ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

বিষখালীর বাঁকে মরে আছে ধানসিঁড়ি

জাকারিয়া মন্ডল, আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭১১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০১৬
বিষখালীর বাঁকে মরে আছে ধানসিঁড়ি ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ধানসিঁড়ি মোহনা: বিষখালীর বাঁকে এসে বিস্ময়ে বিমূঢ় হওয়ার দশা। হাতের বাঁয়ে নিশ্চল ওই জলধারা যে ধানসিঁড়ির মোহনা তা চিনিয়ে না দিলে বুঝে ওঠারই জো নেই।

স্রোত হারিয়ে মরে গেছে ধানসিঁড়ি। শুকনো মৌসুমে স্টিমার-লঞ্চ তো দূরের কথা, নৌকাও চলে না। মাছ খেতে আসে না সোনালি ডানার চিল।

এমন মরা নদীতে নিশ্চয়ই ফিরে আসতে চাইবেন না প্রকৃতিপ্রেমী জীবনানন্দ। তার ধানসিঁড়ি এখন আর রূপসী বাংলার রূপ নয়, রূপ হারানো হাহাকার।

বিষখালীতে সুগন্ধার পতিত মুখ থেকে বিপরীত দিকে গাবখান চ্যানেল ধরে একটু এগুলেই বাঁয়ে মৃত ধানসিঁড়ি।

এই ধানসিঁড়ি আর বিষখালী নিয়ে লোকমুখে চালু রয়েছে বেশ মজার এক উপকথা। একদা এক ঋষি থাকতেন এ এলাকায়। সবসময়ই তিনি থাকতেন ধ্যানমগ্ন। কিন্তু এক গৃহস্থের রক্ষিতা এসে তার ধ্যান ভাঙিয়ে দেয়।
 
ঋষির ধ্যান ভাঙিয়ে ওই নারী যে পথ দিয়ে হেঁটে যায় সেদিক দিয়ে এক স্রোতধারা তৈরি হয়। স্থানটি জঙ্গলাকীর্ণ বলে ওই স্রোতের নাম হয়ে যায় জাঙ্গালিয়া নদী।

এদিকে ধ্যান ভাঙার পর ঋষি তার ভুল বুঝতে পারেন। তখন তিনি যে নিঃশ্বাস ছাড়েন তাতে বেরিয়ে আসে স্রোতের প্রবাহ। পরে তিনি বিষ উঠিয়ে নিলে সদ্যসৃষ্ট স্রোতের নাম হয়ে যায় বিষখালী নদী।

কিন্তু এরপর ওই ঋষির জীবনে দেখা দেয় আর এক হ্যাপা। কিছুতেই আর ধ্যানমগ্ন হতে পারেন না তিনি। এভাবে কেটে যেতে থাকে বছরের পর বছর। তার চোখ থেকে ঝরতে থাকে উত্তপ্ত জল। সেই উত্তাপে আর একটি নদী তৈরি হয়। সিদ্ধ হয়ে যায় নদীপথের সব ধান। নদীটির নাম হয় ধানসিদ্ধ। পরবর্তীতে রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ যার নাম রাখেন ধানসিঁড়ি।

বিষখালী নদীর মোহনা থেকে শুরু হয়ে মাঝখানে জাঙ্গালিয়া নদীর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আবার বিষখালীতেই ধানসিঁড়ির শেষ।

ধানসিঁড়ি মোহনার উল্টোদিকে ইকোপার্কের জন্য নির্ধারিত গাছঘেরা খোলা জায়গাটা খেলার মাঠের মতো খালি পড়ে রয়েছে। জমি নিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে রফা না হওয়ায় প্রকল্প আটকে রয়েছে।

এই ইকোপার্ক আর ধানসিঁড়ি মোহনার মাঝখান দিয়ে নাক বরাবর সোজা এগিয়ে গেছে গাবখান চ্যানেল।

দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে খুলনা বন্দরের দূরত্ব কমাতে ১৮০০ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের উদ্যোগে এ চ্যানেল খনন করা হয়। মংলা বন্দরের সঙ্গে দূরত্ব কমে যায় বরিশালসহ চট্টগ্রাম বন্দরের। তখন থেকেই এর নাম হয়ে যায় বাংলার সুয়েজ। স্থানীয় উচ্চারণে যাকে বলা হয় সুইস।

২০০১ সালে এর ওপরে নির্মিত হয় পঞ্চম চীন-বাংলাদেশ মৈত্রী সেতু।  

চ্যানেলের দু’পাশে জোয়ারের পানিতে বেশ খানিকটা ডুবে রয়েছে হোগলা গাছের ছোট ছোট ঝোপ। যেনো স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে, আরও অনেক কিছুর মতো এটি শীতল পাটিরও দেশ। এই হোগলায় শত শত বছর ধরে শীতল পাটি বুনে আসছে ধানসিঁড়ি তীরের গ্রাম হাইলাকাঠি ও এর আশপাশের মানুষ। এখনও এ গ্রামের কয়েকশো মানুষের জীবিকা শীতল পাটি বোনা।

