ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

‘কি ঘর বানাইমু আমি শূন্যের মাঝার’

আসিফ আজিজ, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭১৪ ঘণ্টা, জুলাই ২০, ২০১৬
‘কি ঘর বানাইমু আমি শূন্যের মাঝার’ ছবি: আসিফ আজিজ-বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

সুনামগঞ্জ থেকে: রাস্তার পাশের খোলা ফটক দিয়ে হাছন রাজার ছবিখানা চোখ আটকে দিলো। দুই অচীনকে পথ দেখানো অর্বাচীন রিকশাচালককে আর দ্বিধায় থাকলে হলো না।

এটাই মরমি কবি বাউল সাধক হাছন রাজার বাড়ি। পাশাপাশি দুটি ভবনের চাকচিক্য দেখে বোঝার জো নেই শেষ জীবনে মাটি আর ছনের কুঁড়েঘরে কাটানো মানুষের বসতভিটার বাড়ি এটি। হয়তো অনেকের মতো আমাদেরও বোধহলো হাছন রাজার বাড়ি অট্টালিকা!

**আরও ছবি দেখতে ক্লিক করুন লিংকে: ছবিতে হাছন রাজার স্মৃতিবিজড়িত বসতবাড়ি

পশ্চিমের ফটক দিয়ে ভিতরে উত্তরদিকের চারতলা ভবনটির নিচতলা হাছন রাজা মিউজিয়াম। উত্তরে খোলা জায়গার পর ঘেরা দেওয়া আরেক খণ্ড সবুজ প্রান্তর। যেখানে সীমানা শেষ সেখানেই সুরমা নদীর লঞ্চঘাট। হাছন রাজা উদাস নয়নে এ নদীর পানে চেয়ে সৃষ্টি করেছেন অনেক গান, কবিতা। সেই দৃষ্টি এখন বাধা ইট-সিমেটের প্রাচীরে।

মিউজিয়ামের সামনের গলি দিয়ে অন্দরমহলের পথ। ভিতরে ঢুকে একটি টিনের ঘর, একটি টিনের ছাউনির পাকা ঘর, একটি নতুন অবকাঠামোর ঘর চোখে পড়লো এক নজরে। জীবদ্দশায় যে মানুষটি তার কুঁড়েঘর ভেঙে ছেলেদের বানানো পাকাঘর ভেঙে ফেলেছিলেন তার ভিটেতে নেই কোনো মাটির স্থাপনা। চার প্রজন্মের কেউ মনে করেনি তার স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখতে সেটা করা প্রয়োজন। সেসময় যারা বাবার নিষেধ অমান্য করে পাকা দালান তুলেছিলো তারা স্মৃতি রক্ষায় প্রজন্ম থোড়াই কেয়ার হবে এটাই বোধহয় স্বাভাবিক। দর্শনার্থী-ভক্তরা তাই হতাশ হন রাজার বসতভিটায় এসে।

ভিতরে ঢুকে উত্তরে সবুজ লনের বাঁপাশে টিনের গোলাঘর। সামনে মাঝারি আকারের আমগাছ। হাছন রাজার ছেলের নাতি দেওয়ান গণিউল সালাহউদ্দীন বলছিলেন এটাই একমাত্র অবকাঠামোগত নিদর্শন যেটা টিকে আছে এখনও। যেটার বয়স প্রায় ১শ বছর।

টিনের ঘরটির অবস্থান যেখানে ঠিক সেখানেই থাকতেন হাছন রাজা। এটি ছিলো তার অন্দরমহল। বর্তমান অবকাঠামোটি আগের। কিছু সংস্কার করা হয়েছে। সিলিংয়ে কাঠের কারুকাজ। ভিতরে ঢোকার সুযোগ নেই। লম্বা সারিতে বানানো কুঁড়েঘরের একটিতে থাকতেন হাছন। এখন সেখানে পাকা টিনশেড ঘর। আর তার ঘরটির স্থানে রয়েছে ঘাসের যত্নে থাকা পাকা ধ্বংসাবশেষ।

একবার কলকাতা গিয়ে ফিরে এসে দেখেন তার ছেলে তার কুঁড়েঘরটি ভেঙে সেখানে পাকা স্থাপনা গড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি সেটি ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেন। সেই চিহ্নটুকু এখন কালের সাক্ষী। দেখতে দেখতে বারবার কানে বাজছিলো ‘লোকে বলে বলে রে ঘরবাড়ি ভালা না আমার/কি ঘর বানাইমু আমি শূন্য-ই মাঝারে……লোকে বলে…/

পাঁচলাখ একরের বেশি জমির মালিক হাছন রাজা শেষ বয়সের দিকে পুরোপুরি আধ্যাত্মিকতার চর্চা শুরু করেন। জগৎ সংসার তখন হয়ে পড়ে গৌণ। তার সেই লম্বা ঘরের মাঝের অংশটি শুধু রয়েছে, ভাঙা পড়েছে দু’পাশের ঘরগুলো। সেটা মাটির নয়, পরে ছেলেদের করা ইটের বাড়ি। এই ঘরের পিছনে পুকুরপাড়। এই পুকুরের ঘাটে গোসর করতেন হাছন রাজা। সেই পুকুরের বাঁধানো শানটিও সংস্কারের পর হারিয়েছে আদিরূপ।

