নাটোর: কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম চামড়ার আড়ত নাটোরের চকবৈদ্যনাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন আড়তদার ও স্থানীয় পাইকাররা। কিন্তু চামড়া কেনাবেচায় চলতি মৌসুমে নানা জটিলতার মুখোমুখি হচ্ছেন স্থানীয় পাইকাররা।
আড়তদার ও পাইকারদের অভিযোগ, সরকার যে নির্ধারিত মূল্যে চামড়া কেনার নির্দেশ দিয়েছে, বাস্তবে তা মেনে চলা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ হিসেবে তারা বলছেন চামড়ার গুণগত মানের তারতম্য ও লাম্পি স্কিন ডিজিজ ভাইরাসের কারণে সব চামড়া এক দামে কেনাবেচা হচ্ছে না।
রাজশাহী, জয়পুরহাট, নওগাঁ, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, কুষ্টিয়াসহ আশপাশের জেলার বিভিন্ন উপজেলা এবং নাটোর জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন মাদরাসার শিক্ষক ও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ভ্যান, ট্রলি, ইজিবাইক, পিকআপে করে আড়তগুলোতে নিয়ে আসছেন লবণজাত করা কাঁচা চামড়া।
তবে আড়তে এসে তারা চামড়া নিয়ে পড়েছেন বিপাকে। তাদের অভিযোগ, সরকার নির্ধারিত দামে চামড়া কিনছেন না আড়তদাররা। ফলে তাদের সংগ্রহকৃত চামড়ায় লোকসান হচ্ছে। অপরদিকে আড়তদার ও স্থানীয় পাইকাররা বলছেন, তারা ঠিকঠাক দামেই চামড়া কেনা বেচা করছেন। তবে চামড়ায় লাম্পি স্ক্রিন ভাইরাসের জন্য সব চামড়া এক দামে কেনাবেচা হচ্ছে না। এছাড়া চামড়ার গুণগত মান, মান ভেদেও দাম দেওয়া হচ্ছে। কারণ সরকার নির্ধারিত দামে সব চামড়ার দাম দেওয়া হলেও ট্যানারি মালিকদের কাছে তারা সঠিক দাম পাবেন না। এতে তাদের লোকসান গুনতে হবে।
জানা যায়, ঈদের দিন শনিবার (৭ জুন) বিকেল থেকেই এ আড়তে চামড়া আসতে শুরু হয়। বিকেল থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত মানভেদে গরুর চামড়া ৫০০ টাকা এক হাজার টাকায় বিক্রি হতে দেখা যায়। আর ছাগলের চামড়া ৪০ টাকা থেকে ৫০ টাকা দরে কেনাবেচা হয়। তবে এবছর ঢাকার বাইরে গরুর চামড়ার সর্বনিম্ন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে এক হাজার ১৫০ টাকা।
রোববার (৮ জুন) বিকেলে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মৌসুমি ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন মাদ্রাসা থেকে শিক্ষকরা ভ্যান, ট্রলি, ইজিবাইক, পিকআপে করে নাটোর শহরের চক বৈদ্যনাথ এলাকার আড়তগুলোতে চামড়া আনতে দেখা গেছে। এদিনও চামড়ার দাম নিয়ে তারা নানা অভিযোগ করেছেন। তারা বলেছেন, নানা অজুহাতে আড়ত মালিকরা তাদের নির্ধারিত দাম দিতে চাইছেন না। নির্ধারিত দাম না পেলে চামড়া পাচার হওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা।
রাজশাহী থেকে আসা মজিবর রহমান ও মহসিন আলী নামে দুই মৌসুমি ব্যবসায়ী অভিযোগ করেন, ছাগলের চামড়া ২৫ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত দামে আমরা বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে ঘুরে কিনেছি, সেগুলো নাটোরের আড়তে এনে ৪০ টাকা দরে বিক্রি করেছি। পিস প্রতি মাত্র ১০ টাকা করে লাভ হয়েছে। অন্যদিকে গরুর চামড়ার দামও কম বলছেন আড়তদাররা। আড়তদারদের হাঁকা দামে গরুর চামড়া বিক্রি করলে তাদের লোকসান হবে। এরপরও কোনো উপায় না পেয়ে তারা কম দামেই চামড়া বিক্রি করছেন। কারণ বিকল্প কোনো স্থানে বিপণন ব্যবস্থা না থাকায় এবং চামড়া পচনশীল একটি পণ্য।
