ঢাকা, শুক্রবার, ৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ২৩ মে ২০২৫, ২৫ জিলকদ ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

সোনাগাজীর সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পে কৃষি বিপর্যয়

সোলায়মান হাজারী ডালিম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯:১৯, মে ২৩, ২০২৫
সোনাগাজীর সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পে কৃষি বিপর্যয় সোনাগাজীর সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প

ফেনী: সোনাগাজীর আদর্শ গ্রাম ও চর চান্দিয়ার সবুজ বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল। সেখানে এক সময় ধানের চাষ হতো, বিচরণ করতো গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়া।

স্থানীয়দের মৎস্য আহরণের উৎসও ছিল এই চরাঞ্চল। চাষাবাদের সম্ভাবনা ছিল তরমুজের মতো ফলসহ বিভিন্ন ধরনের সবজির।

কিন্তু কৃষির অপার সম্ভাবনার এই চরে গড়ে তোলা হয়েছে সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প। উৎপাদিত এই বিদ্যুৎ আলো ছড়ানোর কথা থাকলেও স্থানীয়রা বলছেন, ছিটেফোঁটাও মিলছে না তাদের ভাগ্যে। অমিত সম্ভাবনার কথা বলা হলেও এই প্রকল্প এখন যেন স্থানীয়দের জন্য বিষফোঁড়া।

স্থানীয় কৃষক, মৎস্যজীবী ও সাধারণ মানুষ বলছেন, তারা ফসল উৎপাদন ও পশুপালন করতে পারছেন না। এমনকি তারা মাছ ধরার অধিকারও হারিয়েছেন।

স্থানীয়দের অনেকেই বাধ্য হয়ে প্রকল্পের জন্য জমি ছেড়ে দিয়েছেন। প্রকল্প এলাকার গ্রাম ও আশপাশের ১০ হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। প্রকল্পে তাদের যে চাকরি বা কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তার কোনো বাস্তবায়ন হয়নি।

ইকবাল হোসেন হেলাল নামে স্থানীয় এক কৃষক বলেন, এই গ্রাম ও আশপাশের ১০ হাজার পরিবার এই সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত। এই চরে এক সময় ধান হতো। মাছের মৌসুমে মাছ থাকতো। চরের জমিতে বিচরণ করতো গবাদি পশু। এখন কিছুই করার নেই। মানুষ হয়ে পড়েছে কর্মহীন।

আবদুল খালেক নামে একজন বাথান মালিক জানান, এই চরই ছিল তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বর্ষাকালে কোটি টাকার মাছ আহরণ করা যেত। ইরি-বোরো ধানের মৌসুমে উৎপাদন হতো কয়েকশ টন ধান। সব শেষ এখন। মানুষ যে কিছু করে খাবে তার আর উপায় নেই।

স্থানীয়দের অভিযোগ প্রকল্প শুরু হওয়ার সময় বলা হয়েছিলো স্থানীয় বেকার যুবকসহ সব শ্রেণির মানুষের কর্মসংস্থান হবে এই প্রকল্পে। সেই উদ্দেশ্যে সিভি আহ্বান করা হলেও কাজ পাননি স্থানীয়রা।  

রহমত উল্লাহ সজীব নামে স্থানীয় এক যুবক বলেন, প্রকল্পের শুরুতে লোভ দেখানো হয়েছিল এখানে কর্মসংস্থান হবে স্থানীয়দের। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। সব শুভঙ্করের ফাঁকি।

এলাকার প্রান্তিক খেটে খাওয়া কৃষকরা বলছেন, উর্বর এই কৃষি জমিতে সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এটির কারণে এই এলাকার ১০ হাজারের বেশি মানুষ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

ইয়াসিন সওদাগর নামের আরেক প্রান্তিক কৃষক বলেন, ‘হেতেরা কারণ তৈয়ার করছে হেতারগো সুবিধার লাই, লোকাল পাবলিকের কিছু নাই। লোকাল মানুষ সব দিক দি ক্ষতিগ্রস্ত। ’ তিনি জানান, স্থানীয়দের চাষাবাদ, মাছ আহরণ কিংবা গবাদি পশু বিচরণের জন্য কোনো জায়গা খালি নেই এই প্রকল্পের কারণে। সংশ্লিষ্টরা একটু একটু করে পুরো চর গিলে খাচ্ছে।

সোনাগাজী উপজেলায় ৭৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে এক হাজার একর জমির ওপর। ২০২১ সালে শুরু হওয়া এই প্রকল্পটি ২০২৪ সালের এপ্রিল থেকে উৎপাদনে এসেছে। চীনের দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে ইলেকট্রিসিটি জেনারেশন কোম্পানি অব বাংলাদেশ (ইজিসিবি)। ব্যয় হয়েছে ৭৫৬ কোটি ৭৬ লাখ টাকা, যার অর্থায়ন করেছে বিশ্বব্যাংক, বাংলাদেশ সরকার ও ইজিসিবি।

