শীতের সন্ধ্যায় পাড়া-মহল্লা, শহর কিংবা গ্রামে ব্যাডমিন্টন খেলার চিত্র খুব পরিচিত। গ্রামে বাড়ির আঙিনা, জমিই হয়ে ওঠে মৌসুমি এই খেলার প্রাণকেন্দ্র।
কোনো এককালের উচ্চবিত্তের খেলা এখন চাকচিক্যের চৌহদ্দি পেরিয়ে চলে এসেছে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্তসহ সমাজের নানা স্তরের মানুষের মাঝে। তবে শহরাঞ্চলেই এই খেলার প্রবণতা সবেচেয়ে বেশি। ঝামেলাহীন এবং অল্প পরিসরে এর আয়োজন সম্ভব বলেই বৃদ্ধি পাচ্ছে এর পরিধি। আর তাইতো শীতকাল এলেই ব্যাডমিন্টন খেলার ধুম পড়ে যায় সারা দেশে। খেলার নাম ‘ব্যাডমিন্টন’ হলেও চর্চাটা ‘ব্যাড মানে খারাপ’ নয়।
ব্যাডমিন্টন ছাড়া যেন শীত জমেই না আজকাল… শীত এলেই তরুণদের তোড়জোড় শুরু হয়ে যায় ব্যাডমিন্টন খেলার। গ্রাম কিংবা শহর সবখানেই হিড়িক পড়ে যায় খেলাটির। গ্রামে বড় মাঠেই কোর্ট কেটে শুরু হয় খেলা। কিন্তু শহরে তো তেমন মাঠই নেই। তাতে কি! খেলা তো আর বন্ধ হতে পারে না। যেহেতু মাঠের অভাব, তাই রাস্তার মাঝে বা গলির রাস্তায় কোর্ট কেটে চলে খেলার মহোৎসব। অফিস শেষে বাসায় ফেরার পথে প্রায়ই দেখতাম বাসার পাশে ছোটো মাঠে তিনটে ব্যাডমিন্টনের কোর্ট। একটু আগ বাড়িয়ে খোঁজ নিতে সেখানে উপস্থিত হলাম।
আয়োজনে মূল ভূমিকা পালন করেছে পাড়ার তরুণরাই। নিজেরাই চাঁদা তুলে এই শীতে খুব ধুমধাম করে আয়োজন করেছে ব্যাডমিন্টন খেলার। তাদেরই একজন জাফর ইকবাল। পরিচয় দিয়ে কথা হয় তার সাথে। তিনি জানালেন, ‘খেলার কোর্ট কাটতে বাঁশসহ খরচ পড়েছে প্রায় এক হাজার টাকা। প্রতিটা কোর্টের লাইটের জন্য খরচ হয়েছে আরও এক হাজার টাকার মতো। নিজেরাই নেট কিনেছি। র্যাকেট যে যারটা নিয়ে আসে। তবে বাজারে র্যাকেট পাবেন তিনশ টাকা থেকে তিন হাজার টাকায়। আর প্রতিদিন খেলার জন্য ফেদার বা কর্ক তো লাগবেই। পাড়ার দোকানগুলোতে প্রতিটি ফেদারের দাম পড়বে ষাট থেকে একশ বিশ টাকা। আমরা গুলিস্তানের পাইকারি স্পোর্টস মার্কেট থেকে বেশি করে কিনে এনেছি। ’
শীতের দাপটকে কুপকাত করতে তিনটে কোট, প্রতিটিতে এক সঙ্গে চারজনের বেশি খেলতে পারে না বলে অধিকাংশকেই কোটের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। একদলের খেলা শেষ হতে সঙ্গে সঙ্গেই চলে আসে আরেক দল খেলার জন্য। কখনও হোপ বাই নীল, আবার কখনও হোপ বাই টেন শব্দে মুখরিত খেলার মাঠ। ‘থার্টিন হোপ’ বা ‘ফোরটিন লাস্ট’, কলআপের পর পরই দেখা যায় অন্যদের মধ্যে চাপা উত্তেজনা। সবার মাঝেই শুরু