দীর্ঘ ছয় বছর পর ‘২০১৬’-তেই বিএনপি সেরে ফেলেছে দলের ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল। নেতৃত্বের উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন না হলেও প্রচণ্ড চাপে থাকা দলটির জন্য এই কাউন্সিল ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
রাজপথের সক্রিয় আন্দোলন থেকে বেশ দূরে অবস্থান করা বিএনপি জাতীয় নির্বাচন বর্জন করলেও স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছে। অবশ্য এ বছর অনুষ্ঠিত দলীয় প্রতীকে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে খুব একটা ভালো করতে পারেনি দলটি। খারাপ ফলের পেছনে বরাবরই তারা নির্বাচন কমিশন ও সরকারের পক্ষপাতমূলক আচরণকে দায়ী করেছে।
তবে, বছর শেষে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রচণ্ড রকম ধাক্কা খেয়েছে বিএনপি। স্মরণকালের ইতিহাসে সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত ধানের শীষের প্রার্থী নৌকার প্রার্থীর কাছে ন্যাক্কারজনকভাবে হেরেছেন।
ফলে, দীর্ঘদিন ধরে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি করে আসা বিএনপি শান্তিপূর্ণ নির্বাচনেও ভালো ফল করতে না পেরে দুর্ভাবনায় পড়েছে। যদিও বিষয়টিকে আংশিক বিজয় হিসেবে উল্লেখ করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ পালন:
সীমিত পরিসরে ৫ জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনটিকে ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ হিসেবে পালনের মধ্য দিয়ে বছরের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করে বিএনপি। নিরুত্তাপ ওই কর্মসূচি ছিল ২০১৬ সালে বিএনপির প্রথম রাজনৈতিক কর্মসূচি।
জাতীয় কাউন্সিল:
দুই দফায় সরকারবিরোধী আন্দোলনে ব্যর্থ বিএনপি কয়েকদফা সম্মেলন করার প্রস্তুতি নিয়েও করতে পারছিলো না। তবে, ২০১৬-এর ১৯ মার্চ দলের ষষ্ঠ কাউন্সিল আয়োজন করে দলটি। কাউন্সিলের আগেই খালেদা জিয়া চেয়ারপারসন ও তারেক রহমান সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। কাউন্সিলের ১১ দিনের মাথায় মহাসচিব হন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
এরপর ৯ এপ্রিল নতুন ৬ জনসহ ৭ জন যুগ্ম মহাসচিব এবং ৮ জন সাংগঠনিক সম্পাদকের নাম ঘোষণা করে দলটি। ১৮ এপ্রিল ২০ জন সহ-সাংগঠনিক সম্পাদকের নাম ঘোষণা করা হয়। কাউন্সিলের সাড়ে চার মাস পর পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়। দুটি পদ ফাঁকা রেখে ১৭ সদস্যের স্থায়ী কমিটি, ৭৩ সদস্যের উপদেষ্টা পরিষদ এবং ৫০২ সদস্যের নির্বাহী কমিটি ঘোষণা করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
দল গোছানোর অংশ হিসেবে মেয়াদোত্তীর্ণ জেলা কমিটিগুলো পুনর্গঠনের কাজ প্রায় অর্ধেক শেষ করেছে দলটি। অঙ্গ সংগঠন হিসেবে ছাত্রদলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন, স্বেচ্ছাসেবক দলের সুপার ফাইভ কমিটি, মহিলা দলের নতুন কমিটি দিতে পেরেছে বিএনপি।
জাতীয় ইস্যুতে সোচ্চার বিএনপি:
চলতি বছরে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার নাসিরনগর, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জসহ দেশের বিভিন্নস্থানে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা পালন করেছে বিএনপি। তবে, কৌশলগত কারণে এসব ইস্যুতে কোনো কর্মসূচি দেয় নি দলটি। প্রতিনিধি দল পাঠিয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও প্রতিবেদন তৈরি করেছে তারা।
সরকার উৎখাতে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ:
বাংলাদেশের সরকার উৎখাতে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে গত ১৫ মে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরীকে গ্রেফতার করা হয়। ইসরায়েলের ক্ষমতাসীন লিকুদ পার্টির সদস্য মেন্দি এন সাফাদির সঙ্গে আসলামের একটি ছবি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশের পর আলোচনায় আসেন এই নেতা। আওয়ামী লীগের অভিযোগ, শেখ হাসিনা সরকারকে উৎখাত করতে বিএনপি ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েল এবং দেশটির গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সঙ্গে মিলে ‘ষড়যন্ত্র’ করেছে।
জন্মদিনে কেক কাটেন নি খালেদা:
