প্রাচীন সভ্যতার দেশ মিসরের সঙ্গে জড়িয়ে ইসলামের সুদীর্ঘ ইতিহাস। হিজরি প্রথম শতাব্দীতেই মিসরে ইসলামের আগমন হয়।
মিসরীয় সমাজে ডান ও বাম, শিয়া ও সুন্নি, গোড়া ও উদার নানা মতাদর্শের মুসলিম বাস করে। তার পরও পবিত্র রমজান তাদেরকে একই বিন্দুতে মিলিত করে। পবিত্র রমজানের আগমন তাদের জন্য আনন্দ বার্তা ও ধর্মীয় কাজের অনুপ্রেরণা বয়ে আনে। চাঁদ দেখার জন্য মিসরীয় নারী-পুরুষ ও শিশু-বুড়ো সবাই একত্র হয় মসজিদে বা বাড়ির ছাদে। গণমাধ্যমে রমজানের আগমনী বার্তা প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে জেগে ওঠে পুরো মিসর। পথ-ঘাট ও বাজারগুলোর চেহারায় পাল্টে যায় পুরোপুরি। শিশুরা রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে, ‘রমজানের ফানুস’ নিয়ে। তাদের হাতে থাকে হরেক রকম ফানুস আর মুখে রমজানের আগমনী গান, ‘রামাদান! ....... হালুও ইয়া হালুও। ’ আর বড়দের মুখে মুখে ধ্বনিত হয় নানা অভিনন্দন বাণী- রমজান আপনার জন্য কল্যাণকর হোক, কল্যাণময় রমজানের আগমন ইত্যাদি।
মিসরে পবিত্র রমজান মাসে রাস্তাঘাটগুলো সাজানো হয় বিভিন্ন রংয়ের ফানুস ও আলোকসজ্জা দিয়ে। চারদিক মুখরিত থাকে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত ও হামদ-নাতের সুরে।
ফানুস মিসরীয় রমজান সংস্কৃতির অন্যতম দিক। ৫ রমজান ৩৫৮ হিজরি থেকে মিসরবাসী ফানুস সংস্কৃতির সঙ্গে প্রথম পরিচিত হন। সে রাতে ফাতেমি খলিফা মুয়িজ কায়রো প্রবেশ করেন। তার সম্মান ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য কায়রোকে ফানুস ও লণ্ঠন দিয়ে সাজানো হয়। সেই থেকে রমজানে ফানুসের ব্যবহার করে আসছে তারা। ফাতেমি শাসক গোষ্ঠির অভ্যাস ছিলো তারা ফানুস বহনকারীকে নানা ধরনের উপঢৌকন দিতো। রীতিটি এখনো অব্যাহত আছে মিসরীয়দের মাঝে। যেসব শিশু ফানুস নিয়ে রাস্তায় বের হয়, তাদেরকে মিষ্টান্নসহ বিভিন্ন উপহার প্রদান করা হয়।
নেপোলিয়ান মিসর আক্রমণ করার পর তার দখলদারিত্বের প্রতিবাদে পুরো মিসরবাসী আকাশে ফানুস ছেড়ে প্রতিবাদ করেছিলো। রমজানে ফানুসের অধিক ব্যবহারের জন্যই তা একটি শিল্পে পরিণত হয়েছে। এ শিল্পের সঙ্গে বিপুল সংখ্যক মানুষের জীবন-জীবিকা জড়িয়ে আছে। প্রতি বছর নতুন নতুন ফানুস বাজারে আনার চেষ্টা করে ফানুস ব্যবসায়ীরা।
রমজান মিসরীয় সমাজের চিত্রটাই যেনো পুরো পাল্টে দেয়।
