ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

সালতামামি

সাংবাদিকদের আনলাকি থার্টিন!

দেলোয়ার হোসেন বাদল, স্টাফ ফটো করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৪৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১, ২০১৪
সাংবাদিকদের আনলাকি থার্টিন! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম/ ফাইল ফটো

ঢাকা: ফেলে আসা ২০১৩ সাল ছিলো বাংলাদেশের সাংবাদিক ও সংবাদকর্মীদের জন্য একটা চ্যালেঞ্জিং বছর। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বছরটিতে যেমন আনন্দের উৎসের ঘাটতি ছিলো না, তেমনি অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটনাও তাদের জন্য বয়ে নিয়ে আসে বেদন‍ার মুহূর্ত।



সার্বিক দিক বিবেচনা করে তাই বাংলাদেশের সাংবাদিকদের জন্য ২০১৩ সালকে বিবেচনা করা যেতে পারে ‘আনলাকি থার্টিন’ হিসেবেই।

আসলে কেমন কেটেছে বছরটি সাংবাদিকদের জন্য? দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কী কী বাধার সামনে পড়তে হয়েছে তাদের ? ভাবছিলাম বছর শেষের সালতামামিতে লিখবো এসব নিয়েই।

লিখতে বসে ফেলে আসা বছরটির স্মৃতি রোমন্থন করতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো, চোখের সামনে ভেসে উঠলো পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে সাংবাদিকদের বিভিন্ন নির্যাতনের শিকার হওয়ার নানা ঘটনা।

সময়টা ২০১৩ সালের ৬ মার্চ। প্রতিদিনের মতোই পেশাগত দায়িত্বপালনে নয়াপল্টনস্থ বিএনপির প্রধান কার্যালয়ে। দিন গড়িয়ে বিকেল ৩টা। চলছে বিএনপিসহ ১৮ দলীয় জোটের বিক্ষোভ সমাবেশ।

হঠাৎ শুরু হলো বিএনপি-জামায়াত কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ। ছবি তুলতে ট্রাকের ওপর স্থাপন করা অস্থায়ী মঞ্চে উঠতেই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর লাঠিচার্জ। সাংবাদিক পরিচয় দিয়েও রেহাই পাওয়া গেলো না পুলিশের মার থেকে।

পুলিশের লাঠির আঘাত এসে পড়লো মাথায়। রেহাই পায়নি হাতে থাকা ক্যামেরাও। এক পর্যায়ে মিডিয়া কর্মীরা আমাকে নিয়ে যান হাসপাতালে।

এ দিন শুধু আমি (দেলোয়ার হোসেন বাদল) নই, পুলিশের লাঠির আঘাতে ইন্ডিপেন্ডেন্টের জুলহাস, প্রথম আলোর সাজিদ, নিউএজের মিন্টু, নয়াদিগন্তের পিপুলসহ আরও কয়েকজন সাংবাদকর্মী মারাত্মকভাবে আহত হন।

শুধু এই একটি ঘটনাই নয়, আনলাকি থার্টিনের খাঁড়া যেন পুরো বছর জুড়েই ছিলো সাংবাদিকদের মাথার ওপর।

১৬ জানুয়ারি মরিচের গুঁড়া
জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার ডাকা অর্ধদিবস হরতাল চলছে। রাজধানীর পুরানা পল্টনে উপস্থিত বাংলানিউজের স্টাফ করেসপন্ডেন্ট সাজেদা সুইটি ও ফটো করেসপন্ডেন্ট জাহিদ সায়মন। নেতাকর্মীরা মিছিল করতে গেলে পুলিশ মিছিল লক্ষ্য করে মরিচের গুঁড়া (পিপার স্প্রে) ছোড়ে। লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় মিছিল। শুরু হয় নেতাকর্মীদের এদিক-সেদিক ছোটাছুটি।

পুলিশের ছিটানো গুঁড়া মরিচের কবল থেকে মুক্তি পাননি সুইটি, সায়মনসহ আরও ২০ জন সাংবাদিক। গুঁড়া মরিচের স্পর্শে চোখে কিছু না দেখতে পেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়তে হয় তাদের। পরে কয়েকজন সাংবাদিক তাদের উদ্ধার করে নিয়ে যান নিরাপদ স্থানে।
 
