অথচ ২০১০ সালে মহাধসের ছয় বছর পর ২০১৬ পর্যন্ত এ কোম্পানির শেয়ারের দাম ২৫০ টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো। তবে ২০১৭ সালে ঘুরে দাঁড়াতে থাকা পুঁজিবাজারে শুধু গ্রামীণফোনই নয়, ছয় বছর পর বেড়েছে বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ারের দাম।
এর ফলে এ বছর ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে লেনদেন, সূচক ও বাজার মূলধনসহ প্রায় সবক’টি সূচক বেড়েছে। এর মধ্যে কোনো কোনোটি অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে। এতে একদিকে বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতা ও তারল্য সংকট উভয় কমেছে। অন্যদিকে বিদেশি বিনিয়োগেও চলতি বছর মাইলফলক সৃষ্টি করে। এতে বাজারে নতুন করে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারী প্রবেশ করেছে।
এ বিষয়ে ডিএসই’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কে এ এম মাজেদুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, দীর্ঘ সময় পর ২০১৭ সালে পুঁজিবাজার এক নতুন মাত্রায় পৌঁছে। দু’একবার দরপতন হয়েছে, যা স্বাভাবিক নিয়ম।
এমডি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, নতুন বছরে বাজার সংশ্লিষ্টদের সমন্বিত প্রচেষ্টা ও বিনিয়োগকারীদের আত্মবিশ্বাসকে পুঁজি করে পুঁজিবাজারের টেকসই প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। দেশের পুঁজিবাজার হবে উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের একটি বড় মাধ্যম।
ডিএসইর বাজার চিত্র: ছয় বছর পর ২০১৭ সালে ফুরফুরে মেজাজে পুঁজিবাজারে লেনদেন শুরু হয়। কিন্ত বিভিন্ন ইস্যুতে ছোট-বড় তিন দফা দরপতন হয়। তবে বছরটির বেশিরভাগ সময় সূচকের উত্থানের মধ্য দিয়ে পার হয়েছে।
২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার পর বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বাজার নিয়ে নতুন প্রত্যাশার সৃষ্টি হয়। এর ফলে ৮ অক্টোবর পর্যন্ত আবারও ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে বাজার। বছরের বাকি সময় লেনদেন হয়েছে সূচক ওঠানামার মধ্য দিয়ে। বছর শেষে লেনদেন, সূচক, বাজার মূলধন বৃদ্ধির পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের লেনদেন বৃদ্ধিতে সর্বোচ্চ রেকর্ড গড়েছে।
লেনদেনে নতুন রেকর্ড
উত্থান-পতনের বাজারে ২০১৭ সালে ডিএসইতে মোট ২৪৮ কার্যদিবসে লেনদেন হয়েছে ২ লাখ ১৬ হাজার ৯৫৯ কোটি ৭১ লাখ টাকা। যা ২০১৬ সালের চেয়ে ৯৭ হাজার ৮০২ কোটি ৫৯ লাখ টাকা বেশি। শতাংশের হিসাবে ২০১৬ সালের চেয়ে ৮২ দশমিক ৮ শতাংশ বেশি। শুধু তাই নয়, ২০১০ সালের পর সর্বোচ্চ লেনদেন।
সূচকের নতুন মাইলফলক
লেনদেনের পাশাপাশি একইচিত্র ছিলো ডিএসইর তিনটি সূচকেও। এরমধ্যে প্রধান সূচক ডিএসইএক্স আগের বছরের চেয়ে ১ হাজার ২০৮ পয়েন্ট বেড়ে ৬ হাজার ২৪৪ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। যা ডিএসইএক্স সূচক সৃষ্টির পর সর্বোচ্চ অবস্থানে।
সর্বোচ্চ অবস্থানে বাজার মূলধন
লেনদেন ও সূচকের পাশাপাশি ডিএসই’র বাজার মূলধন গত বছরের চেয়ে ৮১ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা বেড়ে ৪ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। যা পুঁজিবাজারের ইতিহাসে নতুন মাইলফলক।
বিদেশি বিনিয়োগের সব রেকর্ড ভঙ্গ
এসবের ফলে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগেও ইতিহাসের মধ্যে সর্বোচ্চ লেনদেন হয়েছে। ২০১৭ সালে গত বছরের চেয়ে ২ হাজার ৬৭৪ কোটি ৩৪ লাখ টাকা বেশি লেনদেন হয়ে দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ৪৪৭ কোটি ৬৩ লাখ টাকায়। অন্যদিকে সরকার ডিএসই থেকে রাজস্ব আয়ও বেশি পেয়েছে।