এ অঞ্চলের সব ক’টি নদীর পানিই জোয়ারে ফুলে পাড় ছুঁই ছুঁই করে। নদীর পাড়ে তাই মসজিদের ওজুখানা আর বাসাবাড়ির ঘাট চোখে পড়ে হরহামেশা।

দুই পাড়ে সারি সারি চাম্বল, মেহগনি, রেইনট্রি। মাঝে মধ্যে কড়াই, নারকেল, সুপারি, খেজুর আর তাল গাছ। ঝাঁকড়া গাছ এখানে-ওখানে পাড় থেকে ঝুঁকে এসে চুমো খাচ্ছে নদীতে। ঘাট থেকে হাত নাড়ছে শেষ বিকেলে বাড়ি ফিরতি স্কুল পড়ুয়ারা।

আশেপাশেই কোথাও রয়েছে দেশের বৃহত্তম ভাসমান পেয়ারার বাজার, উৎপাদন ভূমি। শত শত নৌকায় করে বিকিকিনি চলে পেয়ারার মৌসুমে।
 
ধানসিঁড়ি মোহনা থেকে শুরু হওয়া গাবখান চ্যানেল ধরে এগিয়ে সন্ধ্যা নদীতে বেরিয়ে আসতেই দু’পাশে অনেক দূরে সরে গেলো পাড়। ডানে পাড়লো কাউখালি ফেরি ঘাট। হঠাৎ কোথা থেকে তিনটি কাক এসে আয়েশে বসলো জাহাজের মাস্টার ব্রিজের সামনের ডেকে। পাখা ঝাপটে নরম পায়ে কয়েক মুহূর্ত খেললো। খাবার খুঁজলো বোধ হয়। তারপর উড়াল দিলো জাহাজের নাক বরাবর সামনে। কাউখালীতে এসে কাউয়া বা কাকের এমন আচরণের কী হেতু কে জানে।

গাবখান চ্যানেলের মতো সন্ধ্যা নদীতেও স্রোত কম। প্রশস্ত প্রবাহ জুড়ে থোকা থোকা কচুরিপানা আয়েশে ভাসছে। সব মিলিয়ে যেনো, নদী নয় বিলের মতো আবহ। জাহাজকে এগুতে হলো কচুরিপানা দলেই।
 
সন্ধ্যা শেষে শুরু হলো কচা। তবে নদীর দৃশ্যে কোনো পরিবর্তন হলো না। মাথার ওপরে চাঁদ আকারের তেজহীন লাল সূর্যটা ঝুলছে। নদীর পানিতে তার অস্ত দেখবেন বলে সেই বিকাল চারটা থেকে মাস্টার ব্রিজের সামনের ডেকে এসে বসে আছেন সময় টিভির চিফ নিউজ এডিটর জাকারিয়া মুক্তা। কিন্তু তাকে হতাশ করে দিয়ে সোয়া পাঁচটা নাগাদ সূর্যটাকে আড়াল করে নিলো মেঘের দল।

কচা পেরিয়ে রাত পৌনে আটটার দিকে জাহাজ যখন বলেশ্বরে পড়লো তখন জোর বাতাস ‍উঠেছে। দূরে দূরে ছোট ছোট জেলে নৌকার টিমটিমে আলো নজরে এলো বটে, কিন্তু বড় কোনো নৌযান চোখে পড়লো না। জাহাজের ইঞ্জিনের শব্দ ঢাকা পড়ে যাচ্ছে হু হু হাওয়ায়।

কাল রাতে আকাশ ছিলো গোমড়ামুখো। আজ আকাশ ভরে উঠলো তারায় তারায়। মাথার ওপরে সপ্তর্ষি মণ্ডলকে ঝুলতে দেখে অচেনা পরিবেশটাকে হঠাৎ চেনা মনে হলো।

সেই ছেলেবেলায় বাড়ির উঠোনে দাঁড়ালেই আকাশ থেকে হাতছানি দিতো এই তারার দল।

বলেশ্বরের কিছু অংশ বেয়ে শরণখোলা খালে আসতেই জেঁকে বসলো কুয়াশা। কয়েক হাত দূরেও দৃষ্টি চলে না। যেনো সাদা চাদরে ঘিরে রাখা হয়েছে জাহাজটিকে। আর জাহাজ লাগোয়া পানিও নিয়েছে ঝাপসা রূপ। সুন্দরবন এলাকায় প্রবেশ করেও কুয়াশার বাগড়ায় মন খারাপ হয়ে যায়। খালের দু’পাড়ে ম্যানগ্রোভ গাছের সারি যে পানি ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে, জাহাজ থেকে তা বুঝে ওঠা সম্ভবই নয়।
 
সুপতি যাওয়ার তিন কী চার ঘণ্টা আগে তাই শরণখোলা খালে নোঙর ফেলতে হলো বাধ্য হয়েই।
 
বাংলাদেশ সময়: ১৭০৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০১৬
জেডএম/এসএস

** বরিশাল ছুঁয়ে সুগন্ধার পথে
** নদীর বুকে আলোর ভেংচি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে এর সর্বশেষ