ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

দুবলার চরের জেলেদের জীবনগাথা

শুভ্রনীল সাগর, ফিচার এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩১৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২১, ২০১৬
দুবলার চরের জেলেদের জীবনগাথা ছবি: শুভ্রনীল সাগর-বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

শরীর খারাপ বলে সাগরে যাননি নওশের। চুলায় দাতিনা মাছের ঝোল বসিয়েছেন বাবুর্চি কাম শুঁটকিশ্রমিক আব্দুল মজিদ। সঙ্গে ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত। ভোরের আলোয় ভেসে যাচ্ছে গুটিয়ে রাখা জাল, শুঁটকির মাচাসহ চরের আনাচে-কানাচ।

দুবলার চর থেকে: শরীর খারাপ বলে সাগরে যাননি নওশের। চুলায় দাতিনা মাছের ঝোল বসিয়েছেন বাবুর্চি কাম শুঁটকিশ্রমিক আব্দুল মজিদ।

সঙ্গে ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত।

ভোরের আলোয় ভেসে যাচ্ছে গুটিয়ে রাখা জাল, শুঁটকির মাচাসহ চরের আনাচে-কানাচ। সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া এই ঘরের নয় জেলের ফেরার সময় হয়ে এলো বলে। এসেই বাসন পেতে বসে যাবেন। এরপর খেয়েদেয়ে লম্বা ঘুম।

বাইরে থেকে দোচালা ঘরটি দেখে মনে হবে ভিতরে একটাই রুম। ঠিক ঢোকার মুখে এক চুলার রান্নাঘর। একটু উঁকি দিতেই চোখে পড়লো মই। উঠে গেছে বাঁশ বিছানো দোতলায়। সাত সকালে প্রমিত বাংলা শুনে লেপের ফাঁক দিয়ে চোখ বের করে চাইলেন। কৌতুহল আরেকটু বাড়িয়ে জ্বর নিয়েই মাথা তুললেন নওশের (৪০)।
 ছবি: শুভ্রনীল সাগর-বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
মেঘে মেঘে কুড়ি বছর হতে চললো তার জেলেজীবন। পৌষের দিন। তার মতো শ্রমজীবীর জ্বর-ঠাণ্ডা মাথায় নিলে চলে না। তাও শুয়ে রয়েছেন যখন আমলে নিতে হয়। চিকিৎসা বলতে দুবলার চরের শিব মার্কেটের ডিসপেনসারি।

এদিন সকালেই যেমন দুই নৌকার মাঝখানে চাপা খেয়ে এক জেলে গুরুতর আহত হলেন। বাঁশে জাল ঝুলিয়ে সেখানে বসিয়ে দু’দিক থেকে দু’জন কাঁধে করে আনতে হলো তাকে। সুন্দরবনের এ চরে তারও চূড়ান্ত চিকিৎসা ওই ডিসপেনসারির ওষুধ। নেই কোনো রেজিস্টার্ড বা বিশেষ কোনো প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ডাক্তার। এর বেশি করতে হলে আট-নয় ঘণ্টার ট্রলার ঠেলে খুলনা বা মংলা। এভাবেই বয়ে চলেছে দুবলার চরকেন্দ্রিক ছয় হাজার তিনশো জেলের জীবন।
 ছবি: শুভ্রনীল সাগর-বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
বছরের অক্টোবর মাসে মংলা, বরগুনা, সাতক্ষীরা, পাইকগাছা, বরিশালসহ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তারা আসেন। ফিরে যান ফেব্রুয়ারির দিকে। বরষা মৌসুমে সাগরের পানিতে ডুবে যায় দুবলার চর। এই পাঁচ মাস এখানেই তাদের ঘর-সংসার ও আরেক জীবন।

এমনিতে দুবলার চরে দিনের বেলায় চলতে-ফিরতে জেলের দেখা পাওয়া মুশকিল। অধিকাংশই চাঁদের হিসাব ও জোয়ার-ভাটা ধরে সাগরে চলে যান মাছ ধরতে। কাছাকাছি গেলে একদিন বা দু’-তিনদিনে ফেরেন। অনেকে বেশি মাছের আশায় একাদশী থেকে পরবর্তী চাঁদের পঞ্চমী-ষষ্ঠী তিথি অব্দি নৌকা ভাসান গভীর সমুদ্রে।

