ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অপার মহিমার রমজান

টিভি দেখে নামাজ আদায়ের বিষয়ে বিতর্কের অবসান হোক

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৪৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ৩০, ২০২০
টিভি দেখে নামাজ আদায়ের বিষয়ে বিতর্কের অবসান হোক

এক.
করোনা ভাইরাসের কারণে মসজিদে সীমিত সংখ্যক মুসল্লি নিয়ে নামাজ চালু করার পরে টিভিতে সম্প্রচার করে বাড়িতে নামাজ আদায়ের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট মতামত দিয়েছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ। কোরআন ও হাদিসের আলোকে দেশের বিজ্ঞ আলেম সমজের সঙ্গে পরামর্শ করেই এমন মত দেওয়া হয়েছে।

বুধবার (২৯ এপ্রিল) ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক ও সরকারের অতিরক্তি সচিব আনিস মাহমুদ স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিশিষ্ট মুফতি ও আলেমদের মতামত দিয়ে এ তথ্য জানানো হয়েছে। টিভি-চ্যানেলে সম্প্রচার করা তারাবির নামাজ বাড়িতে ইক্তেদা করা হলে তা কোনোভাবেই সহীহ ও জায়েজ হবে না বলে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, সম্প্রতি কোনো কোনো টিভি চ্যানেলে তারাবির নামাজ সম্প্রচারের মাধ্যমে ইমামকে অনুসরণ করে নিজ নিজ বাড়িতে তারাবির নামাজ আদায় করার বিষয়ে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে বলে জানা যায়।

ইসলামী শরীয়তের বিধান অনুযায়ী, জামাতে নামাজ আদায়ের ক্ষেত্রে কাতারের সংলগ্নতা (ইত্তেসাল) জামাত ও ইক্তেদা সহীহ হওয়ার অন্যতম প্রধান শর্ত। এটি মানা না হলে নামাজ সঠিক হবে না। তাই কোনো টিভি-চ্যানেলে সম্প্রচার করা তারাবি নামাজের ইমাম সাহেবের তিলাওয়াত শুনে ও রুকু-সিজদার অনুসরণে নিজ নিজ বাসা-বাড়িতে ইক্তেদা করে তারাবির নামাজ আদায় করা হলে তা কোনোভাবেই সঠিক ও জায়েজ হবে না মর্মে বিশিষ্ট মুফতি ও আলেমগণ মতামত দিয়েছেন।

বিষয়টি অনুধাবন করে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি পরিহারকল্পে টিভি চ্যানেলে তারাবির নামাজসহ অন্যান্য নামাজ সম্প্রচার থেকে বিরত থাকতে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে সবাইকে বিশেষভাবে অনুরোধ করা হয়েছে। এর আগে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে এর আগে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ইমাম, খতিব, মুয়াজ্জিনসহ ১২ জনকে মসজিদে তারা‌বির নামাজ আদায়ের নির্দেশনা দেওয়া হয়। সেটিও দেশের বিশিষ্ট ওলামায়েকরামের সাথে আলোচনা করেই করা হয়েছিলো।

দুই.

করোনা সংকটকালে রমজান মাসে বাংলাদেশের মসজিদে জমাত করে তারাবির নামাজ না পড়ে, বিকল্প হিসেবে মসজিদ থেকে টেলিভিশনে তারাবির নামাজ সরাসরি সম্প্রচারের প্রস্তাব করেছেন দেশের একজন বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতা। তিনি নিজের নির্বাচনী এলাকায় রমজান মাসে টেলিভিশনে তারাবির নামাজ সরাসরি সম্প্রচারের উদ্যোগ নিয়েছেন। এ নিয়ে বিবিসি বাংলা'সহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর এসেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম'সহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ নিয়ে চলছে আলোচনা ও সমালোচনার ঝড়।

