মৌলভীবাজার: চা চিরসবুজ উদ্ভিদ প্রজাতি। চা বানানোর জন্য গাছের সমস্ত পাতা কখনোই নেওয়া হয় না।
চা সেকশনগুলোতে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, প্রয়োজনীয় বৃষ্টিপাত, অনুকূল আবহাওয়ায় এখন ধীরে ধীরে সমৃদ্ধির দিকে এগুচ্ছে চা শিল্প। এতদিন যে গাছগুলো মারাত্মক খড়ার মুখোমুখি পড়েছিল এবং যে চা গাছগুলো মরে যেতে বসেছিল। সেগুলোতে প্রাণ ফিরে পেয়েছে।
মৌলভীবাজার জেলার একমাত্র আবহাওয়া অফিস ‘শ্রীমঙ্গল আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার’র আবহাওয়া পর্যবেক্ষক মো. মুজিবুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ১২ এপ্রিল ১ মিলি, ১৩ এপ্রিল ১৫ মিলি, ১৭ এপ্রিল ২৮ মিলি, ১৮ এপ্রিল ২ মিলি, ২১ এপ্রিল ১৮ মিলি এবং ২৪ এপ্রিল ১৩ মিলিমিটার অর্থাৎ মোট ৭৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে চলতি এপ্রিল মাসে। আগামীতে আরও বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে মৌলভীবাজারে।
বাংলাদেশীয় চা সংসদের (বিটিএ) মালিকপক্ষের প্রতিনিধি এবং সিনিয়র টি-প্ল্যান্টার ইবাদুল হক বাংলানিউজকে বলেন, এখনকার এই বৃষ্টিপাত এবং আবহাওয়া চায়ের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এতে করে চা গাছ তার প্রয়োজনীয় পানির জোগানটুকু পায়। অনায়াসে সে তার পানি শোষণ করে পুনর্জীবিত হতে পারবে। এটাকে আমাদের চায়ের অভিধানিক ভাষায় বলে ‘ফিন্ডক্যাপাসিটি-১৫’। যদি ফিল্ডক্যাপাসিটি-১৫ এর নিচে যায় তখন অনেকক্ষেত্রে উল্টো চা গাছের পানি মাটিতে নেমে আসে। তখন চা গাছ পানিশূন্যতায় মারা যায়।
আদ্রতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখনকার প্রয়োজনীয় বৃষ্টিপাত, সূর্যোলোক, আদ্রতা সব মিলিয়ে এই আবহাওয়া চা এর অত্যন্ত উপকারী। বাতাসে আদ্রতা এবং প্রায় ৯০ শতাংশ। বাতাসে আদ্রতা ৮০ শতাংশের ওপরে থাকলে মাটির পানিটা ওপরে যায় না। তখন গরমভাব থাকবে। গাছের জন্য গরমও প্রয়োজন। এখন পুরো আবহাওয়াটা চা গাছের ফেভারে (পক্ষে)।
‘কিন্তু এখানে কথা আছে! গত ৪-৬ মাস আমাদের বিশাল খরা গিয়েছে। এতে করে অনেক চা গাছের মাথা শুকিয়ে গেছে। এই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পেতে হলে আরও তিন মাস চেষ্টা করে যেতে হবে। তিন মাস বৃষ্টিপাত হতে হবে, চা গাছের যে মাথাগুলো অর্থাৎ সেকশনের (চা এর সুনির্দিষ্ট এলাকা) টেবিলটা (একই উচ্চতার চা গাছের সারি) শুকিয়ে নিচে নেমে গিয়েছিল ৩৫ ইঞ্চির নিচে (স্টেপআপ) সেটাকে বৃদ্ধি করতে হবে। একটা চা বাগানের সর্বোচ্চ উচ্চতা থাকে ৩৫ ইঞ্চি। যদি কোনো সেকশেনের চা গাছ ১ ইঞ্চি নিচে অর্থাৎ ৩৪ ইঞ্চিতে নামে তবে হেক্টর প্রতি ১০০ কেজি পাতা কমে যায়। ‘