কোরআনের প্রতি মিসরীয়দের অনুরাগ ও তাদের সুন্দর তেলাওয়াতের কথা কারো অজানা নয়। রমজানের আগমনে কোরআনের প্রতি তাদের অনুরাগ ও ভালোবাসা বৃদ্ধি পায় বহুগুণে। যদি রমজানের কোনো সকালে আপনি শহরে বের হন, শুধু কোরআনের মনোমুগ্ধকর তেলাওয়াত শুনতে পাবেন, আপনার হৃদয়-মন জুড়িয়ে যাবে এ তেলাওয়াত শোনে। আপনি বেশি শুনতে পাবেন মিসরের বিখ্যাত কারীদের তেলাওয়াত। যেমন, শায়খ আবদুল বাসেত আবদুস সামাদ, শায়খ মুহাম্মদ সাদিক মুনশাভি, শায়খ মাহমুদ খলিল হাসরি, শায়খ মুস্তফা ইসমাইল প্রমুখ। পবিত্র কোরআনে কারিমের তেলাওয়াত শুনে জেগে ওঠে ঘুমন্ত মিসর। এই দৃশ্য দেখতে পাবেন কম-বেশি আসর পর্যন্ত।
আসরের পর তারা বের হয় ইফতার সামগ্রি কেনার জন্য। ইফতার আয়োজনে থাকেÑ খেজুর, দুধ, অন্যান্য ফল-ফলাদি। রমজানের খাদ্য তালিকায় মিসরীয়দের প্রিয় খাবার সিম। সবশ্রেণীর সবার দস্তরখানে রমজানে সিম পাওয়া যাবে। এমন কী রমজানে সিম খাওয়া নিয়ে স্থানীয়দের মাঝে বিভিন্ন শ্লোকও শোনা যায়। তারা ইফতার শুরু করে খেজুর ও শরবত দ্বারা। এ সময় পানীয়ের তালিকায় হরেক রকম ফলের জুসও দেখা যায়। যেমন, আপেল, আম, কমলা ইত্যাদি। মাগরিবের নামাজ আদায় করার পর শুরু হয়, তাদের মূল ইফতার পর্ব। ইফতারের পর তারা অবশ্যই কিছু মিষ্টান্ন গ্রহণ করে। সেগুলোর মধ্যে বিখ্যাত কয়েকটি হলো- ‘কানাফাহ’, ‘কাতায়েফ’ ও ‘বাকলাওয়াহ’ ইত্যাদি। সবশেষে কড়া করে চা পান করে তারা এশার নামাজের প্রস্তুতি গ্রহণ করে।
মিসরীয়রা প্রতিদিন ভিন্ন ভিন্ন মসজিদে তারাবি পড়তে পছন্দ করে। এজন্য দেখা যায়, মসজিদে স্থানীয়দের তুলনায় বহিরাগতের সংখ্যা বেশি। নারীদের তারাবির জন্য মসজিদ কর্তৃপক্ষ মাঠে ভিন্ন ব্যবস্থা করেন। কখনো আবার মসজিদে পৃথক জায়গা করে দেন। তারাবির নামাজের কেরাতে মধ্যপন্থা অবলম্বন করা হয়। খুব দ্রুত বা ধীরে নয়; বরং স্বাভাবিকভাবে পড়ে যাওয়া হয়। মিসরীয়রা তারাবির নামাজ শেষ করে তিনটি বিরতিতে। প্রত্যেক নামাজের পর মসজিদে ওয়াজ, নসিহত ও ধর্মীয় বিষয়ে পাঠদান করা হয়। বিপুল সংখ্যক মুসল্লি তাতে অংশগ্রহণ করে। হিজরি তৃতীয় শতাব্দী থেকে মিশরে শেষ রাতে একদল প্রহরী অন্যদের জাগিয়ে দেয়। এটি মূলত মিসরী সংস্কৃতি। যা পরবর্তীতে অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে।
রমজানের শেষ দশকে মিসরীয়রা অত্যান্ত গুরুত্বের সঙ্গে ইতেকাফের আমল করে। প্রতিটি মসজিদে বিপুল সংখ্যক লোক ইতেকাফে বসে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের একান্ত সাধনায় মগ্ন হয়। শবে কদরের রাতে প্রায় সব মিসরীয় পুরুষ মসজিদে অতিবাহিত করে। সারা আল্লাহর দরবারে কান্না-কাটি ও ইবাদতের মধ্য দিয়ে কাটিয়ে দেয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৩২৬ ঘন্টা, জুন ২৮, ২০১৫
এমএ/