টেলিভিশনে সম্প্রচার করে এটি করলেও বিবিসির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে ওই রাজনৈতিক নেতা বলেছেন, "বিষয়টি ইসলামি শরীয়ত অনুযায়ী এবং ধর্মীয় নিয়ম অনুযায়ী কতটুকু সঠিক, সেটা জানতে হবে। সেটা নিয়ে আরও চিন্তা হতে পারে, কথা হতে পারে। " সেভাবে টেলিভিশন মাধ্যম ব্যবহার করে নামাজ পড়া যেতে পারে মনে করছেন তিনি। এটি একটি ধারণা এবং বিষয়টা নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিৎ বলেও বিবিসিকে বলেন বিশিষ্ট সে নেতা। তিনি বলেছেন, যেকোনো একটি স্থানের নামাজ সম্প্রচার করা হলে সেটার অডিও অনুসরণ করে মানুষ খতমে তারাবি পড়তে পারবে।

বিবিসির ওই সাক্ষাৎকারে উদাহরণ হিসেবে বলেছিলেন, যেমনটি আমরা বিশ্ব ইজতেমার মোনাজাতের ক্ষেত্রে দেখে থাকি। তবে তিনি এ-ও বলেছেন, বিষয়টি ইসলামি শরিয়ত অনুযায়ী এবং ধর্মীয় নিয়ম অনুযায়ী কি-না সেটা জানতে হবে সেটা নিয়ে আরও চিন্তা হতে পারে কথা হতে পারে। "যেমন বিশ্ব ইজতেমায় যখন আখেরি মোনাজাত হয় তখন টেলিভিশনে তা সরাসরি দেখে অনেকে সেই মোনাজাতে অংশ নেন। আবার আমরা যখন নামাজ পড়ি, বেশিরভাগই লোকই কিন্তু ইমামকে দেখতে পান না। তখন আমরা মাইকে যে শব্দ আসে সেটা অনুসরণ করে নামাজ শেষ করি। "

জামাতে নামাজ আদায় করার তাগিদ দিয়ে আল্লাহ এরশাদ করেন, ‘রুকুকারীদের সঙ্গে রুকু করো। ’ (সুরা: বাকারা, আয়াত : ৪৩)। পবিত্র কোরআনের এ আয়াতের সঙ্গে মিল রেখে বিবিসির সঙ্গে আল হাইয়াতুল উলিয়ার কেন্দ্রীয় ফতোয়া বোর্ডের সিনিয়র সদস্য মুফতি মিযানুর রহমান সাঈদ বলেন, জামাতে নামাজ পড়তে হলে ইমামের সঙ্গে মুসল্লিদের সংযোগ প্রয়োজন হয়। সংযোগ ছাড়া নামাজ হয় না। সুতরাং টেলিভিশন, রেডিও অথবা যেকোনো প্রকার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দ্বারা নামাজ সম্প্রচার করে তার অনুকরণে নামাজ আদায় করলে, তা আদায় হবে না।

তিন.

মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এরশাদ করেন, ‘জামাতে নামাজের ফজিলত একাকী নামাজের চেয়ে ২৭ গুণ বেশি। ’ (সহিহ বুখারি) রাসুলুল্লাহ (সা.) সারা জীবন জামাতের সঙ্গেই নামাজ আদায় করেছেন। এমনকি ইন্তিকালপূর্ব অসুস্থতার সময়ও জামাত ছাড়েননি। সাহাবায়ে কেরামের পুরো জীবনও সেভাবে অতিবাহিত হয়েছে। (সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর : ৬২৪)। প্রতি নামাজেই ইমামের সঙ্গে একজন মুক্তাদি হলেও জামাত হয়ে যায়। (সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর : ৬১৮, ইবনে মাজাহ ৯৬২)।

