ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

চলনবিলের শুটকিতে নারীর হাতের জাদু

আসিফ আজিজ ও শুভ্রনীল সাগর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৩৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৬, ২০১৬
চলনবিলের শুটকিতে নারীর হাতের জাদু ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

নিঙ্গুইন (নাটোর) থেকে ফিরে: সেই ভোরের আলো ফোটা থেকে শুরু হয় কর্মযজ্ঞ। মাছে লবণ মাখানো, মাপজোখ করা, বহন করে মাচায় নেওয়া, উল্টে-পাল্টে নাড়া, বাছাই করা- আরও কত কাজ! আর এ সব কাজই হয় নারীর হাতে।

মহাজন কেবল মাছ কিনেই দায় মুক্ত।
 
নাটোর শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে সিংড়া উপজেলা। সিংড়া ব্রিজ সংলগ্ন বাজার থেকে কিলোমিটারখানেক আগের গ্রাম নিঙ্গুইন। চলনবিলের মিষ্টি পানির মাছের শুটকির জন্য বেশ নাম আছে জায়গাটির। মৌসুমে রাস্তার পাশের বিশাল এলাকাজুড়ে বসে শুটকি মাছ তৈরির কারখানা। আশপাশের গ্রামের নারীই প্রাণ এ শুটকিপল্লীর।
 
চলনবিলের অধিকাংশ মাছ চলে আসে জেলা-উপজেলা সদরের আড়ৎ ও বাজারে। সেখান থেকে পাইকাররা শুটকির জন্য কিনে আনেন শত শত মণ মাছ। তবে জানুয়ারি মাছের পড়তি মৌসুম। তাই চাপ কম।
 
ভাদ্র থেকে মাঘ মাস পর্যন্ত চলে শুটকির মাছ সংগ্রহ। বর্ষার পানিতে চলনবিলাঞ্চলে যেসব মাছ বেড়ে ওঠে সেসব মাছ ধরা চলে এসময় পর্যন্ত। এখন মৌসুম প্রায় শেষ।   বিলের পানি শুকিয়ে যাওয়ায় এখন শুরু হচ্ছে ফসল বোনা। তাই দিনে সংগ্রহ ১০-১২ মণ মাছ। মৌসুমে এটা গিয়ে দাঁড়ায় ৩৫-৪০ মণে। জানালেন শুটকিপল্লীর মালিকদের একজন রাশেদুল।
 
সরকারি জায়গা লিজ নিয়ে চালানো এ পল্লীতে এখন কাজ করছেন জনা চল্লিশেক নারী। মৌসুমে এক হাজার নারী কাজ করেন।
 
মাছ মাপজোখের পর মাখানো হয় লবণ। এটা মাছ দ্রুত শুকাতে সাহায্য করে, তাছাড়া মাছ ভালোও রাখে। লবণ মাখানো হলেই কাঁখে করে নারীরা নিয়ে যান মাচায়।
 
মাচায় নেওয়ার পর মাছগুলো সুন্দর করে পাতিয়ে রোদমুখী করা হয়। এ কাজটিও করেন নারীরাই। শুধু রোদে দেওয়া নয়, সারাদিন তাদের কাজ কয়েকবার উল্টে-পাল্টে দেওয়া।
 
রোদ কম থাকলে শুকাতে লাগে তিন-চারদিন। আবার রোদ বেশি থাকলে একদিনেই শুটকি হয়ে যায়। তবে বড় কিছু মাছে আবার একটু সময় লাগে।
 
এখানে শুটকি করা হয় শোল, বোয়াল, রায়েক, খলিসা, পুঁটি, গুঁচি, টেংরা, চান্দা, বাতাসি, কাকিলা, বেলে, মলা, ইচা, টাকি প্রভৃতি মাছ। পুঁটি মাছের আধিক্য থাকে বেশি।
 
লিপি, রাশিদা, ইতির মতো নারীরা এখানে কাজ করেন সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। মজুরি সে তুলনায় কমই বলতে হবে। ১১০ টাকা প্রতিদিন। মৌসুমে আরও বেশি সময় থাকতে হয়।
 
মাচায় মাছ নাড়তে নাড়তে রাশিদা বলেন, কাজ করতে ভালোই লাগে। কিন্তু অনেক সুময় দেওয়া লাগে। তার তুলনাত মজুরি খুব বেশি পাই ন্যা। যা পাই তা দিয়্যা সোংসার একটু ভালো মুতন চলে। তাই স্বামী কাম কোরলেও কামেত আসি।
 
