সৌদি আরব ইয়েমেন ওমান নিয়ে গড়া ভৌগোলিকভাবে বিশাল ভূখণ্ডটি যেন ভারত মহাসাগরের পাড়ে ধ্যানে বসা এক মৌন ঋষি, আর কাতার যেন তার কোলে বসা এক দেবশিশু। দেশটার আকৃতি বামহাতের পাঁচটি আঙ্গুল একসঙ্গে সোজা করে রাখলে যে রকম দেখায়- অনেকটা সেরকম।
অথচ এক সময় এই কাতার ছিল, আরব দুনিয়ার সবচেয়ে ছোট ও অপরিচিত দেশগুলোর একটি। সৌদি আরবের পর উপসাগরীয় অঞ্চলে এটাই ছিল সবচেয়ে রক্ষণশীল সমাজ। বাজপাখি শিকার ও উটের দৌঁড়ই ছিল তাদের একমাত্র বিনোদন। আর এখন অপেক্ষাকৃত কম বয়সী আমিরের শাসিত হচ্ছে। সেই নবীন আমির বিপ্লব ঘটিয়েছেন নারীদের ভোটাধিকার দিয়ে; যা আরব বিশ্বের বিরল ঘটনা।
বরাবরের মতো সাইরেন বাজিয়ে রমজানের আগমনী বার্তা ঘোষণা করা হয় আল জাজিরার দেশ কাতারে। এ সময় মসজিদে মুসল্লির সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। সরকার বিভিন্ন মসজিদ মেরামত করে ও নতুন ইমামদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। এখানকার ধনী ও ধনকুবেররা মোটা অংকের দান-সদকা করে থাকেন। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অসংখ্য প্রতিনিধি কাতারে এসে জাকাত ও অন্যান্য দান-সদকা তাদের দেশে নিয়ে যায়। কাতারে লোকজন ধর্ম ও ধর্ম পালনের বেশ আগ্রহী ও অনুরাগী।
এ বিষয়ে একটি সংবাদ পড়া যাক। সংবাদটি হলো- গত ৪ ফেব্রুয়ারি কাতারের প্রধানমন্ত্রী আবদুল্লাহ বিন নাসের বিন খলিফা আল-থানির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি। মন্ত্রী বলেন, ‘আগে কাতার সরকার জানত বাংলাদেশ ৭৫ শতাংশ মুসলিমের দেশ। কিন্তু, আমরা তাদের বলেছি, বাংলাদেশের ৯৫ ভাগই মুসলিম। তখন তারা বলেছেন, তোমরা আমাদের ভাই। তোমাদের দেশ থেকে অধিক সংখ্যক দক্ষ ও আধাদক্ষ কর্মী নিতে অগ্রাধিকার দেয়া হবে। ’ কর্মী নেয়ার ক্ষেত্রে নামাজি সংক্রান্ত একটি প্রসঙ্গ আসে। এর হেতু কি? এমন প্রশ্নের জবাবে প্রবাসী মন্ত্রী বলেন, ‘তারাই আমাদের কাছে জানতে চেয়েছিল তোমাদের দেশের লোক নামাজি কিনা। আমরা তাদের বলেছি, হ্যাঁ অধিকাংশ মানুষই নামাজি। ’
যে দেশের কর্ণধাররা নাগরিকের ধর্মপালনের বিষয়টি তদারিক করেন, তাদের দেশে সিয়াম সাধনার মাস কী অপরিসীম রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের সওগাত নিয়ে আসে, তা সহজেই অনুমেয়। কাতারের ভাষা আরবি। স্বাভাবিকভাবেই কোরআন নাজিলের মাস রমজানে কোরআন তেলাওয়াত এবং পঠন-পাঠনের মাত্রা বহুগুণে বেড়ে যায় সেখানে।
রমজানের গুরুত্বপূর্ণ আমল ইফতার। এ সময়ে শুরু হয় অন্য রকম আমেজ। কাতারের নারীরা জোহরের পর ইফতার তৈরির জন্য রান্নাঘরে প্রবেশ করেন। কেউ কেউ এ মাসে তাদের বন্ধু ও স্বজনের বাড়িতে পাঠানোর জন্যে বিশেষ খাবার তৈরি করেন। কাতারিদের রমজানের প্রিয় খাবার হলো গরম রুটির সঙ্গে পরিবেশিত মাংসের ঝোলের মতো তৈরি ‘সারিদ’, ভেড়ার মাংসের তৈরি ‘হারিস’ ও মধুতে ডোবানো ভাজা ময়দায় তৈরি ‘লুকাইমাত’।
এ ছাড়া রাজধানী দোহায় প্রথম শ্রেণির হোটেলগুলোতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশেষ তাঁবু বানানো হয়। এখানে প্রাচীন আরবের ঐতিহ্যসমৃদ্ধ খাবারের অায়োজন থাকে।
সাইরেন বাজিয়ে যেমন রমজানের আগমনী বার্তা ঘোষণা করা হয়, তেমনি দেশটিতে সাইরেন বাজিয়ে রমজান মাসের শেষ ও নতুন মাস শাওয়ালের সূচনাকারী নতুন চাঁদ দেখার সংবাদও ঘোষণা করা হয়।
কাতারিরা তিন দিন ধরে ঈদুল ফিতর উদযাপন করেন। মহিলারা নতুন জুতো আর প্রায়শই সোনালি বা রুপালি সুতোয় নকশা করা কাফতান পরিধান করে থাকেন। ঈদের প্রথম সকাল শুরু হয় বুলালিত (সেদ্ধ ডিমে ঢাকা মিষ্টি নুডলস), মিষ্টি রুটি আর অন্যান্য মিষ্টি খাবার দিয়ে বিশেষ নাশতা করে। বাচ্চারা ঈদের গান গায়, বাবা-মা এবং প্রবীণরা বাচ্চাদের টাকা ও খাবার দিয়ে থাকে।
দুপুরের খাবার সময় বর্ধিত পরিবারের সদস্যরা সদ্য জবাই করা ভেড়া আর ভাত খেতে কোনো প্রবীণ আত্মীয়ের বাড়িতে জড়ো হয়। প্রায়ই ২০ থেকে ৫০ জন লোকের এই বড় আকারের সমাবেশে একটা বিরাট টেবিলে খাবার রাখা হয় এবং লোকজন খাওয়ার জন্য মেঝেতে বসে। নারী-পুরুষ আলাদাভাবে বসতে পারে। রাজধানী দোহায় বিভিন্ন প্রকাশ্য স্থানে তলোয়ার যুদ্ধ ও ঢোল বাজানোর মাধ্যমে জনতাকে আমোদ জোগানো হয়।
বাংলাদেশ সময়: ২০২৪ ঘন্টা, জুন ১৭, ২০১৬
এমএইউ/