ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

সালতামামি

সালতামামি-২০২০

‘কানেকটেড’ ছিল সরকার

ইসমাইল হোসেন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৪৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩০, ২০২০
‘কানেকটেড’ ছিল সরকার

ঢাকা: করোনা মহামারি প্রতিরোধে দেশেব্যাপী সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার, কয়েক দফা বাড়ানো ছুটি গড়ায় ৬৬তম দিনে। সাধারণ ছুটিতেও মাঠ প্রশাসনকে সক্রিয় রাখার মধ্য দিয়ে সরকার জনগণকে সেবা দেওয়ার চেষ্টা করেছে।

সরকারি কর্মচারীরা পুরোদমে যে কাজ করেছেন, তার নেপথ্যে ছিল মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
 
মহামারির কারণে সরকারের উন্নয়নে যে সংকট তা উৎরে আগামী বছরটা আরও ভালো করতে সরকার কাজ করবে বলে জানিয়েছেন জনপ্রশাসন সচিব শেখ ইউসুফ হারুন।
 
গেল বছরে করোনাকালে প্রথম সারির যোদ্ধা হিসেবে অগ্রভাগে কাজ করেছেন জনপ্রশাসনের নেতৃত্বাধীন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একের পর এক নির্দেশনা মূলত বাস্তবায়ন করেছেন দেশব্যাপী ছড়িয়ে থাকা প্রশাসনের কর্তা-ব্যক্তিরাই। ভার্চ্যুয়াল আর সরাসরি মাঠে থেকে কাজ করেছেন তারা। আর তাতে অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। মারাও গেছেন কয়েকজন। তবে মাঠ প্রশাসনের সাথে সর্বদাই ‘কানেকটেড’ ছিল জনপ্রশাসন।  
 
জনপ্রশাসন সচিব শেখ ইউসুফ হারুন বাংলানিউজকে বলেন, করোনার সময় আমাদের চ্যালেঞ্জ ছিল মাঠ প্রশাসনকে নিয়ে, কিন্তু আমরা যথাযথভাবে তাদের কাজে লাগাতে পেরেছি।  

সামনের বছরের পরিকল্পনা ও চ্যালেঞ্জ নয়ে জনপ্রশাসন সচিব বলেন, করোনার কারণে এ বছর আমরা উন্নয়নে পিছিয়ে পড়েছি। আমাদের প্রবৃদ্ধি থাকার কথা ছিল ৮ দশমিক ৪। অর্জিত হয়েছে ৫ দশমিক ৪। আগামী বছর আমরা প্রবৃদ্ধি সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাই।  
 
গেল বছর সরকার তথা প্রশাসনে বেশকিছু আলোচিত ঘটনা ছিল। করোনায় মারা যান একজন প্রতিমন্ত্রী, দু-জন সচিবসহ অনেক কর্মকর্তা। আর আক্রান্ত হন এক ডজন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী। বছরের শুরুতে এবং শেষে মন্ত্রিসভায় কিছু রদবদল ঘটেছে। মাঠ প্রশাসনকে সামাল দিলেও করোনার কারণে এবছর ডিসি সম্মেলন করা যায়নি।
 
আর বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য আলোচনায় ছিলেন কুড়িগ্রামের ডিসি সুলতানা পারভীন। দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ওয়াহিদা খানমের উপর হামলার খবর ছিল আলোচনায়।
 
টানা ৬৬ দিন ছুটির রেকর্ড সরকারে

করোনার কারণে ২৬ মার্চ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত টানা ৬৬ দিন ছুটির কবলে ছিল দেশ। গত ৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের পর ২৩ মার্চ সচিবালয়ে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত দেশের সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা করেন। পরে সব ধরনের গণপরিবহনও বন্ধ করে দেওয়া হয়। কয়েক দফা ছুটি বাড়ানোর পর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা এবং সাধারণ মানুষের জীবিকা নিয়ে ভোগান্তি তৈরি হয়। এসময় বেশ কয়েকটি জেলা ও রাজধানীর বিশেষ এলাকাও লকডাউন করা হয়।
 
পরে সীমিত পরিসরে ৩১ মে থেকে অফিস-আদালত ও ১ জুন থেকে গণপরিবহন খুলে দেওয়া হয়। এভাবে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে থাকে মানুষের জীবনযাত্রা।
 
ডিসি সম্মেলনহীন বছর

প্রতিবছর মাঠ প্রশাসনের ডিসিদের সাথে সরাসরি কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু করোনা ভাইরাস সংক্রমণের কারণে ২০২০ সালে ডিসি সম্মেলন হলো না। এই সম্মেলন ২০২১ সালের ৫-৭ জানুয়ারি হওয়ার কথা থাকলেও তা স্থগিত করা হয়েছে।

সরকারের নীতিনির্ধারক ও ডিসিদের সরাসরি মতবিনিময় এবং প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা দেওয়ার জন্য প্রতি বছর জুলাই মাসে ডিসি সম্মেলনের আয়োজন করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
 
ভার্চ্যুয়াল যুগে মন্ত্রিসভা

করোনার কারণে একসাথে বসে মন্ত্রিসভার বৈঠক হলেও প্রথমবারের মতো সেই বৈঠক ভার্চ্যুায়ালি অনুষ্ঠিত হয় গত ১৩ জুলাই। গণভবন থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে মন্ত্রীরা ভিডি কনফারেন্সে এতে অংশ নেন।
 