শুধু বিএনপির রাজনীতি নয়, বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন এক ইতিবাচক ঘটনার জন্ম হয়েছে ২০১৬ সালে। প্রায় আড়াই দশক ধরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদতবার্ষিকীর দিন ১৫ আগস্ট জন্মদিন পালন করে আসছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। কিন্তু এ বছর সেই জন্মদিন পালন করেন নি তিনি।
জিয়ার সমাধিসৌধ অপসারণ ইস্যু:
সংসদ ভবন ও এর আশপাশের এলাকায় লুই আই কানের নকশা বহির্ভূত সব স্থাপনা সরিয়ে নেওয়ার সরকারি ঘোষণার পর সোচ্চার হয়ে ওঠে বিএনপি। কিন্তু সিদ্ধান্ত এখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন না হওয়ায় আপাতত নীরব আছে দলটি।
জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা পদক প্রত্যাহার:
এ বছর বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি, মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার জিয়াউর রহমান বীর উত্তমের স্বাধীনতা পদক প্রত্যাহার করা হয়। জাতীয় পুরস্কার সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে বিএনপি। কিন্তু কোনো কর্মসূচি তারা দেয়নি।
হলি আর্টিজানে হামলা ও বিএনপির জাতীয় ঐক্য:
গত ১ জুলাই রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলার পর উগ্রবাদ ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার জন্য দল-মত-নির্বিশেষে সবার প্রতি আহ্বান জানান খালেদা জিয়া। এজন্য দেশের বড় দুই রাজনৈতিক জোটের বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা শুরু করে বিএনপি। কিন্তু কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম ছাড়া আর কেউ খালেদা জিয়ার সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসেন নি।
টুইটারে খালেদা:
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটারে এবছর নিজের অ্যাকাউন্ট খোলেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। গত ২ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে তার এই অ্যাকাউন্ট উদ্বোধন করেন বিএনপি নেত্রী নিজেই। এই অ্যাকাউন্ট থেকেই তিনি নিয়মিত বিভিন্ন ইস্যুতে টুইট করে যাচ্ছেন।
নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে খালেদার প্রস্তাব:
নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনে গত ১৮ নভেম্বর দলের পক্ষে ১৩ দফা প্রস্তাব তুলে ধরেন খালেদা জিয়া। তার এই প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক মহলে বেশ কিছুদিন ব্যাপক আলোচনা, বিশ্লেষণ, মতামত ও প্রতিক্রিয়া অব্যাহত ছিল।
রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনা:
নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে গত ১৮ ডিসেম্বর প্রথমেই বিএনপির সঙ্গে সংলাপ করেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। সংলাপে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের আগে বাছাই কমিটি গঠনের বিষয়ে খালেদা জিয়া রাষ্ট্রপতির কাছে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দেন।
নাসিক নির্বাচন:
প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন খান আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী সেলিনা হায়াত আইভীর কাছে বিপুল ভোটে হেরে যান। নির্ধারিত দিনে ভোটগ্রহণকালে তিন দফা সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি স্বীকার করে নেয় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হচ্ছে। ভোটের পরিবেশ সন্তোষজনক।
কিন্তু দিন শেষে ফলাফল নিজেদের অনুকুলে না আসায় ভেতরে সূক্ষ্ণ কারচুপি হয়েছে বলে অভিযোগ তোলে বিএনপি। ভোটের ফলাফল খতিয়ে দেখতে বিচার বিভাগীয় তদন্তও দাবি করে তারা। ভোটের এক সপ্তাহ পর খালেদা জিয়া বলেন, ‘উপরে ফিটফাট, ভেতরে ষড়ন্ত্র’।
যাদের হারালো বিএনপি:
এবছর বিএনপি হারিয়েছে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আ স ম হান্নান শাহকে। গত ২৭ সেপ্টেম্বর সিঙ্গাপুরের রাফেলস হার্ট সেন্টারে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ১১ আগস্ট পরকালে পাড়ি জমান বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ফজলুর রহমান পটল। স্থায়ী কমিটির সাবেক সদস্য ড. আর এ গণি রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান গত ১৫ জানুয়ারি। সম্প্রতি মারা যান বিএনপি নেতা ও প্রাক্তন এলজিআরডি প্রতিমন্ত্রী জিয়াউল হক।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৪১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১৬
এজেড/পিসি