ঢাকা: বিদ্যুৎ উৎপাদন ১০ হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। আর এই মাইলফলক ছুঁয়েছে ২০১৩ সালেই।
আর সবেচেয়ে বিতর্কিত বিষয় ছিলো রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র। বছর জুড়েই আলোচনায় ছিলো কয়লা ভিত্তিক এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি। পরিবেশবাদীরা শুরু থেকেই এর বিরোধীতা করে আসছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ঠেকাতে লংমার্চসহ অনেক কর্মসূচি পালন করে বিরোধীরা।
কিন্তু সমালোচনাকে আমলে না নিয়ে ৬অক্টোবর কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা থেকে বিতর্কিত রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভিডিও কনফারেন্সে যোগদেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং।
রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনকে বিদ্যুৎ খাতের কলঙ্ক তিলক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন পরিবেশবাদীরা। এই কলঙ্ক তিলকে চাপা পড়ে যায় বিদ্যুৎ খাতের অনেক অর্জন।
তবে সরকার এই তিলক ছাপিয়ে অর্জনগুলোকে সামনে আনতে আলোক উৎসবের আয়োজন করে। ১২ নভেম্বর রাজধানীর হাতিরঝিলে প্রায় ১৫কোটি টাকা ব্যয়ে চোঁখ ধাঁধানো আলোক উৎসব করা হয়।
বিদ্যুৎ উৎপাদনে কুইক রেন্টাল (দ্রুত ভাড়া ভিত্তিক), রেন্টাল (ভাড়া ভিত্তিক) থেরাপি নিয়ে কঠোর সমালোচনা
রয়েছে। তবে এই সক্ষমতাকেই মাইলফলক হিসেবে দেখছে সংশ্লিষ্টরা। যদিও এই পরিমাণ বিদ্যুৎ সঞ্চালন করার সক্ষমতা বাংলাদেশের নেই।
বর্তমানে সর্বোচ্চ সাড়ে ৭হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সঞ্চালন করার সক্ষমতা রয়েছে বাংলাদেশের। এ বিষয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব মনোয়ার ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, যে কোন দেশের চাহিদার চেয়ে সক্ষমতা বেশি থাকতে হয়।
তিনি জানান, উৎপাদন কেন্দ্রগুলো একটি নির্দিষ্ট সময় পর সার্ভিসিং করতে হয়। তখন বাড়তি উৎপাদন ক্ষমতা কাজে লাগানো হয় লোডশেডিং ঠেকাতে। এ ছাড়া সঞ্চালন ক্ষমতা উন্নয়নের জন্য বেশ কয়েকটি প্রকল্প চলমান রয়েছে।
বর্তমান সরকার ক্ষমতা নেওয়ার সময় বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিলো ৪ হাজার ৯৩১ মেগাওয়াট। ৫ বছরে এই ক্ষমতা দ্বিগুণ করতে সক্ষম হয়েছে সরকার। তবে বেজড লোড বিদ্যুৎ কেন্দ্র না বসিয়ে কুইক রেন্টাল, এবং পিকিং বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সংখ্যা বেশি হওয়ায় এর স্থায়ীত্ব নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
বিদ্যুৎ খাতের সবচেয়ে বড় সমলোচনা রয়েছে তেলচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র বেশি স্থাপন করায়। এ কারণে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। সরকার যখন ক্ষমতা গ্রহণ করে তখন দেশে বিদ্যুতের গড় উৎপাদন খরচ ছিলো প্রায় সোয়া দুই টাকার মতো। মাত্র ৫ বছরের ব্যবধানে তা প্রায় ৬টাকায় গিয়ে ঠেকেছে।
পিডিবি সূত্র জানিয়েছে, রেন্টাল, কুইক রেন্টাল ও তেলভিত্তিক কেন্দ্রের জন্য বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। তেলচালিত বিদ্যুত কেন্দ্রগুলোতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুত উৎপাদনে ১৭ থেকে ২০ টাকা খরচ পড়ে। অন্যদিকে গ্যাস চালিত কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন খরচ ইউনিট প্রতি দুই টাকার কিছু নিচে।
