ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

ট্রাভেলার্স নোটবুক

লাল-সবুজের মরণজয়ী অভিযান

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৫৮ ঘণ্টা, জুন ৩, ২০১৬
লাল-সবুজের মরণজয়ী অভিযান

২৭ এপ্রিল ২০১২, রৌদ্রজ্জ্বল এক সকাল। ঘড়িতে বাজে ১০টা।

দুই বাংলাদেশি পর্বতারোহী এমএ মুহিত আর নিশাত মজুমদার শেরপাদের সঙ্গে চলেছেন এভারেস্টের পথে এক থেকে দুই নম্বর ক্যাম্পে। একসময় তারা এসে পৌঁছালেন ওয়েস্টার্ন কুম-এ। মোটামুটি সমতল মাঠের মতো জায়গা। উপর থেকে গোলাকার থালার মতো দেখা যায় বলে এডমন্ড হিলারি এ নাম রেখেছিলেন।

চারপাশেই পৃথিবীখ্যাত সব শৃঙ্গ, এভারেস্ট, লোৎসে, নুপসে। পানি খাওয়ার জন্য একটু দাঁড়ালেন তারা। এমন সময় খেয়াল করলেন অনেক দূরে নুপসের চূড়া থেকে ছোট কিছু বরফ খণ্ড নেমে আসছে। অত আমলে নেওয়ার কিছু নেই ভেবে নিশ্চিন্তে ছবি তোলা আর পানি খাওয়ার পর্ব চলতে লাগলো। হঠাৎ করে শেরপা চিৎকার করে উঠলো সেফটি সেফটি বলে। ছোট সেই ধস রূপ নিয়েছে বিশাল এক বরফ ধসে। মুহূর্তের মধ্যে পরিস্থিতি পাল্টে গেলো। মুহিতসহ শেরপারা দড়িতে নিজেদের বেঁধে নিলেও নিশাত মজুমদার বরফ সৃষ্ট বাতাসের তোড়ে উড়ে গেলেন।

কিছুক্ষণ পর বরফ ধস বন্ধের পর খোঁজাখুঁজি করে নিশাতকে পাওয়া গেলো পাশের এক অতল খাদের কিনারায় রক্তাক্ত অবস্থায়। আর এক হাত দূরেই সে হা করে বসে আছে গিলবার আশায়। সেই অভিযানেই আরেকবার বেঁচে যান তারা। তিন নম্বর ক্যাম্পে একটু ঝুলন্ত হিমবাহের বিশাল অংশ গড়িয়ে গড়িয়ে নিশাত মুহিতদের তাবুর উপর দিয়ে পাশের তাবুতে আঘাত হানে। গুরুতর আহত হন সেই তাবুতে থাকা শেরপা।

কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই আবার ফিরে এসে স্পর্শ করেছিলেন পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এভারেস্টের চূড়া। প্রথম বাংলাদেশি নারী ও পুরুষের যৌথ দল পৃথিবীর চূড়া অহংকে পদানত করে উড়িয়ে দিলেন প্রিয় লাল-সবুজ পতাকা। বাঙালি নাকি চিরকালের ঘরকুনো। হিমালয়ের কঠিন রুক্ষ আবহাওয়ায় টিকে থেকে শৃঙ্গ ছোঁয়ার যে মহাকাব্যিক গল্প তা অনেকদিন শুধু বিদেশি অভিযাত্রীদের বই পড়েই জানতে হয়েছে বাঙালিকে।

এ দেশে আনুষ্ঠানিক পর্বতারোহণের শুরু ২০০৩-০৪ সালের দিকে। ইনাম আল হকের নেতৃত্বে বাংলা মাউন্টেনিয়ারং অ্যান্ড ট্রেকিং ক্লাবের (বিএমটিসি) প্রতিষ্ঠার পরপরই স্বপ্ন দেখা শুরু হিমালয় জয়ের। সেই যে শুরু হলো স্বপ্নযাত্রা, তা এখনো এগিয়ে চলেছে দুর্বার গতিতে। মাঝের বছরগুলিতে লাল-সবুজ পতাকা পৌঁছে গেছে পৃথিবীর সর্বোচ্চ বিন্দুতে, উত্তর মেরুতে। অসংখ্য ছোট বড় অভিযানের মাধ্যমে বিএমটিসি এই মুহূর্তে দেশের প্রধানতম অ্যাডভেঞ্চার সংগঠন।

শুরুর দিকে ছোট ছোট অভিযান, ট্রেকিংয়ের মাধ্যমে দেশের অনভ্যস্ত তারুণ্য পরিচিত হতে থাকেন পর্বতের ভিন্ন আবহাওয়ার সঙ্গে। কেমন ছিলো শুরুর সেসব দিন। ‘আমরা প্রথমে একটি লক্ষ্য ঠিক করেছিলাম। এভারেস্ট অভিযান চূড়ান্ত লক্ষ্য হলেও তার প্রস্তুতি নিতে যে ধরনের শারীরিক ও মানসিক ক্ষমতাসম্পন্ন পর্বতারোহীর প্রয়োজন, আমরা তাদের তৈরি করার দিকে মনোযোগ দিলাম। ২০০৪ সালে এভারেস্ট বেস ক্যাম্প পর্যন্ত ট্রেকিংয়ের পর পর্বতারোহণের আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব হলো। ভারতের পর্বতারোহণ ইনস্টিটিউটে প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর মূলত ২০০৬ সালে সিকিম হিমালয়ের ফ্রে পিক আরোহণের মধ্য দিয়ে শুরু হলো অভিযান। ”

