ঢাকা, বুধবার, ১০ পৌষ ১৪৩১, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

সালতামামি

‘ডামি নির্বাচনে’ ক্ষমতায়, জনরোষে বিদায়

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭২৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৫, ২০২৪
‘ডামি নির্বাচনে’ ক্ষমতায়, জনরোষে বিদায়

ঢাকা: বিদায়ের দ্বারপ্রান্তে ২০২৪ সাল। দেশের ইতিহাসে এই বছরটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

এই বছরের শুরুতে অনুষ্ঠিত হয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আর মাঝামাঝিতে উত্তাল আন্দোলনের মাধ্যমে সৃষ্ট গণঅভ্যুত্থানে পতন হয় সরকারের। নির্বাচন-অভ্যুত্থানের ‘কেন্দ্রবিন্দুতে’ ছিলেন আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা।

৭ জানুয়ারি বিতর্কিত ‘ডামি নির্বাচন’র মাধ্যমে টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতা ধরে রাখতে পারলেও অভ্যুত্থানে টিকতে পারেননি শেখ হাসিনা। মাত্র সাত মাসের মাথায় ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত গণঅভ্যুত্থানে তীব্র জনরোষে পতন হয় তার দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের। দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন শেখ হাসিনা।

যেভাবে ‘ডামি নির্বাচনে’ গদি ধরে রাখে আওয়ামী লীগ

চলতি বছরের শুরুতে অনুষ্ঠিত হয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আওয়ামী লীগ সরকারের এক তরফা নির্বাচনের প্রস্তুতি দেখে  তা বয়কট করেছিল বিএনপি, জামায়াতসহ বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল। প্রতিপক্ষবিহীন নির্বাচনকে জমজমাট করতে অভিনব ‘কৌশল’ নেয় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ।

নির্বাচনে সমমনা জাতীয় পার্টি, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাকের পার্টি, বিকল্প ধারা, কল্যাণ পার্টি, তরিকত ফেডারেশনসহ ১৪ দল থেকে সমঝোতার মাধ্যমে আলাদা প্রার্থী মাঠে নামায় আওয়ামী লীগ। একই সঙ্গে নৌকা প্রতীকে নিজ দলের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করায় দলটি। নিজেদের প্রতিপক্ষ নিজেরাই, নির্বাচনে নজিরবিহীন এবং অভিনব এসব প্রার্থীদের নাম শেখ হাসিনা নিজেই রাখেন ‘ডামি প্রার্থী’।  

নির্বাচনী ময়দানে আওয়ামী লীগের মিত্র দল এবং নিজ দলের নেতাকর্মীদের পরস্পরের বিরুদ্ধে ‘ডামি প্রার্থী’ বানিয়ে ‘ডামি নির্বাচনের’ তরী পার হয়ে টানা চার মেয়াদের জন্য ক্ষমতা ধরে রাখতে পারলেও শেষ পর্যন্ত গদি রক্ষা করতে পারেননি শেখ হাসিনা।

এর আগে ২০১৪ সালেও নির্বাচন বয়কট করেছিল বিএনপি-জামায়াত জোটসহ তাদের মিত্র দলগুলো। সেবার আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করে। এরপর ২০১৮ সালে নিবন্ধন হারিয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে পারেনি জামায়াতে ইসলামী। তবে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জোট গঠন করে নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি ৩০০ আসনের মধ্যে মাত্র ছয়টি আসনে জয় লাভ করে। যদিও কারচুপির অভিযোগ তুলে এই নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করে তারা।

এ বছরের ৭ জানুয়ারি মিত্র দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতার ‘ডামি নির্বাচনের’ মাধ্যমে দ্বাদশ সংসদে সরকার গঠন করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। পারস্পরিক সমঝোতায় সংসদের ‘ডামি বিরোধী দলের’ দায়িত্ব নেয় স্বৈরাচার হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের হাতে গড়া দল জাতীয় পার্টি। সংসদে বিরোধী দল হিসেবে থাকার পাশাপাশি জাতীয় পার্টি থেকে কয়েকজন আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রিপরিষদেও থাকার চেষ্টা করেছিল। আরও বেশি বিতর্ক এড়াতে আওয়ামী লীগ তাতে সাড়া দেয়নি।

ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত বিপ্লব, শেখ হাসিনার সরকারের পতন

জানুয়ারিতে সরকার গঠনের পর থেকে পতনের আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ছাড়া আওয়ামী লীগ সরকারকে কোনো রকম ঝক্কি-ঝামেলায় পড়তে হয়নি। এই সময়ে দেশে বড় ধরনের কোনো আন্দোলনও হয়নি।

২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা প্রচলিত ছিল। এই কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যাপক কোটাবিরোধী আন্দোলন হয়। সে সময় সংস্কারের দাবির বিপরীতে পুরো কোটা ব্যবস্থাই বাতিল করে দেয় সরকার।