বিদ্যুতের বর্ধিত মূল্য সামাল দিতে ৭ দফা দাম বাড়াতে বাধ্য হয়েছে সরকার। তারপরও প্রতি বছর প্রায় ৬হাজার কোটি টাকার মতো ভর্তুকি দিতে হয়েছে। তেল চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র কমাতে না পারলে ভর্তুকি দেওয়া অথবা আবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিকল্প নেই।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ৬৯টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ চুক্তি করেছে। যার মোট উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে ৯হাজার ৮৫৭ মেগাওয়াট। এরমধ্যে উৎপাদনে এসেছে ৩৫টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র। যার মোট উৎপাদন ক্ষমতা ২হাজার ৮৭৬মেগাওয়াট। আর অন্যান্যগুলো নির্মাণাধীন।
বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব মনোয়ার ইসলাম বলেন, সমালোচনা করা যায়। কিন্তু কাজ করাটা কঠিন। বিদ্যুৎ বিভাগ সেই কাজটাই করেছে।
কুইক রেন্টাল নিয়ে সমলোচনার জবাবে বলেন, এখন আর সমালোচনা নেই। প্রমাণিত হয়েছে কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিলো।
মাঝারি ও বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণ কাজ চলছে। এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে আসলে দেশের বিদ্যুৎ খাতের চেহারা আমূল পরিবর্তন সাধিত হবে বলেও দাবি করেন বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব।
সরকারের বিদায় বেলা আরও কিছুটা স্বস্তিদায়ক হতে পারত। কিন্তু ব্যাহত হয়েছে সামিট গ্রুপের হাতে জিম্মি হয়ে থাকায়। সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রীর পারিবারিক কোম্পানি হওয়ায় কোন রকম নিয়ম নীতির তোয়াক্কা করেনি সামিট গ্রুপ।
বিবিয়ানা-১, ২ বৃহৎ দু’টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাগিয়ে নিয়ে কাজ না করেই বসে থাকে। দফায় দফায় চিঠি দিলেও তারা কাজ করেনি। অথচ এই বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র দু’টি ২০১৩ সালের প্রথম দিকে উৎপাদনে আসার কথা ছিলো।
গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র দু’টি যথা সময়ে উৎপাদনে আসলে বিদ্যুৎখাত স্বস্তিদায়ক পরিস্থিতি বিরাজ করত।
শেষ সময়ে এসে আর কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নবায়ন করার প্রয়োজন পড়ত না। আর কুইক রেন্টাল বসিয়ে দিতে পারলে বিশাল অংকের ভর্তুকি থেকে রক্ষা পেত সরকার।
অভিযোগ রয়েছে কুইক রেন্টালের সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সামিট গ্রুপ। তাদের নিজেদেরও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। যে কারণে অর্থ হাতিয়ে নিতে বিবিয়ানা-১ ও ২ বিদ্যুৎ কেন্দ্র আটকে রাখে।
সরকারও নিজেকে সামিটের হাতে নিজেক সপে দিয়ে হাত গুটিয়ে বসে ছিলো। যে কারণে আইন অমাণ্য করলেও শুরুতেই কোনই ব্যবস্থা নেয়নি। আর যার মাসুল গুণতে হচ্ছে জনগণকে।
প্রথম দিকে সামিটকে ছাড় না দিয়ে চুক্তি বাতিল করতে পারত সরকার। অন্য কোন কোম্পানিকে দিয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্র দু’টি করানো যেত। তাহলে বিদ্যুৎ খাত স্থায়ী ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারত। সরকারও বড় গলায় তুলে ধরে পারতো তাদের অর্জন।
বাংলাদেশ সময়: ১২৩০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৮, ২০১৩
সম্পাদনা: নূরনবী সিদ্দিক সুইন, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর