ঢাকা: ২০২৪ সালকে বরণ করে নেওয়ার আগে চলতি বছর ঘটে যাওয়া আলোচিত ঘটনাগুলো মনে করবেন দেশের জনগণ। নানা আলোচনা-সমালোচনা, অপরাধ বিষয়ক ঘটনা ও নির্বাচন- ২০২৩ সাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
কিশোরদের অপরাধ বিষয়ক ঘটনাগুলোরও শেষবারের মতো খবরের পাতা থেকে পড়ে নেবেন পাঠক। চায়ের দোকান থেকে আদালত পর্যন্ত আলোচনায় থাকা ঘটনাগুলো জেনে নেওয়া যাক...
শ্যুটার আনোয়ার গ্রুপ
২০২৩ সালে সবচেয়ে সমালোচিত ছিল রাজধানী মোহাম্মদপুরের হাতের কব্জি কেটে টিকটক করা কিশোর গ্যাং ‘আনোয়ার ওরফে স্যুটার আনোয়ার গ্রুপ’। মানুষের হাত কেটে গ্যাং সদস্যরা টিকটক ভিডিও তৈরি করতো। গ্রুপের অন্যতম লিডার মো. ইউনুছ ও সহযোগী সাইফুল ইসলাম ওরফে ছোট সাইফুলকে চলতি বছর ৪ অক্টোবর রাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানার খিলজি রোড এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তারা ছিনতাই করছিল।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব-২) কর্তৃক গ্রেপ্তার গ্রুপের সদস্যরা নানা ঘটনার অপরাধী। দুই কিশোর গ্যাং গ্রুপের আন্তঃদ্বন্দের জেরে এক পক্ষ চাপাতি দিয়ে আরেক পক্ষের হাত বিচ্ছিন্ন করে টিকটক করার মতো লোমহর্ষক ঘটনা ঘটিয়েছিল। এছাড়া, তারা ৪০ থেকে ৫০ জন একসঙ্গে এলাকায় জমায়েত হয়ে ছিনতাই, চাঁদাবাজির মতো ঘটনা ঘটাতো।
সম্প্রতি রাজধানীর মোহাম্মদপুরে আরমান নামে এক যুবকের হাত থেকে কব্জি বিচ্ছিন্ন করে আনোয়ার গ্রুপ। ঘটনাটি টিকটক ভিডিওর মাধ্যমে সামাজিকযোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল করা হয়। ঘটনাটির অভিযোগ ও এ অপকাণ্ড আমলে নিয়ে তাদের পেছনে লাগে র্যাব-২ ও র্যাব-৬। গত ৮ ও ৯ সেপ্টেম্বর ভোর পর্যন্ত চক্রটিকে ধরতে অভিযান চালায় এ বাহিনী। পরে মোহাম্মদপুর ও বাগেরহাট এলাকা থেকে চক্রের ৭ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়।
মোহাম্মদপুর ও আশপাশের এলাকায় এ সন্ত্রাসী গ্রুপের সদস্য অনেক। রাফাত, তুষার ও আনোয়ারের নেতৃত্বে কয়েক বছর ধরে গ্রুপটি পরিচালিত হয়ে আসছিল। তারা মোহাম্মদপুর, আদাবর, বেড়িবাঁধ ও ঢাকা উদ্যান এলাকায় চাঁদাবাজি, ছিনতাই, ডাকাতিসহ অন্যান্য সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করতো। এই গ্রুপের সন্ত্রাসীরা একাকী পথচারীদের আকস্মিকভাবে ঘিরে ধরে চাপাতিসহ ধারালো অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে অর্থ ও মূল্যবান সামগ্রী ছিনতাই করে দ্রুত পালিয়ে যেত। তারা বিভিন্ন সময় চাঁদাবাজিসহ আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ঢাকা উদ্যান, আদাবর, শ্যামলী, মোহাম্মদপুরসহ পার্শ্ববর্তী এলাকায় দেশিয় ধারালো অস্ত্র দিয়ে মারামারিসহ বিভিন্ন ধরণের সন্ত্রাসী কার্যক্রমও পরিচালনা করতো। এই গ্রুপের লিডার রাফাত কোনো মোবাইল ফোনের সিম ব্যবহার করত না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আইডি খুলে সে ভুক্তভোগীদের হুমকি দিত।
ব্রেভ ডেঞ্জার স্ট্রং কিং (বিডিএসকে) গ্যাং
দুই বছর ধরে রাজধানীর মোহাম্মদপুর, আদাবর, বেড়িবাঁধ ও ঢাকা উদ্যান এলাকায় আধিপত্যসহ চুরি, ছিনতাইসহ সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে আসছিল ব্রেভ ডেঞ্জার স্ট্রং কিং (বিডিএসকে) গ্যাং। গ্যাংয়ের প্রধান শ্রীনাথ মণ্ডল ওরফে হৃদয় ওরফে হিটার হৃদয় (২২)। তার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ২০ থেকে ২৫ জন সদস্য। গত ২৮ জানুয়ারি রাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুর, বেড়িবাঁধ, সদরঘাট ও ফরিদপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে এ গ্রুপের লিডার হৃদয়সহ তার আট সহযোগীকে দেশি-বিদেশি অস্ত্রসহ আটক করেছে র্যাব। বিডিএসকে (ব্রেড ডেঞ্জার স্ট্রং কিং) গ্যাংয়ে প্রায় ২০ থেকে ২৫ জন সদস্য রয়েছে। এদের লিডার হৃদয় ওরফে হিটার হৃদয়ের নেতৃত্বে গত দুই বছর আগে গ্যাংটি গঠন করা হয়। এর আগে গ্যাংয়ের সদস্যরা ‘সবুজ বাংলা গ্রুপ’, ‘টপ টেন গ্রুপ’ ও ‘ভাই বন্ধু গ্রুপ’ এর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