চলতি বছর ৫ জুন সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহাল করার রায় দেয় হাইকোর্ট। সংস্কারের দাবিতে আবারও আন্দোলন শুরু হয়। ধীরে ধীরে আন্দোলন বড় হতে থাকে। শুরুতে আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ। গত ১৪ জুলাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কোটা ও ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ নিয়ে এক মন্তব্য আন্দোলনের আগুনে ঘি ঢালে। তিনি নিজের চীন সফর নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরাও পাবে না? তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা পাবে?’ আন্দোলনকারীদের বিষয়ে তার এই মন্তব্য ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আন্দোলন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।

বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের দাবানলে আরেক দফা ঘি ঢালেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও তৎকালীন সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, ‘কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে কতিপয় নেতারা যে সব বক্তব্য রেখেছে, তার জবাব দেওয়ার জন্য ছাত্রলীগই যথেষ্ট। ’ এরপর ছাত্রলীগ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর হামলা করে। রক্তাক্ত হন অনেকে। সেসবের মুহূর্ত অনলাইন ও সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পেলে আন্দোলনের বারুদ ছড়িয়ে পড়ে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। এক রাতে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্রলীগকে বিতাড়িত করে সাধারণ শিক্ষার্থীরা।

১৬ জুলাই রংপুরে নিহত হন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। বিক্ষোভ দমনে পুলিশের আগ্নেয়াস্ত্রের বিপরীতে দুই হাত উঁচু করে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। পুলিশের ছররা গুলিতে প্রাণ ঝরে আবু সাঈদের। তার মৃত্যুর দৃশ্য মুহূর্তে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। তীব্রতা বাড়তে থাকে আন্দোলনের। ছাত্রদের সঙ্গে আন্দোলনে যুক্ত হয় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। লাশের মিছিল বাড়তে থাকে, সেই সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তীব্রতা বাড়তে থাকে।

পরবর্তী কয়েকদিন সারাদেশে ব্যাপক সহিংসতা হয়। কারফিউ জারি করে কাঁদানে গ্যাস, রাবার বুলেট, ছররা গুলির পাশাপাশি ‘লাইভ বুলেট’ ব্যবহার করে পুলিশ। হেলিকপ্টার থেকেও গুলি করা হয় আন্দোলনকারীদের ওপর।  পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের গুলিতে শত শত মানুষ প্রাণ হারায়।

ব্যাপক প্রাণহানি ও নৃশংসতায় আওয়ামী লীগ সরকার আন্দোলন কিছুটা দমন করতে সক্ষম হয়। এর মধ্যে আদালত কোটা ব্যবস্থা পুরোপুরি পুনর্বহালের পরিবর্তে সংস্কার করে। ৫৬ শতাংশ থেকে কোটা ১০ শতাংশে নেমে আসে।

এদিকে ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনায় কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলন পরিণত হয় সরকার পতনের আন্দোলনে। বুলেট আর ব্যাপক প্রাণহানির মাধ্যমে সরকার রাস্তা থেকে আন্দোলনকারীদের কিছুটা সরাতে পারলেও ক্ষোভে ফুঁসতে থাকে দেশের জনগণ। সেই ক্ষোভ আরও উসকে দেয় ঘরে ঘরে হানা দিয়ে শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তারের মতো ঘটনা। এর মধ্যে সামনে আসে ‘ভাতের হোটেল’ খ্যাত ডিবি পুলিশের প্রধান হারুন অর রশীদের নাটক। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের ডিবি অফিসে বসিয়ে ভাত খাওয়ানো এবং সেই ছবি-ভিডিও প্রচার করা, তাদের দিয়ে জোর করে বিবৃতি দেওয়ার ঘটনা আন্দোলনকারীদের বিক্ষুব্ধ করে। মানুষও ক্ষুব্ধ হয়ে আবার রাস্তায় নামতে শুরু করে।

সরকার আরও কঠোর হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড ৪ আগস্ট মাঠে নামায় দলের নেতা-কর্মীদের। সেদিন ঢাকার পাশাপাশি, নরসিংদী, ফেনী, হবিগঞ্জ, বগুড়া, সিরাজগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় তীব্র সংঘাত হয়। ঝরে অনেক প্রাণ। তবে জনরোষের ‍মুখে ময়দানে টিকতে পারেনি আওয়ামী লীগ। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবর অনুসারে, শেষ মুহূর্তে সেনাবাহিনীকেও ছাত্র-জনতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সেনাবাহিনীর বড় অংশ ছাত্র-জনতাকে গুলি করতে অস্বীকৃতি জানায়। সশস্ত্র বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তারাও ছাত্র-জনতার পক্ষে অবস্থান নিয়ে বক্তব্য-বিবৃতি দেন, করেন মিছিলও।

৫ আগস্ট সকাল থেকে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে বিপুল সংখ্যক মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। ঢাকা ও ঢাকার আশপাশের মানুষ শেখ হাসিনাকে গদি থেকে উৎখাতের জন্য গণভবনের দিকে ছুটতে থাকে। শেখ হাসিনা গণভবন থেকে সটকে পড়তে মাত্র ৪৫ মিনিট সময় পান। তীব্র জনরোষের মুখে সেদিন দুপুরে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন টানা চারবারসহ বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় পাঁচবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা শেখ হাসিনা।

বাংলাদেশ সময়: ০৭২৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৫, ২০২৪
এসকে/এমইউএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।