কাঠের একটি হাতল দিয়ে পরম মমতায় মাছ নাড়তে দেখা গেলো তাকে। একটু শুকনো মাছগুলো থেকে আলগা আঁশটে ফেলার দারুণ ‘আর্ট’ আছে তার।
 
রাস্তার পাশে কতগুলো অস্থায়ী খোলা ঘরে চলে মাছ বাছাইয়ের কাজ। সেখানে কাজ করছেন ইতি, লিপিসহ কয়েকজন। ছোট-বড়, ভালো-মন্দ মাছ বাছাই করাই তাদের কাজ। মহাজনের চেয়ে তারাই ভালো জানেন এ বিষয়ে।
 
মহাজন জাকির জানান, পুঁটি ৪০-৮০ টাকায় কিনে শুটকি করে বিক্রি করেন ২৫০-৩৫০ টাকায়, রায়েক কেনা ৪০-৬০, বিক্রি ৮০-১৪০, খলিসা ২০-৪০ টাকায় কিনে বিক্রি ৭০-৮০ টাকায়। বোয়াল কেনা ১০০-১২০, বিক্রি ৫০০-৬০০, শোল ৮০-১০০ টাকায় কিনে বিক্রি ৫০০-৫৫০ টাকায়। চান্দা ৩০-৩৫ টাকা কেনা, বিক্রি ১০০-১২০।
 
লিপি জানালেন, শোল আর বুয়াল শুকাতে একটু বেশি সুময় লাগে। এই মাছগুলান কাইটে শুকাবার দিতে হয়। এগল্যান মাছেত মাংসও বেশি থাকে।
 
নারীর মমতাময়ী হাতে তৈরি মিষ্টি পানির এ শুটকি নাটোর, রংপুর, সৈয়দপুর, নীলফামারী প্রভৃতি এলাকায় যায় বেশি। ঢাকাসহ অন্য জেলায় আসে খুব কম।
 
এ শিল্প স্বাবলম্বী করেছে গ্রামের অনেক নারীকে। বছরের ছয় মাস অন্তত তাদের কাজের অভাব থাকে না। গ্রামীণ অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে তারাও রাখছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এই ছয়মাস তাদের মাছ কেনাও লাগে না। মহাজন নিয়মিত খেতে দেন। তাতে কম মজুরিতে কাজ করেও খুশি তারা। অন্তত মাছ তো কেনা লাগে না!
 
গ্রামের সরল এসব নারী অল্পতেই তুষ্ট। তাই সারাদিন বিরামহীন খেটেও মুখে কষ্টের কথা নেই। মহাজনরা সবসময় ভালোই থাকেন। তবে এই নারীরাই দৃঢ় কর্মদক্ষতায় তাদের ভালো রাখেন।
 
বাংলাদেশ সময়: ০৮৪০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৬, ২০১৬
এসএস/এএ/এটি

** ‘পাকিস্তানিরাও সালাম দিতে বাধ্য হতো’
** মহিষের পিঠে নাটোর!
** চাঁপাইয়ের কালাই রুটিতে বুঁদ নাটোর
** উষ্ণতম লালপুরে শীতে কাবু পশু-পাখিও!
** পানি নেই মিনি কক্সবাজারে!
** টিনের চালে বৃষ্টি নুপুর (অডিওসহ)
** চলনবিলের রোদচকচকে মাছ শিকার (ভিডিওসহ)
** ঘরে সিরিয়াল, বাজারে তুমুল আড্ডা
** বৃষ্টিতে কনকনে শীত, প্যান্ট-লুঙ্গি একসঙ্গে!
** ভরদুপুরে কাকভোর!
** ডুবো রাস্তায় চৌচির হালতি
** হঠাৎ বৃষ্টিতে শীতের দাপট
** ঝুড়ি পাতলেই টেংরা-পুঁটি (ভিডিওসহ)
** শহীদ সাগরে আজও রক্তের চোরা স্রোত
** ‘অলৌকিক’ কুয়া, বট ও নারিকেল গাছের গল্প
** মানবতার ভাববিশ্বে পরিভ্রমণ
** সুধীরের সন্দেশ-ছানার জিলাপির টানে
** নতুন বইয়ে নতুন উদ্যম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে এর সর্বশেষ