২২শে ফেব্রুয়ারি মসজিদ থেকে আক্রমণ
অন্যান্য শুক্রবারের মতো এ দিনও জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে সংবাদ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে সমাবেত হন বিভিন্ন গণমাধ্যম কর্মীরা। জুমার নামাজ শেষে মুসল্লিরা মসজিদ থেকে বের হওয়ার আগেই আচমকা ভেতর থেকে সাংবাদিকদের উপর আক্রমণ চালায় জামায়াত কর্মীরা।

সাংবাদিকদের উপর জুতা ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকেন তারা। ইটের আঘাতে রক্তাক্ত হন মাছরাঙা টেলিভিশনের সিনিয়র রিপোর্টার আবদুল্লাহ তুহিন, এটিএন বাংলার ক্যামেরাম্যান ইমরান তুহিন ও এটিএন নিউজের ফেরদৌসসহ আরও কয়েকজন সংবাদকর্মী।

৫ মে ২০১৩ হেফাজতের আক্রমণে সাইমন হাসপাতালে
কট্টর ইসলামি সংগঠন হিসেবে হঠাৎই গজিয়ে ওঠা হেফাজতের সমাবেশকে কেন্দ্র করে সকাল থেকেই রাজধানীতে থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছিলো। রাস্তায় যানবাহনও ছিল খুবই কম। মতিঝিল শাপলা চত্বর সমাবেশ করবে হেফাজত। বিকেল তিনটার আগেই মতিঝিল দখল নেয় তারা। বিভিন্ন এলাকায় হেফাজতের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় পুলিশ ও আওয়ামী লীগ সমর্থকদের। ক্রমেই তা ছড়িয়ে পড়ে মতিঝিল ও আশ-পাশের এলাকায়। শেষ হয় মধ্যরাতের রোমহর্ষক অভিযানের মধ্য দিয়ে।

সেদিন বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটের কাছে পেশাগত দায়িত্ব পালন করছিলেন বাংলানিউজের স্টাফ ফটো করেসপন্ডেন্ট জাহিদ সায়মন। দুপুর ১টা। শুরু হয়ে যায় হেফাজতের সঙ্গে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের সংঘর্ষ। আচমকা উড়ে আসা একটি ইটের আঘাতে গুরুতর আহত হন সায়মন। মাথা ফেটে রক্তক্ষরণ হতে থাকে তার। দ্রুত তাকে নেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেদিন সমাবেশে ইটিভির স্টাফ রিপোর্টার নাদিয়া শারমিনসহ আহত হন আরও ২৫জন সংবাদকর্মী। একইসঙ্গে লাঞ্ছিত হন বিভিন্ন গণমাধ্যমের নারী সংবাদকর্মীরা।

২২শে জুন এমপি রনি মারলেন সাংবাদিককে
সংবাদের খোঁজে ইনডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের দুই সাংবাদিক সরকারি দলের সংসদ সদস্য গোলাম মাওলা রনির কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেয়। সেখানেই রনি ও তার লোকজন তাদের আটকে রেখে নির্যাতন চালায়। খবর পেয়ে জাতীয় প্রেসক্লাব ও ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) থেকে কয়েকজন সংবাদকর্মী মারাত্মক আহত অবস্থায় তাদের উদ্ধার করে আনেন। অবশ্য সংবাদকর্মীদের আন্দোলনের মুখে পড়ে এই ঘটনায় এমপি রনিকে কয়েক মাস জেলহাজতেও কাটাতে হয়েছে।

১৩ই অক্টোবর পুলিশ অপরাধী ধরতে না পেরে
চলছে বিএনপিসহ ১৮ দলীয় জোটের হরতাল। বাসাবো এলাকায় দায়িত্ব পালনরত একটি অনলাইন পত্রিকার ফটোসাংবাদিক সুমন শেখ নিলয়। হঠাৎ কে বা কারা ককটেল নিক্ষেপ করলে পুলিশ সন্দেহ জনকভাবে সুমনকে আটক করে ভ্রাম্যমাণ আদালতের হাতে তুলে দেয়। সাংবাদিক পরিচয় দেয়ার পরও আদ‍ালত তাকে তিন মাসের কারাদণ্ড দেন।