এসব গ্রুপের সদস্যরা স্থানীয় বিভিন্ন ব্যক্তির স্বার্থ হাসিলের জন্য ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসী হিসেবেও কাজ করত। এছাড়াও তারা মাদক সেবনসহ মাদকের কারবার করত। এ গ্যাংয়ের সদস্যরা রাস্তাঘাটে ইভটিজিং, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপ্রীতিকর ভিডিও শেয়ারসহ বিভিন্ন কুরুচিপূর্ণ কার্যক্রমের সঙ্গেও জড়িত।
তোমাদের আরিফ ভাইয়া
রাজধানীর পল্লবীতেও আছে কিশোর গ্যাং বা গ্রুপ আতঙ্ক। মিরপুরে আছে কিশোর গ্যাং ‘তোমাদের আরিফ ভাইয়া’। এই গ্যাংয়ের প্রধান মো. আরিফ মিয়া। গত ২৪ সেপ্টেম্বর মিরপুর জার্মান টেকনিক্যালের সামনে থেকে ওই গ্যাংয়ের ৪ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এই গ্রুপের সদস্যরা দলবল নিয়ে বিভিন্ন স্থানে মারামারি করা, আতঙ্ক সৃষ্টি করাই তাদের কাজ। গ্রুপে ১০-১২ জন সদস্য রয়েছেন। তারা মেসেজের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করত। গ্রুপের কোনো সদস্য কোথাও আক্রান্ত হলে বাকিরা ছুরি, লাঠি নিয়ে সেখানে হামলা করত। আরিফ নিজেই এই গ্যাং পরিচালনা করে। গ্যাংয়ের প্রধান হিসেবে আরিফ নিজের গলায় ‘তোমাদের আরিফ ভাইয়া’ নামে ট্যাটুও করেছে।
পল্লবীতে এক পাঞ্জাবি ব্যবসায়ীকে হাতুড়িপেটা ও ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায় আশিক গ্যাংয়ের সদস্যরা। ভুক্তভোগী ওই ব্যবসায়ীর কাছে চাঁদা চায় ৫ লাখ টাকা। ৩০ জানুয়ারি পল্লবী থানা এলাকার সেকশন-১১, ব্লক-ই, লালমাটিয়া, রোড-৯, বাড়ি-১০৫/১, দিলা ফ্যাশন নামক পাঞ্জাবির কারখানায় হামলার ঘটনাটি ঘটে। এই ঘটনার একদিন পরে ৩১ জানুয়ারি এক কিশোরকে কিল-ঘুষি ও ছুরিকাঘাতে জখম করার অভিযোগ ওঠে আশিক গ্যাংয়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে।
এলাকাবাসীরা জানায়, আশিক পল্লবী থানা এলাকার কিশোর গ্যাং লিডার। আশিকের নামের থানায় আরও মামলা রয়েছে। আশিকের নামেও গ্যাংয়ের নাম। প্রায় ছয় মাস আগে লালমাটিয়া টেম্পুস্ট্যান্ডে এক ব্যক্তিকে মারধর করে আশিক। ওই ঘটনাও মামলা হয়েছিল। আশিক প্রায়ই মানুষের সঙ্গে মারামারি গণ্ডগোল করে থাকে। সে ঝাল মুড়িওয়ালা-রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে সবার সঙ্গেই গণ্ডগোল করত। এছাড়াও অস্ত্র হাতে টিকটক ভিডিও তৈরি করত। এইসব ভিডিও দেখিয়ে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার ও মানুষকে ভয় দেখাত আশিক বাহিনীর সদস্যরা। এসব মামলা ও অভিযোগের ভিত্তিতে ২ ফেব্রুয়ারি শরীয়তপুরে অভিযান চালিয়ে আশিককে গ্রেপ্তার করে পল্লবী থানা পুলিশ।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ২০১৭ সালের র্যাব প্রথম কিশোর গ্যাং কালচার আবিষ্কার করে। আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছি। পদক্ষেপ নেওয়ার পরও তারা এ সমস্ত কার্যক্রম থেকে অনেকে সরে আসছে না। কিশোর গ্যাং কালচারের সাথে জড়িত ১১০০ সদস্যকে আইনের আওতায় নিয়ে এসেছি। সারা বাংলাদেশে কিশোর গ্যাং দমনে ও এর সাথে যারা জড়িত থাকবে তাদের বিরুদ্ধে যে সকল আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন তা নেওয়া হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১০০২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৫, ২০২৩
এমএমআই/এমজে