বলছিলেন এ দেশের পর্বতারোহণের স্বপ্নদ্রষ্টা ইনাম আল হক। তবে এর পূর্ণতা আসে ২০০৮ সালে পৃথিবীর অষ্টম উচ্চমতম পর্বত মানাসালুতে এমএ মুহিতের অভিযানের মাধ্যমে। বৈরী আবহাওয়ার কারণে সে অভিযান সফল না হলেও খুলে যায় নতুন সম্ভবনার দ্বার। আট হাজার মিটার উচ্চতাবিশিষ্ট পর্বত পৃথিবীতে আছে মাত্র ১৪টি। উচ্চতাজনিত অসুস্থতা, ভয়ংকর খাড়াই, বরফ ধসের কারণে এসব পর্বতে আরোহণ করা সবচেয়ে কঠিন।

মৃত্যুর হারও এখানে অনেক বেশি। কিন্তু থেমে থাকেননি এমএ মুহিত। চালিয়ে গেছেন নিরন্তর প্রচেষ্টা। এরই ফল আসে ২০০৯ সালে। প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে আট হাজার মিটারের উপরে পৃথিবীর ষষ্ঠ উচ্চতম পর্বত চৌ ইয়োর চূড়ায় দেশের পতাকা ওড়ান তিনি। এরপর ২০১১-১২ এবং ১৩ সালে পরপর তিন বছর এভারেস্টে দেশের পতাকা উড়ান এমএ মুহিত, নিশাত মজুমদার, ওয়াসফিয়া নাজরীন ও সজল খালেদ। চূড়া থেকে ফিরে আসার পথে প্রাণ হারান সজল।

কেমন হয় পর্বতের পরিবেশ? কেনইবা যান সেই মৃত্যুর পথে? এই প্রশ্নের একেবারে সোজাসাপ্টা কোনো জবাব নেই। কারও রক্ত মিশে না গেলে বারবার প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে পাহাড় চূড়ায় যাওয়া সম্ভব না। তবে চূড়ায় পৌঁছার পর দেশের পতাকা যখন উঁচিয়ে ধরি সেই মুহূর্তটি কিন্তু অসম্ভব আবেগের। হয়তো এ জন্যই যায়।

‘পর্বতারোহণ করে আমার তো আর্থিক লাভের কোনো ব্যাপার নেই। এসব অভিযানের খরচও প্রচুর। এদেশে পৃষ্ঠপোষকেরও অভাব আছে। উপরন্তু বেশ কয়েকবার মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেছি। ২০১০ এর তিব্বত দিক থেকে এভারেস্ট অভিযানের সময় আমি একটি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা পেরিয়ে আসার কিছুক্ষণ পরই সেখানে বরফ ধসে তিনজন আরোহী মারা যান। পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম পর্বত কাঞ্চনজঙ্ঘা অভিযানে আমার সঙ্গে বেশ কিছু আরোহী মারা গিয়েছিলেন। বেঁচে গিয়েছিলাম পরিস্থিতি আঁচ করে আগেই নেমে আসায়। ’

দেশের সবচেয়ে অভিজ্ঞ পর্বতারোহী এম এ মুহিতের জবানীতে বোধহয় পাওয়া গেলো পর্বতাভিযানের নেপথ্য কারণ। ২০১০ সালে হিমালয়ের একটি দুর্গম চূড়ায় বাংলাদেশ ও নেপালের যৌথ অভিযান হয়। সে চূড়াটিতে এর আগে কোনো মানুষের পদচিহ্ন পড়েনি। অভিযান সফল হওয়ার পর সেই চূড়ার নামকরণ করা হয়েছিলো নেপাল বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ পিক। সেই অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন বিএমটিসির আরেক পর্বতারোহী কাজী বিপ্লব।

‘সেবার পাহাড়ের ঢালে পিছলে পড়ে গড়িয়ে যেতে থাকে। একটু নীচের পাহাড়ের অতল খাদ। একেবারে পাঁচ-ছয় হাজার ফুট নীচে পড়ে নিশ্চিত মৃত্যৃ। বারবার হাতে থাকা আইস অ্যাক্স দিয়ে নীচের পতন ঠেকানোর চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু বরফ এত শক্ত ছিলো যে তা আটকাচ্ছিলো না। একেবারে শেষ মুহূর্তে গিয়ে কোনো রকম আইস অ্যাক্সটি বরফে আটকালো আর আমি বেঁচে গেলাম। ’

পর্বত চূড়ায় দেশের পতাকা ওড়াতে তারুণ্যের এ প্রাণের মায়া ত্যাগের উদাহারণ ভুরি ভুরি। তার ফলও এসেছে হাতেনাতে। শুধু বিএমটিসিরই পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে করা ২৬টি অভিযানের মধ্যে সফলতা এসেছে অর্ধেকেরও বেশি অভিযানে। উত্তর মেরুসহ পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্গম ১৪টি পর্বতের মধ্যে তিনটি পর্বতে উড়েছে লাল-সবুজ পতাকা। এই তিনটি পর্বতেই ছিলেন অভিযাত্রী এমএ মুহিত ও নিশাত মজুমদার। এছাড়া ছয় হাজার মিটারের আটটি পর্বত হয়েছে পদানত। বিএমটিসি ছাড়াও আরও কয়েকটি ক্লাব এবং ব্যক্তি পর্যায়ে এ দেশের পর্বতারোহীরা চালিয়ে যাচ্ছেন অভিযান। এর মধ্যে ওয়াসফিয়া নাজরীন পৃথিবীর সাতটি মহাদেশের সর্বোচ্চ সাতটি চূড়াতেই উড়িয়েছেন বাংলাদেশের পতাকা।          

বাংলাদেশ সময়: ১৯৫৫ ঘণ্টা, জুন ০৩, ২০১৬
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।