণত হয়-এটাই ছিলো তার একমাত্র চাওয়া।
কিন্তু হায় ‘পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেম কাহিনি টু’ ছবির প্রথম দিনের শুটিংয়ের ফাঁকে পরিচালক সাফিউদ্দিন সাফি এক পত্রিকাকে গল্পচ্ছলেই জানিয়ে দেন, স্বনামখ্যাত এক সাংবাদিক এ ছবিতে অভিনয় করবেন। দু’দিন পর খবরটি শুধু ওই একটি পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয়। আহারে! উত্তেজনা, আগ্রহ, সারপ্রাইজে একদম জল ঢেলে দিলো ওই পত্রিকা। ফলাফল: তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠেন অভিনয়শিল্পী হওয়ার স্বপ্নে বিভোর সে সাংবাদিক। কথা না বলে সংবাদ প্রকাশের জন্য ওই নামী পত্রিকার নামজাদা সাংবাদিকের চাকরিও খেয়ে ফেলেন তিনি। রাগে, ক্ষোভে ছবিটিতে অভিনয় করতে অস্বীকৃতি জানান।
বাধ্য হয়েই নির্মাতারা আমাকে অনুরোধ করেন, অন্য কাউকে খুঁজে বের করে সময় নষ্ট করার পরিবর্তে আমি যেন এই চরিত্রে অভিনয় করি! অন্যথায় ছবিটি সেন্সর বোর্ডে জমা দিতে দেরি হয়ে যাবে। উপায়ন্তর না দেখে সবার অনুরোধে আমাকে অভিনয় করতে হয়। আর ওই সাংবাদিক? দুই বছর পরও তার রাগ-ক্ষোভকে পোষ মানাতে না পেরে পত্রিকার পাতায় ‘পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেম কাহিনি টু’ নিয়ে মজাদার (!) একটি সমালোচনা লিখেন। ছবি মুক্তি পাওয়ার এক মাস পর সাধারণত সমালোচনা ছাপা হয় না। কিন্তু সেটি সচেতনভাবেই করা হয়েছিলো। চলচ্চিত্রের মানুষ না হয়েও ছবি নিয়ে তার বিশ্লেষণ যা ছিলো, তার সারমর্ম এই- পৃথিবীতে ‘পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেম কাহিনি টু’র মতো বস্তাপচা, বাজে ছবি আর হয় না!
স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক তিনি, যা ইচ্ছে তিনি লিখতেই পারেন। খুব হিংসে হয়েছিলো, ইশ, আমার কবে দিন আসবে! আমি কবে সমালোচনা লিখবো। খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি। এবারের ঈদে মুক্তি পাওয়া চারটি ছবিই সপরিবারে, সবান্ধব টিকিট কেটে হলে গিয়ে দেখেছি। এটি কোনোভাবে জানতে পেরে বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম আমার কাছে অনুরোধ করে চার ছবি নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী একটি লেখা লিখার জন্য। এবার বুঝলেন, ধান ভাঙতে কেনো শিবের গীত করলাম?
জনৈক সেই সাংবাদিক চলচ্চিত্রের মানুষ না হয়েও সমালোচনা লিখেছিলেন। আর আমি ৮০টি নাটক আর দুটি চলচ্চিত্রের কাহিনি, চিত্রনাট্যকার, সংলাপ রচয়িতা (পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেম কাহিনি, পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেম কাহিনি টু); ছবি নিয়ে দু’চার কথা তো লিখতেই পারি! তবে হ্যাঁ, লিখতে বসে আর কিবোর্ড এগোয় না। কি লিখবো আমি? কেন লিখবো? আমি কে? আমার লেখা কেন পড়বেন পাঠক? আমি যা বলবো, তাইবা সত্যি হবে কেনো? অতঃপর আত্মসমর্পণ করলাম বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম-এর কাছে। নাহ্, আমাকে দিয়ে হবে না। ছবি নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করার ধৃষ্টতা আমার নেই। কিন্তু বাংলানিউজের চাওয়া- একজন সমালোচকের দৃষ্টিতে না হোক, একজন আমজনতার দৃষ্টিকোণ থেকে কিছু লিখতে হবে। এবার ভাবতে বসলাম। এই আইডিয়াটি খারাপ নয়।
যখন টিকেট কেটেছিলাম, তখন তো আর ভাবিনি ছবিগুলো নিয়ে লিখতে হবে। তাই সমালোচকদের মতো তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করতে পারবো না। সাধারণ দর্শক হিসেবে শুধু দু’কথা বলবো। বাংলা চলচ্চিত্রে সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে সুসময় যাচ্ছে এখন। এই আনন্দের দিনে মন্দ কথাকে পাশ কাটিয়ে ভালোটাই বলতে চাই বেশি। তারপরও আমার কথায় কেউ কষ্ট পেলে, নিজ গুণে ক্ষমা করে দেবেন।
শিকারি
শুরুতেই একটি ধাঁধাঁ। বলুন তো এবারের ঈদে মুক্তি পাওয়া চারটি ছবির মধ্যে শাকিব খান তো ৩টি ছবিতে অভিনয় করেছেন। তবে কোন অভিনেতা তাকেও ছাড়িয়ে গেছেন? অর্থাৎ চারটি ছবিতেই অভিনয় করেছেন? উত্তরটি খুব সহজ: সুব্রত। তবে চার ছবিতে অভিনয় করলেও ‘শিকারি’তে তিনি ছিলেন বেশি সপ্রতিভ। এবারের ঈদের সবচেয়ে জনপ্রিয় ছবির নামও ‘শিকারি’; এ নিয়ে কারও কোনো সংশয় আছে বলে মনে হয় না।
আমি দেখেছি মাল্টিপ্লেক্স থেকে একক প্রেক্ষাগৃহগুলোতে ‘শিকারি’র টিকিটের জন্য দীর্ঘদিন দর্শকদের হাহাকার। এমনও দর্শককে পেয়েছি, যারা এ ছবি চার-পাঁচবারও দেখেছেন। কেনো দেখেছেন? উত্তর প্রায় সবারই জানা, ছবিটিতে শাকিব খানের নতুন লুক। মুক্তির আগে ‘হারাবো তোকে’ গানের ভিডিওতে তাকে দেখে নিন্দুকেরাও প্রশংসা করেছেন। আর তিনি শুধু স্লিম ও স্মার্ট লুক-ই নয়, খেলেছেন নাচ, অ্যাকশন, কমেডি, রোম্যান্স, সেন্টিমেন্টসহ সব শাখায়। অভিনয় জীবনের অন্যতম সেরা কাজ করেছেন তিনি ‘শিকারি’তে। ছবির শুরুতে চেজিং দৃশ্যে তার অ্যাকশন দেখে দর্শকরা সগর্বে হাততালি, শিস দিয়েছেন। শাকিব খান স্টাইল করে সিগারেট ফুঁকছেন, সেখানেও তালি। অ্যাকশন দৃশ্যে মারপিট শেষে মুখের রক্ত মুছছেন, সেখানেও তালি। কী চশমা, কী সানগ্লাস-সব লুকেই এ এক নতুন শাকিব খান। এ ছবির জন্য তিনি সময়ও দিয়েছেন প্রচুর, আর তার ফল-ও পেয়েছেন। আমাদের কিং খান কোনো চরিত্রে বিশ্বাস রাখতে পারলে, আর নির্মাতা ও ছবির প্রতি মনোযোগী হলে যে একটি ছবি কোন উচ্চতায় পৌঁছে যায়, ‘শিকারি’-ই জ্বলন্ত প্রমাণ।
গর্বে বুক ভরে গেছে, যখন দেখেছি যৌথ প্রযোজনার এ ছবিতে প্রায় প্রতিটি দৃশ্যে শাকিব খান। ভারতীয় শিল্পীদের, এমনকি ছবির নায়িকা শ্রাবন্তীকেও দাঁড়াতে দেননি তিনি। ‘শিকারি’ শুধুই শাকিবের ছবি, আর বাকিরা ডেকোরেশন পিস। যদিও এ ছবির পরিচালক কে, তা নিয়ে আজও আমি ধাঁধাঁর মধ্যে আছি! বাংলাদেশের জাকির হোসেন সীমান্ত আর ভারতের জয়দীপ মুখার্জি এ ছবির পরিচালক জানতাম, ট্রেলারে দেখেছি। যদিও পোস্টারে জয়দীপের নাম জয়দেব লেখা। সে যাই হোক, প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে দেখলাম, ‘শিকারি’র পরিচালক বাংলাদেশের আব্দুল আজিজ এবং ভারতের রাজেশ কুমার!
ঘটনা কি বুঝতে না বুঝতেই আবিষ্কার করলাম, ‘শিকারি’ সুরিয়া অভিনীত তামিল ছবি ‘আধাভান’-এর রিমেক। সাত বছর আগে ছবিটি মুক্তি পেয়েছিলো। যদিও ‘আধাভান’-এর গল্পেও ছিলো ১৯৯০ সালে মুক্তি পাওয়া মালয়ালাম ছবি ‘হিজ হাইনেস আব্দুল্লাহ’র ছায়া। গল্প ধার নেওয়া হোক, ওই গল্পের বাংলা চিত্রনাট্য ও সংলাপ ছিলো টানটান উত্তেজনায় ভরপুর। গল্প বুঝতে হলে শেষ দৃশ্য পর্যন্ত ছবিটি দেখতে হবে। গল্প যাতে গানের আধিক্যে ঝুলে না যায়, এ ব্যপারে পরিচালক ছিলেন বেশ যত্নশীল।
ছবির প্রথমার্ধে দুটি এবং শেষভাগে মাত্র একটি গান; সবশেষে এন্ড ক্রেডিটে ব্যবহার করা হয়েছে ‘হারাবো তোকে’ গানটি। এই জনপ্রিয় গানের সুরের মূর্ছনায় উন্মাতাল শাকিব ভক্তরা বাড়ি ফিরতে ফিরতে মনে করেছেন, ‘সব খেল খতম!’ অর্থাৎ ‘শিকারি’ দেখার পর নাদুশনুদুশ কিং খান কিংবা ‘চামকু’ চুলের স্টাইলের শাকিবকে আর কোনো ছবিতে গ্রহণ করবেন না তারা। দর্শকের প্রত্যাশার পারদ এখন আকাশ ছুঁই ছুঁই। কিং খানকে এখন প্রতি ছবিতে ‘শিকারি’কে ছাড়িয়ে যেতে হবে।
পরের প্রতিবেদন
বাংলাদেশ সময়: ১৭১২ ঘণ্টা, জুলাই ২৬, ২০১৬
জেএইচ/এসও