হয় হুড়োহুড়ি, অপেক্ষায় মাঠ দখলের জন্য। শীতের রাতের হিম জড়তাকে সরিয়ে দিয়ে জাফর জানালেন আরও কিছু কথা, ‘প্রতি শীতেই আমরা ব্যাডমিন্টন খেলার আয়োজন করি। অনেকেই এখানে খেলেন অফিস শেষে। সবাই সন্ধ্যার পর নিজেদের অবসরে রাখেন খেলার জন্য। শীত তাড়াতে এই খেলার জুড়ি নেই। নিয়মিত খেললে শারীরিক ফিটনেস বাড়ে। তাছাড়া, শরীরের মেদ কমাতে সাহায্য করে। সারা দিন কাজের পরে বেশ ভালোই সময় কাটে আমাদের। ’
মৌসুমি এই খেলার তালিকা থেকে বাদ পড়েন না মেয়েরাও। সারাদিন ক্লাস কোচিংসহ ব্যস্ত সময় পার করে সন্ধ্যা হতেই ভাইদের সাথে কোর্টে হাজির হয়েছেন উচ্চ মাধ্যমিক পড়ুয়া মাইশা। তার কাছে জানতে চাই ব্যাডমিন্টন খেলতে গেলে কতটুকু সতর্কতা অবলম্বন করা উচিৎ। খুব গোছানো ভঙ্গিতে তিনি জানালেন, ‘প্রথমত কোর্ট অবশ্যই সমান মাটিতে হতে হবে, উঁচু-নিচু হলে পা ভাঙার বা মচকে যাবার সম্ভাবনা থাকে। পায়ে অবশ্যই কেডস ব্যবহার করতে হবে। যাদের চোখের সমস্যা আছে তারা দিনের আলোতে খেললেই ভালো। র্যাকেটে কোনো সমস্যা থাকলে সেটি দিয়ে না খেলাই ভালো। ’
কোর্টে নামার প্রস্তুতি নিতে নিতে মাইশা আরও জানালেন, ‘একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা লিখে দেবেন। রাতে খেলার জন্য আলোর ব্যবস্থা করতে হলে অবশ্যই ইলেক্ট্রিশিয়ানের সাহায্য নেয়া উচিৎ। ’
আশে পাশের বাড়ি থেকে অনেক অভিযোগ থাকলেও তাতে কর্ণপাত করছেন না জাফর-মাইশারা। খেলা নিয়ে তারা কোনো অযুহাত শুনতে রাজি নন। বিপ্লব নামের ১০ কি ১২ বছর বয়সী এক খুদে খেলোয়াড় তার বার্তাও শুনিয়ে দিলেন এভাবে, ‘আমরা সবসময় খেলার সুযোগ পাই না। শীতের সময় স্কুল বন্ধ থাকায় লেখাপড়ার চাপটা একটু কম। বাবা-মার অনুমতি নিয়েই তো কোর্টে এসেছি। যারা অভিযোগ করছেন, তারা হয়তো আমাদের বেয়াদব মনে করছেন যে আমরা কথা শুনি না। যারা অভিযোগ করেন তাদের ছেলে-মেয়েরাও কিন্তু এইখানে খেলে। ’
শহুরে জীবনে একটু খোলা পরিবেশে হাঁটার জায়গাই যেখানে নেই, সেখানে ব্যাডমিন্টনের জোগাড়যন্ত্র করাটা কঠিন বৈকি। তারপরও রাজধানীর মানুষ ক্রিকেট ও ফুটবলে বেশি আগ্রহী হলেও ব্যাডমিন্টন নিয়ে উৎসাহ উদ্দীপনা কোনো অংশেই তাদের কম নয়। নগরায়ণ, আধুনিকতা, প্রযুক্তির ব্যবহারে খোলসবন্দি হয়ে পড়লেও বরং শীতকাল আসলেই এই খেলাটি সব খেলাকে ছাপিয়ে যায়।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৩৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৮, ২০১৯
এমআরপি