ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

স্বামীর ওয়াদা রক্ষায় ছেঁড়া দ্বীপে বসবাস রহিমার

তাসনীম হাসান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০১৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ৮, ২০১৬
স্বামীর ওয়াদা রক্ষায় ছেঁড়া দ্বীপে বসবাস রহিমার ছবি: সোহেল সরওয়ার-বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ছেঁড়া দ্বীপ, সেন্টমার্টিন থেকে: সকাল সাড়ে ১১টা। বঙ্গোপসাগর তখন উত্তাল।

ঢেউয়ের পর ঢেউ এসে ছেঁড়া দ্বীপের ঠিক মাঝখানের কেওড়া গাছের গুঁড়িগুলো ছুঁয়ে যাচ্ছে। কখনও তা ডুবেও যাচ্ছে।

সেন্টমার্টিনের মূল পয়েন্ট থেকে দক্ষিণে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে সাগরে অবস্থান ছেঁড়া দ্বীপের। এই দ্বীপে মিষ্টি পানি আছে? এমন প্রশ্নের জবাব হবে-‘নেই’। ধান, শাক-সবজি? সেটাও ‘নেই’। ‘নেই’ শব্দটি এই দ্বীপের যুৎসই প্রতিশব্দ বলা যায়। অনেক কিছু না থাকার মধ্যেও দ্বীপটিতে বসবাস করছে একটি পরিবার। যে পরিবারের সদস্য সাতজন।

জীবিকার প্রয়োজনে ১৯৯৭ সালে স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে সেন্টমার্টিন থেকে ছেঁড়া দ্বীপে বসবাস করতে আসেন হোসেন আলী নামে এক জেলে। তারপর এ দ্বীপেই হোসেন আলীর স্ত্রী জন্ম দিয়েছেন আরও তিন সন্তান। মাঝখানে কেটে গেছে ১৮টি বছর। অন্য কেউ আসেনি ছেঁড়া দ্বীপে স্থায়ী বসবাস করতে। কিন্তু তারা আছেন, থাকবেন ‘আমৃত্যু’, একটি ‘ওয়াদা রক্ষা’য় দায়বদ্ধ বলে।

হোসেন আলী পৃথিবী থেকে গত হয়েছেন। গত সাড়ে ৩ বছর ধরে তিনি কেবলই ছবি। ছেঁড়া দ্বীপের তার গড়া ছোট্ট ভাঙাচোরা বাড়িটির দিকে তাকালেই চোখে পড়বে- ‘হোসেন আলী, মোবাইল নম্বর- ০১৮১৫০...’ সংবলিত একটি সাইনবোর্ড।

বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল হোসেন আলীর সেজো ছেলে গিয়াস উদ্দিনের সঙ্গে। পাশে তার মা অর্থাৎ হোসেন আলীর স্ত্রী রহিমা খাতুন (৫০)। পরিবারের খোঁজখবর জানতে চাইলে প্রথমেই গিয়াস উদ্দিন বলে ওঠেন, ‘পরিবারে আটজন’। পরক্ষণেই বেশ নিচু গলায় বলেন, ‘বাবাসহ আটজন। বাবা চলে গেছেন ২০১৩ সালে। এখন সাতজন। ’

কিছুই তো নেই, তবুও কেন ঝুঁকি নিয়ে এই দ্বীপে থাকা? এই প্রশ্নের উত্তর দেন রহিমা খাতুন। বলেন, ‘স্বামী চলে যাওয়ার আগে আমাকে ওয়াদা করিয়েছিলেন। বলেছিলেন, তুমি যদি সত্যি-সত্যি আমার সংসারকে ভালোবাসো, তাহলে আমার মৃত্যুর পরে তুমি কখনও এই দ্বীপ ছেড়ে চলে যেতে পারবে না। আমার সন্তানদের নিয়ে তুমি মৃত্যু পর্যন্ত এই দ্বীপ দেখাশোনা করবে। এই দ্বীপকে আমি বড় বেশি ভালোবাসি। ’

সেন্টমার্টিন দ্বীপে বাবার বাড়ি আছে, আছে স্বামীর ভাইদের বাড়িও। চাইলে সেখানে থাকতে পারতেন রহিমা। এখানে বেশ কষ্ট-সংগ্রামের জীবন তার। তবু স্বামীর সেই ওয়াদা রক্ষার জন্যই সব কষ্ট সহ্য করে ছয় সন্তানকে নিয়ে থাকছেন। মৃত হোসেন আলীর ছয় সন্তানের মধ্যে চার ছেলে, দুই মেয়ে। দুই ছেলে আর এক মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে।

আলাপে আলাপে ছবি ওঠানো হচ্ছিল ক্যামেরায়। কিন্তু পর্দানশীন বলে ছবি তুলতে চাননি রহিমা খাতুন। মা-ছেলে জানাচ্ছিলেন, ছেঁড়া দ্বীপে ছোট্ট একটা দোকান আছে তাদের। সেই দোকানই জীবন-জীবিকার প্রধান অবলম্বন।