বছরজুড়ে উদ্যোগ: কারসাজি বন্ধ করে বাজারকে স্থিতিশীল রাখতে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন দু’টি উল্লেখ্যযোগ্য উদ্যোগ নিয়েছে। একটি হলো- পাবলিক ইস্যু রুলস-২০১৫ এর সংশোধনী। জানুয়ারিতে কাজ শুরু করে যা চলতি বছরের ৬ জুলাই গেজেট প্রকাশিত হয়। নতুন এ সংশোধনী অনুযায়ী বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে দু’টি কোম্পানিকে আইপিওর অনুমোদন দিয়েছে কমিশন।
আরেকটি হলো- বিনিয়োগকারীদের সচেতন করতে সারাদেশে কমিশনের আর্থিক শিক্ষা কর্মসূচি গ্রহণ। স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ভিক্তিতে জনগণকে আর্থিক বিষয়ে সচেতন করার উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৮ জানুয়ারি উদ্বোধন করেন। এ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে দেশের বিভিন্ন বিভাগে বিনিয়োগ শিক্ষার উপর বিভিন্ন সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে।
আইপিও, রাইট এবং বোনাস শেয়ার অনুমোদন: পুঁজিবাজারকে সম্প্রসারিত করতে বিদায়ী বছরে কমিশন একটি মিউচ্যুয়াল ফান্ডসহ মোট ৭টি কোম্পানিকে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে ২১৯ কোটি ২৫ লাখ টাকা মূলধন সংগ্রহের অনুমোদন দিয়েছে। একই সময়ে ৪ কোম্পানি ৮৬ কোটি ৮০ লাখ রাইট শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে মোট ১ হাজার ১১৪ কোটি ২ লাখ টাকা মূলধন উত্তোলনের অনুমোদন দিয়েছে।
এছাড়াও বোনাস শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে ১৪২টি কোম্পানিকে ২৭৯ কোটি ২৯ লাখ বোনাস শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে ২ হাজার ৮০৭ কোটি ৬৬ লাখ টাকা মূলধন বৃদ্ধি’র অনুমোদন দিয়েছে কমিশন।
মোবাইল লেনদেন
দেশের দু’টি স্টক এক্সচেঞ্জ এর মধ্যে ডিএসই অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে মোবাইলে লেনদেন জনপ্রিয় করতে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে। যার ফলে বিনিয়োগকারীদের লেনদেনের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়িয়েছে ২৫ হাজার ২৬ জনে।
ওটিসিতে লেনদেন
ওভার দ্যা কাউন্টার মার্কেটে (ওটিসি) ১০৮ লাখ ৮৫ হাজার শেয়ারের মোট ৭২ কোটি ৬৫ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে।
দেশের অপর বাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জেও (সিএসই) সবক’টি সূচক বেড়েছে। তার মধ্যে সিএসইর প্রধান সূচক সিএসইএক্স ২০১৬ সালের চেয়ে দুই হাজার পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ৬৪৯ দশমিক ৬২ পয়েন্টে। সিএসইর তথ্য মতে, ২০১৬ সালে ২৯ ডিসেম্বর সূচক ছিলো ৯ হাজার ৩৬৯ দশমিক ৯১ পয়েন্ট।
এ সময়ে সিএসইর বাজার মূলধন ৭৮ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৫২ হাজার ৮৯১ কোটি টাকায়। ২০১৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর বাজার মূলধন ছিলো ২ লাখ ৭৪ হাজার ১৩৪ কোটি টাকা।
তবে মুনাফা পেলেও বাজারের ‘দোলাচলে’ সদাই পুঁজি হারানোর ভয়ে থাকেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। এ বছরও বাজারে বেশ কয়েকটি শেয়ারের কারসাজি নজরে এসেছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি)। যার কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি কোম্পানি। আগামী বছরে নতুন করে যেন পুঁজি আর হারাতে না হয় সে প্রত্যাশাই বিনিয়োগকারীদের।
বাংলাদেশ সময়: ০৪৩৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০১, ২০১৮
এমএফআই/জেডএস