৯ই নভেম্বর  ‍স্প্লিন্টারের আঘাতে সাংবাদিকের চোখ নষ্ট
রাত আনুমানিক ৮.৩০ মিনিট। বংশাল জামায়েতের একটি মিছিল বের হবে সংবাদ পেয়ে সেখানে উপস্থিত হন অনলাইন পত্রিকার ফটোসাংবাদিক মোশাররফ হোসেনসহ আরো অনেক ফটোসাংবাদিক। মিছিল শুরু হলে পুলিশ আচমকাই এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে। ছররা গুলির একটি ‍স্প্লিন্টার এসে ঢোকে মোশারফের চোখে। সঙ্গে সঙ্গে সহকর্মীরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলেও চিরতরে নষ্ট হয়ে যায় তার ডান চোখটি।
 
১১ই নভেম্বর ককটেল টার্গেটে সাংবাদিক
সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা। বাংলানিউজের স্টাফ করেসপন্ডেন্ট সাঈদ শিপন হরতালের দায়িত্ব পালনে মটরবাইকে রাজধানীর পথে। রাস্তার বিপরীত দিক থেকে হঠাৎ চলন্ত মটরবাইক লক্ষ্য করে ককটেল নিক্ষেপ করে দুর্বত্তরা। তাদের ছোড়া ককটেলে ডান হাতের কুনই’র নীচে দুই স্থানে ক্ষত সৃষ্টি হয় তার। ফাঁকা রাস্তায় কাউকে না পেয়ে আহত অবস্থায় মোটরবাইক চালিয়ে দ্রুত সরে গেলেও নিউজ দিতে ভুল করেননি শিপন।

২৫শে নভেম্বরের আঘাতে সায়মন বিছানায়
পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে সন্ধ্যা সাতটায় বাংলানিউজের স্টাফ ফটো করেসপন্ডেন্ট জাহিদ সায়মন পৌঁছান রাজধানীর মহাখালী এলাকায়। ফ্লাইওভারের নিচে আসতেই সায়মনকে লক্ষ্য করে দুর্বৃত্তদের ককটেল। এ ঘটনায় কেটে ফেলতে হয়েছে তার ডান পায়ের দুইটি আঙ্গুলের কিছু অংশ। মারাত্মক আহত সায়মন এখনো কাতরাচ্ছেন বিছানায় শুয়ে।

২৬শে নভেম্বর সুইটির পায়ে ৫টি স্প্লিন্টার
সন্ধ্যায় নয়াপল্টনে বিএনপি কার্যালয়ের সামনে ককটেল বিস্ফোরণে আহত হন বাংলানিউজের সাজেদা সুইটিসহ ইন্ডিপেন্ডেন্ট ও এসএটিভির আরও দুই সংবাদকর্মী। এ ঘটনায় সুইটির দুই পায়ে স্প্লিন্টারের আঘাতে ৫টি ক্ষতের সৃষ্টি হয়। অপারেশনের মাধ্যমে স্প্লিন্টারগুলো বের করা হলেও যন্ত্রণার হাত থেকে এখনও মুক্তি মেলেনি সুইটির।

১লা ডিসেম্বর সাংবাদিক যখন আটক
অবরোধকারীদের ককটেল নিক্ষেপে প্ররোচিত করার অভিযোগে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আরটিভির সিটি রিপোর্টার তানজিদ রনি ও ক্যামেরা পারসন প্রশান্ত মোদককে আটক করে পুলিশ। সকাল সাড়ে সাতটার দিকে কামরাঙ্গীর চরের ৫৬ নম্বর ওয়ার্ড এলাকা থেকে তাদের আটক করা হয়। একরাত জেল হাজতে আটক থাকার পর সাংবাদিকদের আন্দোলনের মুখে মুক্তি মেলে তাদের।

এখানে রাজধানীতে সংঘটিত মাত্র কয়েকটি ঘটনার উদাহরণ টানা হলো। এছাড়া সারা দেশে সংঘটিত হয়েছে এরকম আরও শত শত ছোট বড় ঘটনা। এসব বিবেচনা করলে সাংবাদিকদের জন্য বছরটি আনলাকি থার্টিনই বটে।

বাংলাদেশ সময়: ২০২৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০১, ২০১৪
সম্পাদনা: খুররম জামান, ডিপ্লোম্যাটিক অ্যাফেয়ার্স এডিটর ও রাইসুল ইসলাম, অ্যাসিস্ট্যান্ট আউটপুট এডিটর (অ্যাক্ট.)

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।