ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৮ পৌষ ১৪৩১, ০২ জানুয়ারি ২০২৫, ০১ রজব ১৪৪৬

সালতামামি

এমন বিপর্যয়কর বছর দেখেনি আওয়ামী লীগ 

স্পেশাাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৩৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩০, ২০২৪
এমন বিপর্যয়কর বছর দেখেনি আওয়ামী লীগ 

ঢাকা: ইতিহাসের আরেকটি ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে বছর পার করলো দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। চলতি বছরের শুরুতে বিতর্কিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে টানা চারবারের মতো সরকার গঠনে সফল হলেও শেষ রক্ষা হয়নি।

মাত্র সাত মাসের মাথায় বিদায় নিতে হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারকে।

চলতি বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। যদিও এই নির্বাচন ছিল বিতর্কিত এবং ব্যাপক সমালোচিত। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা টানা চারবার এবং সব মিলিয়ে পাঁচবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন। নির্বাচনের পর ১০ জানুয়ারি সংসদ সদস্যরা শপথ নেন। আর ১১ জানুয়ারি শপথ নেয় শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভা। তবে মাত্র সাত মাসের মাথায় ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয় শেখ হাসিনার সরকার। দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন শেখ হাসিনা।

বয়কটের নির্বাচনে ‘ডামি’ প্রার্থী, নিজেরাই নিজেদের প্রতিপক্ষ
চলতি বছরের শুরুতে অনুষ্ঠিত ওই জাতীয় নির্বাচন আগে থেকে বর্জনের ঘোষণা দেয় আওযামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি, জামায়াতসহ অনেক দল। আওয়ামী লীগ ছাড়াও নির্বাচনে তাদের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, জাতীয় পার্টি (জেপি), তরিকত ফেডারেশন এবং ১৪ দলের বাইরে থাকা জাতীয় পার্টি, জাকের পার্টি, বিকল্প ধারা, কল্যাণ পার্টি অংশ নেয়। আগের তিনটি নির্বাচনের মতো এবারও এই দলগুলোর সঙ্গে আসন সমঝোতা করে আওয়ামী লীগ।  

কিন্তু বিএনপিসহ বেশিরভাগ দল নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় তা হয়ে পড়ে এক তরফা। এই পরিস্থিতিতে নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দেখাতে আওয়ামী লীগ অভিনব কৌশল নেয়। নৌকা প্রতীকে নিজ দলের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে এবং অন্য দলগুলোর জন্য ছেড়ে দেওয়া আসনেও আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করায় দলটি। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা এই প্রার্থীদের নাম দেন ‘ডামি প্রার্থী’, যা নিয়ে দেশজুড়ে আলোচনা তৈরি হয়। বিরোধী দলগুলোর মধ্যে অবতারণা হয় হাস্যরসের। নৌকা বনাম ডামি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায় আওয়ামী লীগ।

অন্যদিকে নির্বাচন প্রতিহত করতে আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে বিএনপি ও দলটির সমমনা রাজনৈতিক দলগুলি। আওয়ামী লীগও যে কোনো মূল্যে নির্বাচন করতে অনড় অবস্থানে চলে  যায়। এর ফলে দেশে অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি হয়। আবার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সহিংসতা দেখা দেয়। সব মিলিয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি ও সহিংসতার কারণে হতাহতের ঘটনাও ঘটে। বৈরি পরিস্থিতির মধ্যে ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের দিন ভোট কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতিও ছিল স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক কম। এমন পরিস্থিতিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ‘জয় পেয়ে’ টানা চারবারের মতো সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ।

সরকার গঠনের পর থেকেই টানাপোড়েন
সরকার গঠনের একদিন পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছিলেন, নতুন সরকারের সামনে তিনটি চ্যালেঞ্জ; রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক।  

