ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

জোয়ারেই ছিঁড়ে যায় ছেঁড়া দিয়া

জাকারিয়া মন্ডল, সিনিয়র আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৫৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ৯, ২০১৬
জোয়ারেই ছিঁড়ে যায় ছেঁড়া দিয়া ছবি: সোহেল সরওয়ার-বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ছেঁড়া দ্বীপ ঘুরে: দু্ই নাবালকের জিম্মায় বঙ্গোপসাগরে ভাসলো দু’ ডজন মানুষ। হাল ধরে থাকা আলমগীর হোসেনের বয়স ১৬।

তার সহযোগী জাহাঙ্গীর আলমের বয়স সবে ১২ পার হচ্ছে।

জীবিকার টানে আরও ৩-৪ বছর আগেই সাগরে নেমেছে তারা। পশ্চিম পাড়ার ছেলে আলমগীরের বাবা আবুল কালামের মৃত্যু হয় ঢাকা যাওয়ার পথে বাসের ছাদ থেকে পড়ে। তারপর থেকে মা আর চার ভাই-বোনের জোয়াল কাঁধে টানছে সে।

বয়স কম হলেও এতোটুকু জড়তা নেই কোথাও। উন্মত্ত সাগরেও সহজাত সাবলীল দুই শিশু। বয়সের তুলনায় অনেক বেশি পরিণত তারা। সেন্টমার্টিনের কাঁচাবাজার আর রোস্তারাঁ থেকে শুরু করে সব কাজে যেমন শিশুদেরই প্রাধান্য, তার জের বজায় রইলো ভরা জোয়ারে ফুঁসতে থাকা সাগরেও। উন্মত্ত সাগরে এই দুই শিশুর হাতেই উঠলো ২৪ জন পূর্ণবয়স্ক মানুষের ভাগ্য।

সেন্টমার্টিন জেটি ছেড়ে দক্ষিণমুখো হলো লাল নৌকার নাক। ডানে সেন্টমার্টিনকে রেখে সমান্তরাল এগিয়ে যাওয়া। গতকাল বিকেলে দেখা প্রবাল বন এখন উত্তাল পানির নিচে। গর্জনরত ঢেউ আছড়ে পড়ছে তীরের সবুজ রেখায়। অনেকটা যেনো পানির সমতলেই নেমে এসেছে সেন্টমার্টিন।

ডানে দৃষ্টির শেষ সীমানায় উত্তর থেকে দক্ষিণে এগিয়ে যাওয়া মিয়ানমারের পাহাড় শ্রেণি যেনো আবছা অবয়বে হেলান দিয়ে আছে আকাশের গায়ে।
নাক বরাবর সামনে আর সব গাছ-গাছালি ছাড়িয়ে মাথা উঁচু করে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে এক ঝাউগাছ। ওইটাই ছেঁড়া দ্বীপ। নাবালক নাবিকের লাল রঙা নৌকার গন্তব্য।

দক্ষিণ পাড়ায় অপেক্ষারত ইঞ্জিনহীন একটা বৈঠা নৌকা এসে দড়িতে বাঁধা পড়লো ইঞ্জিন বোটের পেছনে। সেন্টমার্টিনের মূল ভূ-খণ্ড ছাড়িয়ে দেখা গেলো, পশ্চিমে ডুবো প্রবাল পথে ধাক্কা খেয়ে ফেনা উঠছে সাগরের পানিতে। ভাটার সময়ে ওই পথে হেঁটে যাওয়া যায় ছেঁড়াদ্বীপে। তাই বেশ বোঝা গেলো, জোয়ার এলেই ছিঁড়ে যায় ছেঁড়াদিয়া। এ কারণেই এ দ্বীপের নাম ছেঁড়া দ্বীপ। ভাটার সময়ে সেটা অংশ হয়ে যায় সেন্টমার্টিন ভূখণ্ডের।