বর্তমানে সেখানে আরও একটি ২২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে, যার জন্য অতিরিক্ত প্রায় ৭০০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হবে। এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ২১৩৩ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। প্রস্তাবটি ইতোমধ্যে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে।

প্রকল্পটির উপ-সহকারী প্রকৌশলী রুবেল চন্দ্র দাস বলেন, পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়নের পরই এই প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। বিশাল চরাঞ্চল হওয়ায় এখানে প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে।

তবে বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। স্থানীয় কৃষক, মৎস্যজীবী ও সাধারণ মানুষ বলছেন, সোনাগাজী সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণে তারা কৃষি, পশুপালন ও মাছ ধরার অধিকার হারিয়েছেন। চরজুড়ে একসময় ধান, তরমুজ ও অন্যান্য সবজি চাষ হতো। বর্ষাকালে আহরণ করা যেত কোটি টাকার মাছ। গরু-মহিষ চরতো স্বাধীনভাবে। এখন সবই বন্ধ।

স্থানীয়রা অভিযোগ করছেন, প্রকল্পের সময় চাকরির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও বাস্তবে স্থানীয় কেউ কাজ পাননি। এমনকি একজন দারোয়ানও নয়।

প্রকল্পটির জমি অধিগ্রহণে জোর-জবরদস্তির ঘটনা না থাকলেও অনেকেই বাধ্য হয়েই জমি দিয়েছেন। আশপাশের অনেক জমি প্রকল্পে চলে যাওয়ায় দিতে হয়েছে নিজেরটাও। এলাকার বাসিন্দা কবির আহম্মদ বলেন, এক টুকরো জমি ছিল চরে। ধানের মৌসুমে ধান হতো। বাকি সময় চরতো গরু-মহিষ। আশপাশের সব জমি প্রকল্পে দিয়ে দেওয়ায় দিয়েছেন নিজেরটাও।

জানা গেছে, জমি অধিগ্রহণের সময় মৌজার রেট অনুযায়ী জমি মালিকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে।

চরে সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে ভিন্নমত প্রকাশ করছেন স্থানীয় বিশিষ্টজনেরা। ফেনীর স্থানীয় লেখক ও গবেষক ফিরোজ আলম বলছেন, এই চর হারিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নদীর গতিপথ। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জীববৈচিত্র্য ও মৎস্য খাত। নষ্ট হয়েছে গবাদি পশুর বিচরণ ক্ষেত্রও।

ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানের পর কোনো স্থানীয় জনপ্রতিনিধিকে পাওয়া যায়নি প্রকল্প নিয়ে কথা বলার জন্য। তবে স্থানীয় চর চান্দিয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান সামছুদ্দিন খোকন জানান, এক শ্রেণির সুবিধাবাদী গোষ্ঠী চরের এই জমি নষ্ট করে এই প্রকল্প তৈরির সুযোগ করে দিয়েছে। প্রকল্পে লুটপাটের একটা অংশের ভাগীদার পলাতক জনপ্রতিনিধিরাও।

সোনাগাজী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাইন উদ্দিন আহমেদ বলেন, ফেনীর সোনাগাজী আদর্শ গ্রামের এই চর ও চর চান্দিয়ার চরগুলোয় বোরো ধান আবাদ হয়। এছাড়া কিছু জমিতে তরমুজের আবাদও ভালো হয়। এছাড়াও বর্ষা মৌসুমে স্থানীয়রা এখানে মৎস্য আহরণ করতো। গরু-মহিষসহ সব ধরনের গবাদি পশু পালনেও এই চরাঞ্চল ইতিবাচক ভূমিকা রাখতো। সব মিলিয়ে এই চরাঞ্চলকে কৃষির জন্য উর্বর ভূমি বলা যায়।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সোনাগাজী উপজেলা সভাপতি শেখ আবদুল হান্নান বলেন, যেখানে সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হয়েছে সেটি ছিল একটি উর্বর চর। যেখানে যেমন চাষাবাদ হতো তেমনি বর্ষা মৌসুমে হতো মাছের বিচরণ। গবাদি পশু লালন-পালনেরও অন্যতম ঠিকানা ছিল এই চর। এই প্রকল্পটির কারণে বিশাল কৃষি অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যে ক্ষতি হয়েছে, তার কোনো শেষ নেই। স্থানীয়দের এত ক্ষতির পরও এই প্রকল্প থেকে সিকি পরিমাণও উপকৃত হয়নি স্থানীয়রা। এখানে উৎপাদিত বিদ্যুৎও চলে যাচ্ছে অন্যদিকে।

স্থানীয়রা বলছেন, উর্বর এই কৃষি জমিতে এমন প্রকল্প না করে বিকল্প ভাবতে পারতো কর্তৃপক্ষ। বড় বড় ইমারত কিংবা ভবনের ছাদেও এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যেত। এমন প্রকল্পের কারণে স্থানীয় পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যেও পড়তে পারে বলেও আশঙ্কা তাদের।

এসএইচডি/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।