খরায় চা গাছের আত্মরক্ষার দিকটি উল্লেখ করে তিনি জানান, মাটিতে যখন পানি থাকে না, তখন স্বাভাবিকভাবে চা গাছ তার সমস্ত পাতা ঝরিয়ে দেয়। তখন কিন্তু চা গাছটা মরে না। এটাকে বাংলায় বলে অভিযোজন। চা গাছের পাতার নিচে ছোট ছোট ছিদ্র আছে। চা গাছে পাতা থাকলে মাটির পানি বেশি শোষণ করে। চা গাছ যখন বুঝতে পারে মাটিতে প্রয়োজনীয় পানি নেই তখন অভিযোজন প্রক্রিমার মাধ্যমে সে খরার মাঝেও বা পানিশূন্যতার মাঝেও নিরন্তর বেঁচে থাকার চেষ্টা চালিয়ে যায়।
খরা পরবর্তী ব্যবস্থা প্রসঙ্গে এই অভিজ্ঞ টি-প্ল্যান্টার বলেন, ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি বসন্তকাল। কিন্তু দেখা গেছে ফেব্রুয়ারি এবং মার্চ পর্যন্ত শীত দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে। অন্যান্য বছর মার্চ থেকে বৃষ্টিপাত শুরু হয়ে যায়, কিন্তু এবার সেটা হয়নি। বৃষ্টি হলো এপ্রিলে। এবার ফেব্রুয়ারি-মার্চ পর্যন্ত রাতে শীত পড়েছে এবং কুয়াশার আবরণ ছিল। আর দিনের বেলায় গরম। এটা আমাদের চা পাতা বৃদ্ধির জন্য অন্তরায়। দিনের তাপমাত্রা যদি ৩৫ ডিগ্রির ওপরে যায় তাহলে চা গাছের বৃদ্ধি থেমে যাবে। দিনের তাপমাত্রা থাকলে হবে ৩২ থেকে ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। চায়ের জন্য কুয়াশাও একটি বিরাট অন্তরায়। এর কারণ হলো, সূর্যের আলো যখন পাতার ওপর পড়বে তখন কিন্তু পাতায় খাদ্য প্রস্তুত হয়। যখন সকাল ১০টা পর্যন্ত কুয়াশা থাকে তখন সূর্যের আলো পাতা পড়ে কম। ফলে খাদ্য প্রস্তুত হয় কম। গ্রুথ (বৃদ্ধি) থেমে যায়। এবার মার্চ পর্যন্ত কুয়াশা ছিল। আবহাওয়া ও জলবায়ুর কারণেই চা শিল্পে দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে খরা।
বাৎসরিক তুলনায় তিনি বলেন, গত বছর এপ্রিল মাসের তুলনায় এবার এপ্রিল মাসে উত্তোলিত মোট চা পাতা এবার গড়ে ৭০ শতাংশ পেছনে রয়েছে। আকাশ মেঘলা থাকলেও কিন্তু চা পাতার বৃদ্ধি হবে না। ধরেন, ভোর ৫টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা এই ১২ ঘণ্টার মধ্যে মিনিমাম ৭/৮ ঘণ্টা রোদ থাকতে হবে। মনে করেন, বৃষ্টিপাত হলো কিন্তু আকাশ বেশিরভাগ সময়ই মেঘলা তাহলে চা পাতা সঠিকভাবে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হবে না।
আমাদের এখানকার আবহাওয়া চায়ের জন্য একেবারেই অনুকূলে। যদি কীটপতঙ্গ এবং রোগবালাই নিয়ন্ত্রণে থাকে তাহলে চা পাতার প্রাণপ্রাচুর্য উত্তর উত্তর বৃদ্ধি পাবে বলে জানান সিনিয়র টি-প্ল্যান্টার ইবাদুল হক।
বাংলাদেশ সময়: ০৭০৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৫, ২০২৫
বিবিবি/এএটি/জেএইচ