এই তিন চ্যালেঞ্জের কথা বলা হলেও অনেকটা ‘স্বাচ্ছন্দ্য ভাব’ নিয়ে পথচলা শুরু করে সরকার। কিছুদিন পর ‘নির্বাচনী চ্যলেঞ্জ’ মোকাবিলা করা সম্ভব হয়েছে, বাকি চ্যালেঞ্জও অতিক্রম করতে পারবে বলে সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের নেতারা দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে থাকেন।  

তবে নতুন সরকার গঠনের পর দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, দুনীতি দূর করা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখা যায়নি। এর মধ্যে রাজনৈতিক মিত্রদের সঙ্গেও দূরত্ব বাড়তে থাকে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রধান সহযোগী জাতীয় পার্টি নির্বাচনের বিষয়ে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ তুলতে থাকে। সংসদের ভেতরে-বাইরেও এ নিয়ে উঠতে থাকে বিভিন্ন আলাপ। জোটসঙ্গী ১৪ দলের শরিকদের সঙ্গেও আওয়ামী লীগের বাড়তে থেকে দূরত্ব। নির্বাচনে আসন সমঝোতা নিয়ে শুরু হওয়া টানাপোড়েন থেকে যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়, নির্বাচনের পর তা আরও বাড়তে থাকে এবং জোটের অস্তিত্ব থাকবে কি না এই প্রশ্নও উঠে যায়। নির্বাচনের দীর্ঘ পাঁচ মাসের অধিক সময় পর ৪ জুন ১৪ দলের সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভার ফলে ‘কোনো মতে’ জোট টিকে থাকে।

জুলাইয়ে সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলন শুরু হলে আওয়ামী লীগ সংকটে পড়ে। ভুগতে থাকে ১৪ দলের শরিকরাও। সেসময় আওয়ামী লীগের সঙ্গে মাঠে নামার ঘোষণা দিয়েও তারা নামতে পারেনি। আওয়ামী লীগও টিকতে পারেনি সরকারে।

পতনের শুরুটা যেখান থেকে
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের শুরুটা হয় ৫ জুন। সেদিন সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহাল করার রায় দেন হাইকোর্ট। ২০১৮ সালে এই কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলনের পর সেসময় তা বাতিল করা হয়। কিন্তু আদালতের ওই আদেশের পর কোটার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে আবারও আন্দোলন শুরু হয়। ধীরে ধীরে আন্দোলন তীব্র হতে থাকে। এর মধ্যে ১৪ জুলাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার চীনফেরত সংবাদ সম্মেলনে কোটা আন্দোলনকারীদের ইঙ্গিত করে ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ মন্তব্য করলে তা আন্দোলনে ঘি ঢালার কাজ করে। দ্রুতই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। পরের কয়েকদিন সারাদেশে ব্যাপক আন্দোলন হয়, তা দমনে তীব্র বলপ্রয়োগ করে শেখ হাসিনার সরকার। এতে প্রচুর হতাহতের ঘটনা ঘটে।  

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে ১৯ জুলাই মধ্যরাত থেকে সারা দেশে কারফিউ জারি করে সরকার। তখন পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও কিছু কর্মকাণ্ড আন্দোলন উসকে দেয়। এর মধ্যে ঘরে ঘরে হানা দিয়ে শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার, সমন্বয়কদের তুলে নিয়ে ডিবির কার্যালয়ে আটকে রাখা এবং তাদের ভাত খাইয়ে তা প্রচার ও সেখান থেকেই বিবৃতি পাঠ করানোর ঘটনা নিন্দার ঝড় তোলে। সরকার হতাহতদের স্মরণে শোক ঘোষণা করলেও তা প্রত্যাখ্যান করে ‘লাল কাপড়’ বা ‘লাল ব্যাজ’ ধারণের ঘোষণা দেন শিক্ষার্থীরা। যে কর্মসূচি বিপুল সাড়া ফেলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ দেশজুড়ে।

আগস্টে আবার উত্তাল হয়ে ওঠে রাজপথ। ৩ আগস্ট রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশ করে সরকার পতনের এক দফা ঘোষণা করেন আন্দোলনকারীরা। ৪ আগস্ট তারা ডাক দেন সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের। কিন্তু সেদিন আন্দোলনকারীদের দমনে আওয়ামী লীগ দলীয় নেতা-কর্মীদের মাঠে নামায়। বগুড়া, হবিগঞ্জ, নরসিংদী, ফেনীসহ বেশ কিছু এলাকায় তীব্র সংঘাতে ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটে। তবে শেষ পর্যন্ত টিকতে পারেনি আওয়ামী লীগ। পুলিশ, র‌্যাবসহ নিরাপত্তা বাহিনীও পিছু হটে। ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে সৃষ্ট অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট সরকারের পতন ঘটে। ওই দিন প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগের পর পরই ভারতে পালিয়ে আশ্রয় নেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। বর্তমানে তিনি সেখানেই অবস্থান করছেন। সেদিনই আওয়ামী লীগের সব পর্যায়ের নেতা-কর্মী দ্রুত আত্মগোপনে চলে যান। এর মধ্যে শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের কেউ কেউ ওই দিনের আগে ও পরে দেশ ছেড়ে বিদেশে পালান।  

অস্তিত্বহীন আওয়ামী লীগ
শেখ হাসিনার সরকারের পতনের ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। এ সরকার দায়িত্ব নিয়েই জুলাই-আগস্টে হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিচারের প্রতিশ্রুতি দেয়।

সরকারের হিসাবেই প্রায় আট শ মানুষ অভ্যুত্থান চলাকালে প্রাণ হারিয়েছেন। আন্দোলনকারীদের হিসাবে তা প্রায় দেড় সহস্রাধিক। এত বিপুলসংখ্যক মানুষকে হত্যার অভিযোগ মাথায় নিয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব আত্মগোপনে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের নেতা-কর্মীরাও গা ঢাকা দিয়েছেন। তবে ক্ষমতাচ্যুত হওয়া আওয়ামী লীগ তাদের ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তৎপর হয়। নানা রকম পোস্ট দিয়ে নেতাকর্মীদের চাঙ্গা রাখতে সচেষ্ট হয়।

এরই অংশ হিসেবে ১৫ আগস্ট, ১০ নভেম্বর শহীদ নূর হোসেন দিবসসহ কয়েকটি উপলক্ষে নানা কায়দায় তারা রাজপথে দাঁড়াতে চাইলেও ব্যর্থ হয়েছে। রাজপথে এখনো যেন অস্তিত্বহীন আওয়ামী লীগ।  

এদিকে আন্দোলনের সময় ছাত্র-জনতার ওপর হামলা, হত্যা ও নির্যাতনের অভিযোগে দলের সভাপতি শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন, ওয়ার্ড পর্যায় পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী হাজার হাজার নেতা-কর্মীর নামে মামলা হয়েছে। শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে জেলা উপজেলা পর্যায়ের অনেক নেতা, সাবেক মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, এমপি গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। শেখ হাসিনার নামে এখন পর্যন্ত প্রায় আড়াই শ’ মামলা হয়েছে।  

বিশ্লেষকদের ভাষ্যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার পর আওয়ামী লীগ যে ভয়াবহ বিপর্যয়ে পড়ে, এর পর গত ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত এত ভয়াবহ বিপর্যয়ে আর পড়েনি। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার দীর্ঘ প্রায় পাঁচ মাস পেরোলেও এখনো আওয়ামী লীগ সংকট থেকে মুক্ত হতে পারেনি। ফিরতে পারেনি স্বাভাবিক রাজনীতিতে। কবে ফেরা যাবে, সেটাও বলতে পারছেন না তাদের শীর্ষস্থানীয় কেউ।

বাংলাদেশ সময়: ১২৩২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩০, ২০২৪
এসকে/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।