শহরের তেঘরিয়ায় অবস্থিত পাঁচ একর জায়গার উপর রাজার বসতভিটা। রাস্তা থেকে যতদূর চোখ যায় নতুন সব অট্টালিকা সেখানে দাঁড়িয়ে আকাশ ফুঁড়ে। কোথায় সেই হাছন রাজার ছন-মাটির ঘর। সংসার, বংশধর ক্রমে বাড়ায় আগের বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যায়ও মিউজিয়াম ও বসতবাড়িতে দর্শনার্থী সমাগম ছিলো চোখে পড়ার মতো।

টিনের চৌকো গোলাঘরে ধান রাখা হতো। সামনে দণ্ডায়মান একটি আমগাছ। গোলাঘরটি দাঁড় করানো প্রাচীন বড় আকারের গাছের খুঁটি দিয়ে। বিভিন্ন লতা-গুল্ম বাসা বাঁধা আমগাছটি হাছন রাজার আমলের বলেই জানালেন দেওয়ান গণিউল। এই গোলাঘর সংলগ্ন পাঁচিলের গেটটি তৎকালীন প্রধান ফটক ছিলো বলে জানালেও সিমেন্ট আর ইটের কাজ শত বছরের আগের সাক্ষী বলে মনে হলো না। অবশ্য রাজার আমলের দাবি করলেও জোরালো যুক্তিও দিতে পারলেন না গণি। যতটুকু অবশিষ্ট আছে সেটিও ভঙ্গুর।

প্রাচীর পেরুলেই উত্তরে বাংলাঘর। এখানেই সেসময় কাছারির কাজ হতো। হাছন রাজার স্মৃতি বিজড়িত সেই ঘরটি এখন বাড়ির কাজের লোকদের আবাসস্থল।

হাছন রাজার স্মৃতির সংরক্ষণের নমুনা! একমাত্র বংশধর হিসেবে এই ভিটেয় থাকা দেওয়ান গণিউর রাজা বলেন, হাছন রাজা তো শুধু আমাদের না সবার। তার স্মৃতিরক্ষায় সবার এগিয়ে আসতে হবে। তবে আমরা তার ভিটের সবটুকু ঠিক রাখতে পারিনি পারিবারিক নানা মত নানা পরিস্থিতির কারণে।

যে মরমি কবি তার আধ্যাত্মিক দর্শন দিয়ে ইহকালীয় ঘর-বাড়ির প্রতিই ছিলেন উদাসীন, তার বসতভিটেই উদাস প্রকৃতিকে দূরে পাঠিয়ে সুরম্য অট্টালিকা কি সাক্ষ্য বহন করছে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।

‘লোকে বলে বলেরে/ঘর বাড়ি ভালা না আমার/কি ঘর বানাইমু আমি শূন্যের মাঝার/ভালা করি ঘর বানাইয়া কয় দিন থাকব আর/আয়না দিয়া চাইয়া দেখি পাকনা চুল আমার/এই ভাবিয়াহাছন রাজা ঘর দুয়ার না বান্দে/কোথায় নিয়া রাখবা আল্লায়, এর লাগিয়া কান্দে/হাছন রাজায় বুঝতো যদি বাঁচব কতদিন/ দালান কোঠা বানাইত করিয়া রঙ্গিন’

উত্তরসূরিদের দিকে চেয়ে হয়তো এ কালজয়ী এ গানের কথাগুলোই বারবার আওড়াচ্ছেন এ মরমি কবি!

বাংলাদেশ সময়: ১৭০২ ঘণ্টা, জুলাই ২০, ২০১৬
এএ

** কাছাড়িয়া হাওরের পথে পথে-৩
** কাছাড়িয়া হাওরের পথে পথে-২
** হাওরের হাঁসে হাসি​
** কাছাড়িয়া হাওরের পথে পথে-১
** মায়ার বাঁধনে মায়া, সঙ্গী জেমস-মনা
** এবার আসছে গৌরাঙ্গের সাত লেয়ারের জুস
** সবুজের বুক চিরে চেনা নতুন শ্রীমঙ্গল
**নাগা মরিচের আরও ছবি
** সাদা-কালো নাগা মরিচে গিনেস রেকর্ডের ঝাল
** তবু থেকে যায় সাতরঙা চায়ের রহস্য
** রাতদুপুরে সবুজবোড়ার রাস্তা পারাপারের দুঃখ
** পর্যটকবান্ধব নয় সিলেট-শ্রীমঙ্গলের ট্রেন
** চুলা নেই পূর্বাঞ্চলের কোনো ট্রেনের ক্যান্টিনে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে এর সর্বশেষ