একই অভিযোগ করেন নাটোরের সিংড়া থেকে আসা পুটিমারি মাদসার শিক্ষক মোহাম্মদ আলাউদ্দিন। তিনি বলেন, সরকার নির্ধারিত দরে এখানকার আড়তদারেরা চামড়া কিনছেন না। যা অত্যন্ত দুঃখজনক। ষাঁড় গরুর চামড়া ৫০০ টাকা থেকে ৬০০ টাকা আর গাভীর চামড়ার দাম ২৫০ টাকা থেকে ৪০০ টাকা দাম হাঁকছেন। এ দামে বিক্রি করলে শুধু গাড়ি ভাড়ার টাকা হবে, আসল টাকাই উঠবে না।
এদিকে হঠাৎ করেই লবণের দাম বেড়ে যাওয়া এবং প্রচণ্ড গরম পড়ায় চামড়ার গুণগত মান নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় বেশি দামে চামড়া কিনতে পারছেন না আড়ত মালিকরা। চামড়া কম দামের কেনার কথা অস্বীকার করে নাটোর জেলা চামড়া ব্যবসায়ী গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল হালিম সিদ্দিকী বাংলানিউজকে বলেন, আমরা সরকারি দামেই চামড়া কেনা-বেচার চেষ্টা করছি। ঈদের দিনেই বাজারে ভালো বেচাকেনা হয়েছে। চামড়ার মান অনুযায়ী সঠিক দামেই চামড়া কেনা হচ্ছে। তবে লবণের দাম হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ায় চামড়া কেনায় কিছুটা প্রভাব পড়ছে।
নাটোর জেলা চামড়া ব্যবসায়ী গ্রুপের সহ-সভাপতি ও আড়তদার মো. নাসিম খান এবং রওশন নামে আরেক স্থানীয় আড়তদার বলেন, কিছু চামড়ায় লাম্পি স্কিন রোগ দেখা দেওয়ায় এসব চামড়াগুলো কম দামে আমরা কিনছি। তবে অন্যান্য বছরের তুলনায় এবছর চামড়ার দাম ভালো রয়েছে। গরুর চামড়া ৭০০ থেকে এক হাজার টাকা ও ছাগলের চামড়া ৩০ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত দামে আমরা কিনছি। সরকারি নিয়ম নীতি অনুসরণ করেই তারা চামড়া কেনাবেচা করছেন। জেলা প্রশাসন, সেনাবাহিনী, বিসিক থেকে বিষয়টি মনিটরিং করছে। বিক্রেতাদের অভিযোগ সঠিক নয় বলে তিনি দাবি করেন।
এদিকে বাজার মনিটরিং করতে ঈদের দিন সন্ধ্যা থেকে আজও চামড়ার আড়ত এলাকায় আসা নাটোর জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রাশেদুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, চামড়ায় সরকার নির্ধারিত দাম এক হাজার ১৫০ টাকা। আড়তে প্রচুর চামড়া বিক্রেতা ও ক্রেতার সমাগম ঘটেছে। তারা উৎসবমুখর পরিবেশে চামড়া কেনাবেচা করছেন। জেলা প্রশাসন সার্বক্ষণিক চামড়া বাজার মনিটরিং করছে। কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার খবর আমরা পাইনি। সব ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠুভাবে চলছে। পুলিশ, র্যাব, আনসার ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা আড়ত এলাকায় টহল দেওয়াসহ সার্বিক বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছেন।
নাটোর জেলা চামড়া ব্যবসায়ী গ্রুপ সূত্রে জানা যায়, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম কাঁচা চামড়া বাজার নাটোরে। এখানে প্রতি বছর কোরবানিতে ২৫ থেকে ৩০ জেলার চামড়া আসে। এবার নাটোর আড়তে গরু, ছাগল, মহিষ, ভেড়া মিলে প্রায় সাড়ে ১০ লাখ পিস চামড়া কেনাবেচার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এরমধ্যে গরুর চামড়া তিন লাখ পিস, খাসির চামড়া সাত লাখ পিস, মহিষের চামড়া ১০ হাজার পিস, ভেড়ার চামড়া ২০ থেকে ৩০ হাজার পিস। যার আনুমানিক দাম প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। ঢাকার বাইরে প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া ৫০ টাকা থেকে ৫৫ টাকা, ছাগল ২০ টাকা থেকে ২২ টাকা এবং খাসির চামড়া ২৫ টাকা ২৭ টাকা দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার।
আরআইএস