সেই ছেঁড়া অংশ পেরিয়ে দ্বীপের পূর্ব সাগরে এসে থেমে গেলো ইঞ্জিন। ডুবো প্রবালে এই বোটে এগোনো যাবে না আর। পেছনে বাঁধা নৌকায় এবার নামতে হলো তাই। সাগর তলের প্রবাল বনের কারণেই বোধ হয় খুব বেশি টালমাটাল এখানকার পানি।
তারওপর ভরা জোয়ারের সাগর ঢেউ তুলছে একের পর এক। টালমাটাল পানিতে দোল খেতে খেতে এগিয়ে যাওয়ার পথে দক্ষিণ থেকে এক বেয়াড়া ঢেউ এসে হঠাৎ ভিজিয়ে দিলো শরীর।

সেন্টমার্টিন আসার পর থেকে হাঁটুজলের বেশি নামা হয়নি বঙ্গোপসাগরে। তাই বুঝি শরীরে জড়িয়ে নিজেই আপন করে নিলো অভিমানী সাগর।
তবে ভিজে গেলো সোহেল সরওয়ারের নতুন কেনা ক্যামেরাটা। ডিঙ্গি নৌকায় সাগরের খু্ব কাছ থেকে ছবি তোলায় মনোযোগ ছিলো তার। সাবধান হওয়ার সময় পাননি বেচারা।

নৌকা থেকে যেখানটাতে নামতে হলো সেটাকে প্রবাল পাথরের স্তূপ ছাড়া অন্য কিছু বলার জো নেই। সেই স্তূপের ভাঁজে ভাঁজে মানুষের ফেলে যাওয়া পানির বোতল, চিপসের প্যাকেট।

প্রবাল স্তূপ থেকে ছেঁড়া দ্বীপে যেতে সরু এক পাথুরে খাঁড়ি পার হতে গিয়েও শরীরে মেখে গেলো সাগরের পানি।

মূল দ্বীপের চর্তুপাশজুড়ে ছোট ছোট কাঁকড়া আর শামুকের বিচরণ। কিন্তু কী অদ্ভূত! শামুকের পা এলো কো্ত্থেকে! গুটি গুটি পায়ে প্রতিটি শামুক যেনো বালুর ওপরে হাঁটছে!

পরে অবশ্য বোঝা গেলো, আসলে শামুকগুলো হাঁটছে না। ক্ষুদে কাঁকড়া ঢুকে অস্থিমজ্জা খেয়ে ঢাল বানিয়েছে শামুকগুলোকে। প্রতিটি শামুকের খোলসে তাই লাল কাঁকড়া। পানিতেও এভাবেই শামুকের খোলসকে ঢাল বানিয়ে শত্রুর হাত থেকে নিজেদের বাঁচায় কাঁকড়ারা।

এই কাঁকড়া আর শামুকের সাম্রাজ্যে একটা তিমির বাচ্চা মরে পড়ে আছে সৈকতে। মিটার চারেক লম্বা। শরীর পচে বেরিয়ে এসেছে পাঁজরের হাড়, লম্বা সরু দাঁত। কোথা থেকে ভেসে এসেছে কে জানে? মরে পড়ে আছে ডলফিনও।
আর একটু এগোতেই পানির কিনারা ছুঁয়ে বাঁশের তৈরি শহীদ মিনার, পেছনে ছেঁড়া দ্বীপের একমাত্র দোকান। পাশেই পলিথিন মোড়ানো এক কুটির। এখানটাতেই হোটেল মৌসুমী সাদ্দাম খাবার তৈরি করে দেয় পর‌্যটকদের। তারাই এই দ্বীপে বসবাসকারী একমাত্র পরিবার।

মূল দ্বীপ থেকে বকের গলার মতো শ’ দেড়েক মিটার প্রশস্ত বাহু দক্ষিণে এগিয়ে গিয়ে তুলনামূলক বড় একটা শেপ নিয়েছে। সেখানে কাঠ বাদামের একটি গাছে মস্ত এক খোড়ল।

মাত্র কয়েকশ’ মিটার আয়তনের এই দক্ষিণ ভূখণ্ডের নাম দারুচিনি দ্বীপ। পূর্ব, দক্ষিণ আর পশ্চিমের কুলহীন সাগর পেরিয়ে একই সঙ্গে তীরে এসে আছড়ে পড়ছে বড় বড় ঢেউ। দূরে ডুবো প্রবালে ধাক্কা খেয়ে পানির ওপর নাচছে পানি।
আর বিশাল সাগরের তুলনায় খড়কুটোর মতো এই ছোট্ট দ্বীপটিতে এসে যেনো মাথা ঠুকছে উন্মত্ত জলতরঙ্গ। গর্জন যেনো পরিণত হচ্ছে হুঙ্কারে।
একই স্থানে দাঁড়িয়ে পায়ের কাছে তিন তিনটি স্রোত আছড়ে পড়ার এমন দৃশ্য আর কোথায় কেইবা দেখেছে!  