ভার্চ্যুয়াল মন্ত্রিসভার বৈঠকে সচিবালয় প্রান্তে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের যুগ্মসচিব (মন্ত্রিসভা অধিশাখা) মো. রাহাত আনোয়ারও যুক্ত ছিলেন।
 
ওই দিন তিনি বাংলানিউজকে বলেন, আজ সম্পূর্ণ ভার্চ্যুয়াল মিটিং হয়েছে। গণভবন প্রান্তে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মুখ্য সচিব স্যার এবং ওবায়দুল কাদের স্যার ছিলেন। আর এ প্রান্তে সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব স্যার, সাতজন মন্ত্রী এবং সাতজন সচিব যুক্ত ছিলেন।
 
প্রশাসনে কুড়িগ্রামের ‘ডিসি ঝড়’

চলতি বছর মাঠ প্রশাসনে কুড়িগ্রামের সাবেক ডিসি মোছা. সুলতানা পারভীনের ক্ষমতার অপব্যবহারে প্রশাসনে সমালোচনা তৈরি করে। ১৩ মার্চ মধ্যরাতে বাংলাট্রিবিউনের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি আরিফুল ইসলামকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
 
মূলত অনিয়ম নিয়ে সংবাদ প্রকাশের জের ধরে ডিসি সুলতানার নির্দেশে তাকে তুলে নিয়ে শায়েস্তা করা হয় বলে তদন্তে উঠে আসে। পরে ডিসি সুলতানাকে সরিয়ে দেওয়া হয়। আর ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ডিসি অফিসের তিন কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করা হয়। সুলতানা পারভীনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত এখনও চলমান রয়েছে।
 
পদোন্নতি দুই দফায়

করোনা মহামারির মধ্যেও অতিরিক্ত সচিব এবং যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতি দিয়েছে সরকার। গত ৫ জুন ১২৩ উপসচিবকে পদোন্নতি দিয়ে যুগ্মসচিব করা হয়। আর ২৬ সেপ্টেম্বর ৯৮ জন যুগ্মসচিবকে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দেয় সরকার। এছাড়া ২৬ জন কর্মকর্তাকে সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়।
 
ইউএনওর ওপর হামলায় প্রশাসনে ক্ষোভ

দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটে সরকারি বাসভবনে গত ২ সেপ্টেম্বর দিবাগত গভীর রাতে সন্ত্রাসীদের হামলায় গুরুতর আহত হন ইউএনও ওয়াহিদা খানম ও তার বাবা ওমর আলী। ওয়াহিদা খানমের মাথায় হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে দুর্বৃত্তরা। তাকে প্রথমে রংপুরে এবং পরে ৩ সেপ্টেম্বর দুপুরে হেলিকপ্টারে করে অচেতন অবস্থায় ঢাকায় ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স অ্যান্ড হসপিটালে ভর্তি করা হয়। ওই দিনই তার মাথায় অস্ত্রোপচার হয়।
 
এর প্রায় এক মাস পর সুস্থ হয়ে ১ অক্টোবর হাসপাতাল থেকে ছাড়া পান ওয়াহিদা খানম। স্বামী-স্ত্রীকে ঢাকায় একই কর্মস্থলে রাখতে ১৬ সেপ্টেম্বর ইউএনও ওয়াহিদা খানম ও তার স্বামীকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়।
 
এক দাবিতে এক মঞ্চে ২৯ ক্যাডারের কর্মকর্তারা

ডাক্তার, পুলিশ, প্রশাসন, বিচারকসহ বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের এক দাবিতে এক মঞ্চে ওঠার রেকর্ড নেই। তবে কুষ্টিয়ায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙার প্রতিবাদে ১২ ডিসেম্বর ঢাকাসহ সারাদেশে সরকারি কর্মচারীরা ‘জাতির পিতার সম্মান রাখবো মোরা অম্লান’ স্লোগান সামনে রেখে প্রতিবাদ সমাবেশ করেন। কেন্দ্রীয়ভাবে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সরকারি কর্মকর্তা ফোরাম এই সমাবেশের আয়োজন করে। সমাবেশে সরকারি শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের পাশাপাশি পুলিশের উচ্চ পদস্থ কর্তা-ব্যক্তিরা অংশ নেন।
 
করোনায় প্রতিমন্ত্রী ও দুই সচিবের মৃত্যু

করোনার বছরে মন্ত্রিসভার সদস্যদের মধ্যে আক্রান্তের ঘটনা ঘটেছে। অধিকাংশই সুস্থ হলেও গত ১৩ জুন রাতে ধর্ম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী শেখ মো. আব্দুল্লাহ মারা যান।
 
আর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ২৯ জুন মারা যান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব আবদুল্লাহ আল মোহসীন চৌধুরী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ২১ জুলাই মারা যান আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের সচিব নরেন দাস।
 
মন্ত্রীদের মধ্যে আক্রান্ত হন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন, তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন, শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং।
 
প্রতিমন্ত্রীদের মধ্যে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন, পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম।
 
নতুন ধর্ম প্রতিমন্ত্রী

করোনায় ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মো. আব্দুল্লাহ মারা যাওয়ার পর গত ২৫ নভেম্বর নতুন ধর্ম প্রতিমন্ত্রী নিয়োগ পান জামালপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য মো. ফরিদুল হক খান দুলাল। আর ১৩ ফেব্রুয়ারি তিন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর দফতর বদল করা হয়। এরমধ্যে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমকে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদকে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মো. আশরাফ আলী খান খসরুকে সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৪৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩০, ২০২০
এমআইএইচ/এজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।