সেক্ষেত্রে সকালে ফিরলে, জালে ওঠা ছুরি, লইট্যা, লাক্ষা, রূপচাঁদা, কোরাল- শুঁটকি ব্যবসায়ীদের দাড়িপাল্লায় তুলে দেওয়ার পর খেয়েদেয়ে লম্বা ঘুম। বিকেল করে উঠে সোজা শিব মার্কেট। যারা বিকেল-সন্ধ্যায় ফেরেন তাদেরও গন্তব্য একই জায়গা।
 ছবি: শুভ্রনীল সাগর-বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
মূলত জেলে ও শুঁটকি ব্যবসায়ী-শ্রমিকদেরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে পাঁচ মাসের ক্ষণস্থায়ী এ বাজার। কার্যত, দুবলার চরের প্রধান বাজারও এটি। জীবন ধারণের নিত্য প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্রের দোকানে সেজে উঠেছে বাজারের এ-মাথা থেকে ও-মাথা। মিলবে- চাল-ডাল-সদাইপাতির দোকান, চায়ের দোকান, স্টেশনারি, ওষুধ, তরি-তরকারি, ব্রয়লার মুরগি, সেলুন, মোবাইল রিচার্জ, ইলেক্ট্রনিক্স, মোবাইলে গান ও সিনেমা লোড প্রভৃতির দোকান। সকালে দোকানপাট খুলে গেলেও বাজার জমে ওঠে সন্ধ্যার পর। এই জমাটি আড্ডা-গান-গল্প থামতে রাত ১১টা বেজে যায়।

চরের সৈকতে জোয়ারের ঢেউয়ের সঙ্গে সঙ্গে আছড়ে পড়ে সন্ধ্যা। বেশ আয়েশ করে জিলাপি-সিঙারা নিয়ে বসেন প্রশান্ত ও গৌতম। মূল বাজারের একটু কোণার দিকে হোটেলটি। দু’জনই এসেছেন পাইকগাছা থেকে। বছর দশেক হতে চললো দুবলার চরে এসে এসে মাছ ধরছেন। বাড়িতে বাবা-মা, স্ত্রী-ছেলে-মেয়ে সবাই রয়েছে। খাওয়া শেষ করে পরিচিত জেলেবন্ধুদের সঙ্গে জমিয়ে চা খাবেন।
 ছবি: শুভ্রনীল সাগর-বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
শোনালেন মাছ ধরে ফেরার পর সময় কাটানোর গল্প, বাজারে গল্প-গুজব করি। মোবাইলে গান শুনি, সিনেমা দেখি।  

বলে রাখা ভালো, দুবলার চরে বর্তমানে কোনো টিভি-ডিভিডি নেই। সবাই মোবাইলেই দেখেন-শোনেন। পছন্দমতো গান-সিনেমা মোবাইলে ট্রান্সফার করার দোকান রয়েছে এখানে। প্রশান্তর পছন্দ তামিল ও চাইনিজ সিনেমা আর গৌতমের ইন্ডিয়ান বাংলা সিরিয়াল ও হাই বিটের গান।

কেউ ভাবসঙ্গীত ও নামকীর্ত্তন শুনতে চলে যান বাজার সংলগ্ন মন্দিরের একটি ঘরে। রোজ সেখানে ঢোল-তবলা নিয়ে গানের আসর বসে।
 ছবি: শুভ্রনীল সাগর-বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
বাজারের ভিড় লক্ষ্য করে পা এগোয়। বাজারজুড়ে সৌরবিদ্যুতের টিমটিমে আলো। দোকানে দোকানে ঝুলছে একটি মাত্র এনার্জি সেভার লাইট, সে আলো দোকানের চারকোণা অব্দি পৌঁছায় না।

গল্পে মশগুল চার-পাঁচজনের একটি জটলা থেকে কথা ভেসে আসে, আপনারা কি ট্যুরিস্ট? না উত্তর শুনে সারল্যমাখা হাসিমুখে আহ্ববান, তোলেন তোলেন, আমাদের ছবি তোলেন।