পশ্চিম পাশে প্রবাল স্তূপের ওপর দিয়ে ফিরে আসার সময় সাগরের গর্জনের ভেতরও টুক টুক শব্দ শোনা গেলো একের পর এক। পাথরের ওপরে অলস বসে সময় কাটানো শামুখগুলো টুক টুক করে ঝরে পড়ছে মানুষের উপস্থিতি টের পেয়ে। তারপর খোলসের ভেতর সেঁধিয়ে পড়ে থাকছে মরার মতো। মানুষ চলে গেলে নিজেকে মেলছে ফের। তাদের রাজ্যে বিচরণ করছে তাদের মতোই।  
ছেঁড়া দ্বীপের ঠিক মধ্যিখানে দ্বীপের একমাত্র ঘরটির পেছনে কেয়ার ডালে বসে দোল খাচ্ছে ছেঁড়া দ্বীপের একমাত্র পরিবারের ছোট ছেলে জয়নাল। এই দ্বীপেই জন্ম তার। বাবার নাম হোসেন আলী। আর এক ভাই গিয়াসউদ্দিনকে পাওয়া গেলো উত্তর অংশে।  ছেঁড়া দ্বীপের আইকন হয়ে ওঠা সেই ঝাউ গাছটির কাছে।

অন্তত ৭৫ মিটার উচ্চতা গাছটির। একপায়ে দাঁড়িয়ে সব গাছ ছাড়িয়ে আকাশে উঁকি মারছে। সেন্টমার্টিন জেটি থেকেই নজরে আসে এই ঝাউগাছটা।

এখানটায় দাঁড়ালে সেন্টমার্টিন ও ছেঁড়াদ্বীপের মধ্যিখানে ঝাউগাছের দ্বীপটা আরো ভালো করে নজরে পড়ে। যার নাম নিঝুম দ্বীপ।  
ওই নিঝুম দ্বীপ তো বটেই, গোটা ছেঁড়াদ্বীপে একটাও নারিকেল গাছ চোখে পড়লো না। এটি মূলত কেয়া ঝোপেরই দ্বীপ।
ফেরার পথে ভালোই ভোগালো দুই নাবালক নাবিক। ঘণ্টা দেড়েক বসিয়ে রাখলো খোলা সাগরে। রোদের তাপে পুড়তে থাকলো চামড়া। কিন্তু ওরা তখন প্রবালের স্তূপে ডাব বিক্রিতে ব্যস্ত।

অনুনয়, আকুতি কিছুতেই কাজ হলো না আর। শতাধিক ডাব কাটার পর যখন আর কোনো ক্রেতা রইলো না তখন বোট ছাড়লো তারা। এমন আচরণ পর্যটনের জন্য কী করে শুভ হয়?

বাংলাদেশ সময়: ০৯৪৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৯, ২০১৬
জেডএম/   

** আট প্রহরই সাগরের সঙ্গে মিতালী
** মেঘের সাগরে আয়েসি উড়াল
** হাওয়া অফিস খাঁ খাঁ, ঐতিহ্যের শরীরে টাইলস আগ্রাসন
** বাংলানিউজ, ওয়েলকাম টু কক্সবাজার
** আতঙ্ক আর আনন্দ একযোগে ভর করলো সাগরে
** এই ৮ বর্গকিমিই এনেছে ৪ হাজার বর্গকিমি সমুদ্র
** সেন্টমার্টিন যেভাবে যাবেন
** তৃতীয় ধাপে চট্টগ্রাম টিম এখন কক্সবাজারে
** কক্সবাজারে বাংলানিউজের দ্বিতীয় টিম
** বছরজুড়ে দেশ ঘুরে: কক্সবাজারে বাংলানিউজ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে এর সর্বশেষ