পুরুষের জন্য পাঁচ ওয়াক্ত নামাজই জামাতে আদায় করা সুন্নাতে মুআক্কাদা, যা ওয়াজিবের সঙ্গে তুলনীয়। (অর্থাৎ এটি ওয়াজিবের কাছাকাছি) (মুসলিম, হাদিস :  ১০৪৬)। কোনো ওজর বা অপারগতা ছাড়া জামাতে শরিক না হওয়া বৈধ নয়। যে ব্যক্তি জামাত ত্যাগে অভ্যস্ত হয়ে যায়, সে গুনাহগার হবে। (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৬৪)। জুমা ও দুই ঈদের জন্য জামাত শর্ত। জামাত ছাড়া জুমা এবং ঈদের নামাজ সহিহ হবে না। (আবু দাউদ, হাদিস : ৯০১)। তারাবি ও সূর্য গ্রহণের নামাজ সুন্নতে মুআক্কাদায়ে কেফায়া। (অর্থাৎ এমন সুন্নতে মুআক্কাদা, যা সমাজের কিছু লোক আদায় করলে সবার পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যাবে। ) (বুখারি, হাদিস নম্বর : ১৮৭৩)

রমজানে বিতরের নামাজ জামাতে আদায় করা মুস্তাহাব। (মুআত্তা, হাদিস : ২৩৩)। রমজান ছাড়া অন্য সময় বিতর নামাজ জামাতে পড়া মাকরুহ। (মুসলিম, হাদিস : ১২০১)। তবে হ্যাঁ, হঠাৎ কোনো সময় দু-একবার জামাতে পড়ে নেওয়ায় কোনো সমস্যা নেই। (তাইসিরুত তাহরির ৪/১১৭)

মসজিদে ইমাম ও মুয়াজ্জিন আছে, তাতে আজান-ইকামত দিয়ে একবার জামাত পড়ার পর দ্বিতীয় জামাত করা মাকরুহ। (সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর : ৬০৮)

তবে প্রথম জামাত থেকে পরের জামাতের অবস্থা যদি ভিন্ন হয়, যেমন প্রথম জামাতের ইমাম ও পরের জামাতের ইমামের দাঁড়ানোর স্থান ভিন্ন হয়, তাহলে তা মাকরুহ নয়। (মুতালেবে আলিয়া : ৫১৯)

হযরত আনাস (র.) থেকে বর্ণিত রসুল (সা.) এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি জামাতের সাথে তাকবীরে উলা পেয়ে চল্লিশ দিন নামাজ আদায় করল, তার জন্য দুটি নিষ্কৃতি লিখে দেওয়া হলো, একটি হলো জাহান্নাম থেকে নিষ্কৃতি, অপরটি হলো নিফাক থেকে নিষ্কৃতি। (তিরমিযী)

তারাবি নামাজ একটি বিশেষ ইবাদত। ইবাদত সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর জন্য হওয়া জরুরি। এর সঙ্গে অন্য কিছু জড়িত থাকলে এটা শিরকের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। শুধু প্রদর্শনের জন্য নামাজের আয়োজন হতে পারে না। মহামারি কিংবা মারাত্মক অসুস্থতাসহ যথাযথ কারণ থাকলে মসজিদে না গিয়ে বাসা-বাড়িতে নামাজ পড়া যাবে। এতে ইসলামে কোনো বিধি নিষেধ নেই।

বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের এ সময়ে বাড়াবাড়ি করে মসজিদে ব্যাপক জনসমাগম মোটেই সমীচীন নয়। সংকটকালীন সময়ে সতর্কতা অবলম্বন করে বাড়িতে নামাজ আদায় করাই শ্রেয়। কিন্তু এ সুযোগে ইবাদত-বন্দেগির ধরন বদলানোর চেষ্টা কিংবা মনগড়া নতুন নতুন পদ্ধতির আবিষ্কার কাম্য নয় বলে মনে করেন ওলামায়েকেরাম। আল্লাহ আমাদের কোরআন ও হাদিসের আলোকে আমাদের আমল করার তৌফিক এনায়েত করুন। আমিন।

..লেখক: উপ-পরিচালক , ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়।

বাংলাদেশ সময়: ১৮৪৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ৩০, ২০২০
এইচএডি/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।