ক্যামেরা অন্য কারও দিকে তাক করলে, তার দিকে ধেয়ে যায় সকৌতুক নির্দেশনা- ওই রেজাউল, তোর ছবি তোলে, যা মেকআপ করে আয়।
 ছবি: শুভ্রনীল সাগর-বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
যার ছবি ওঠে, প্রথমে বন্ধুদের টিপ্পনী খেয়ে লজ্জা পেলেও ব্যাপক আগ্রহ নিয়ে বলে, কই দেহি, ছবি কিরাম আইছে।

ছবি দেখে গোটা মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ে। তবে হাসির আড়ালে লুকানো থাকে কান্নাও। সাগরের উত্তাল ঢেউ বুকে পেতে নেওয়াই যাদের কাজ, তাদের মুখ থেকে কী আর সহজে দুঃখের কথা বেরোয়! তাও দু’-একটি যা বলেন এর মধ্যে চিকিৎসা সেবার বিষয়টি প্রধান। এদিকে সরকার নজর দিক এটি তাদের একান্ত চাওয়া। অন্যটি, জরুরি প্রয়োজনে দ্রুত খুলনা-মংলার সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা।
ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
পাঁচ মাসের মৌসুমে টন-কে-টন মাছ ও শুঁটকির জোগান দেন তারা। উত্তর-দক্ষিণাঞ্চলের চাহিদা মিটিয়ে দুবলার চরের শুঁটকি এখন চট্টগ্রামেও পাড়ি দিচ্ছে। সরকারের কাছে এটুকু তাদের ন্যায্য দাবি।

পরম প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়েছে মুখমণ্ডলে। কথা বলতে বলতে রাস্তার এ মাথা থেকে ও মাথা চলে যাচ্ছে বত্রিশের মনোজ। শেষ হয়েও হাসি মোছে না। বউ নাকি? হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়েন।
 ছবি: শুভ্রনীল সাগর-বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
ফোনের ওপারে তার আসল সংসার। এদিকে নকল সংসারেরও দায়-দায়িত্ব ও ঝক্কি-ঝামেলা কম নয়। মনোজদের মতো অনেকেই নিজেরা রান্না করে খান। তবে মাছ বাদে বাকি সব কিনতে হয়। পাঁচমাসের জন্য হোগলা পাতার বেড়া দিয়ে বালির উপর বাড়ি গড়ে পাঁচ-দশজন করে মিলেমিশে থাকেন সবাই। এজন্য পাঁচমাসে বনবিভাগকে দিতে হয় মাথাপিছু দুই হাজার টাকা। অনেকে শুঁটকির আড়তদারের ঘরেও থাকেন। পনের দিন বা মাসে বাড়ি ঘুরে আসেন জেলেরা। খেয়ে-পরে মৌসুম শেষে হাতে থাকে প্রায় লাখখানেক টাকা। এরপর বছরের বাকি সময়টা এলাকায় গিয়ে কিছু একটা করেন। কেউ দোকান, ক্ষেত-খামার করেন, কেউ মাছের ঘের।

বাজার পিছনে থেকে যায়। দূর থেকে আড্ডার হাসি কানঘুরে ইথারে মিলায়। আঁধারে নিজের হাতও দেখা যায় না। তেজ কটালের ঢেউ এসে ছুঁয়ে দিয়ে যায় পায়ের পাতা। শান্ত-স্নিগ্ধ বালুতট। আবার এই ঢেউই প্রলয়ঙ্কারী সিডরের সময় এক ঝটকায় কেড়ে নিয়েছিল প্রায় ৪শ জন জেলের প্রাণ। তবু জীবন থেমে থাকে না। ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভেসে চলে নাসির-ইকতিয়ারদের নৌকা…

** না দেখলেই নয় হাড়বাড়িয়া ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র!
** এইসব দিনরাত্রি রয়ে যাবে গাবখান-বলেশ্বরের বাঁকে
** বুড়িগঙ্গা-মেঘনা ছুঁয়ে পশুর নদীর ডাকে

বাংলাদেশ সময়: ০৯১৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২১, ২০১৬
এসএনএস /জিপি সহযোগিতায়

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে এর সর্বশেষ