হোসেন আলীর মোবাইল ফোনটা ব্যবহার করেন এখন বড় ছেলে সাদ্দাম হোসেন। তিনি বলেন, পর্যটন মৌসুমের সময় এই দোকান থেকে লাভ হওয়া টাকাতেই চলে যায় পুরো বছর। সেই দোকানে ডাব থেকে শুরু করে নানা রকমের পানীয় বিক্রি হয়। সঙ্গে আছে মাছ ফ্রাই, ভাত খাওয়ার ব্যবস্থাও।

টেকনাফ ও সেন্টমার্টিন থেকে মালপত্র এনে নিজেদের দোকানে বিক্রি করেন বলেও জানান সাদ্দাম।

বর্ষাকালে তো সাগর উত্তাল থাকে, তিন নম্বর সংকেত দিলেই তো যোগাযোগ বন্ধ, তখন কী করেন? সাদ্দাম হোসেন বলছিলে, ‘বর্ষার শুরুতেই তিন মাসের জন্য একেবারে বাজার করে নিয়ে আসি। তারপর তিনমাস চলি। খাওয়া আর গোসল করার পানিটাও সেন্টমার্টিন থেকে আনি। ’

তবে, জলোচ্ছ্বাস-ঘূর্ণিঝড়ের সময় সাদ্দামরা চলে যান সেন্টমার্টিনে চাচা-মামাদের কাছে। তিনি বলছিলেন, ‘রেডিওতে সবসময় খবর শুনি। এরমধ্যে সেন্টমার্টিন থেকে আমার চাচা-মামারাও খবর দেন। তারা সেখানে চলে যেতে বলেন এবং সেন্টমার্টিন থেকে ট্রলার পাঠান। তাতে চড়ে আমরা চলে যাই সেখানে। জলোচ্ছ্বাস-ঘূর্ণিঝড় থামলে আবার ফিরে আসি এই দ্বীপে। ’

রহিমা-সাদ্দামদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হোসেন আলী হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন। ২০১৩ সালের কথা। সুস্থ-সবল হোসেন আলী ফিরছেন চট্টগ্রাম শহর থেকে। সঙ্গে বড় মেয়ে মৌসুমী। জাহাজ থেকে সেন্টমার্টিন দ্বীপে যখন নামলেন তখনও বেশ ভালো তিনি। হাসিখুশি মুখ। খাবারও খেলেন দুপুরে। দ্বীপে বসবাস করা আত্মীয় স্বজনদের বিদায় দিয়ে প্রিয় ছেঁড়া দ্বীপে ফিরবেন। হঠাৎ বুকে ব্যথা শুরু হলো তার। সেই ব্যথা থেকেই হার্ট অ্যাটাক, তারপর না ফেরার দেশে।

হোসেন আলী মারা যাওয়ার পর রহিমা খাতুনকে তার ভাইয়েরা বলেছিলেন, ‘চল সেন্টমার্টিনে, আমাদের সঙ্গেই থাকবি। ’ রহিমা খাতুন তখন ভাইদের বলেন, ‘আমার স্বামীর ওয়াদা ভাঙতে পারবো না। আল্লাহ আমার মৃত্যুটা এই দ্বীপেই দিক-সেটিই চাই আমি। ’

রহিমা-সাদ্দামদের সঙ্গে কথার বলার সময় সঙ্গী কেউ একজন বলছিলেন, সাগরের মধ্যে বিচ্ছিন্ন এই ছেঁড়া দ্বীপে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস আর মৃত্যুর ভয় উপেক্ষা করে থাকাটা রূপকথার গল্পের মতো। আধুনিক এই যুগে কেবল স্বামীর ওয়াদা রক্ষার জন্যই পুরো পরিবারকে নিয়ে বসবাস তো তার চেয়েও বেশি কিছু।


বাংলাদেশ সময়: ২০০৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৮, ২০১৬
টিএইচ/টিআই/এইচএ/

** ১৮ কোটি টাকার মেরিন পার্ক ১০ বছরেই ‘মৃত’
** আখেরি স্টেশন দোহাজারী, কক্সবাজারে রেল কবে?
** বয়সটা কম, তবুও কাঁধটা ‘বড়’ তাদের..
** ঘোড়া চলে ঘুষ দিয়ে !
** সেন্টমার্টিন যেভাবে যাবেন
** তৃতীয় ধাপে চট্টগ্রাম টিম এখন কক্সবাজারে
** কক্সবাজারে বাংলানিউজের দ্বিতীয় টিম
** বছরজুড়ে দেশ ঘুরে: কক্সবাজারে বাংলানিউজ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে এর সর্বশেষ