ফরিদপুর: অভাবের সংসারে বসে না থেকে নিজের মেধা ও পরিশ্রমকে কাজে লাগিয়ে সাফল্যের এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা পৌর এলাকার নাওরা মিঠাপুর গ্রামের গৃহিণী খাদিজা বেগম। মাত্র ১০ শতক জমিতে বিশেষ ধরনের ঘাস চাষ করে তিনি তৈরি করছেন গুড়।
তিন সন্তানের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সংসারের অভাব খাদিজা বেগমকে নতুন কিছু করার প্রেরণা জোগায়। স্বামীর সীমিত আয়ে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়লে তিনি বিকল্প আয়ের পথ খুঁজতে থাকেন। স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শে তিনি তার ১১৪ শতক জমির মধ্যে ১০ শতকে নেপিয়ার নামক একটি বিশেষ ঘাস চাষ শুরু করেন। এ ঘাস থেকেই বিশেষ প্রক্রিয়ায় গুড় তৈরির কৌশল তিনি শিখে নেন।
প্রথমে পরীক্ষামূলকভাবে শুরু করলেও তার তৈরি করা গুড় দ্রুতই ভালো সাড়া ফেলে। তিনি প্রতি কেজি গুড় ৪০০ টাকা দরে বিক্রি করছেন এবং গুড় ও ঘাস বিক্রি করে তার দৈনিক গড় আয় প্রায় ১৩০০ টাকা।
ঘাসের গুড়েই তার সাফল্য থেমে নেই। বাকি জমিতে তিনি দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ফল ও সবজি চাষ করছেন। তার বাগানে আপেল, পেঁপে, আঙুর এবং সৌদি আরবের খেজুর গাছও রয়েছে। এসব ফল ও সবজি বিক্রি করে তিনি প্রতিদিন প্রায় ১৫০০ টাকা আয় করেন। সব মিলিয়ে তার মাসিক আয় এখন ৮০ হাজার টাকারও বেশি, যা একসময়ের অভাবের সংসারে এনেছে সচ্ছলতা। তার সন্তানেরাও এখন ভালোভাবে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারছে।
নিজের অভাবনীয় সাফল্য নিয়ে খাদিজা বেগম বলেন, প্রথম দিকে অনেকেই হাসাহাসি করেছে, কিন্তু আমি হাল ছাড়িনি। এখন আমার এ কাজ দেখে অনেকেই উৎসাহ পাচ্ছে। আমি চাই আমার মতো আরও অনেক নারী সামনে আসুক এবং স্বাবলম্বী হোক।
খাদিজা বেগমের স্বামী মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম গর্বের সঙ্গে বলেন, আমি চাকরির পাশাপাশি আমার স্ত্রীকে যতটুকু সম্ভব সাহায্য করি। ওর এই সাফল্য দেখে আমি গর্বিত। ওর জন্যই আজ আমাদের সংসারে এত সুখ আর শান্তি।
খাদিজার কাছ থেকে নিয়মিত গুড় কেনেন এমন একজন ক্রেতা আলমগীর কবির।
তিনি বলেন, খাদিজা আপার গুড় খুবই সুস্বাদু এবং স্বাস্থ্যসম্মত। এটা সাধারণ গুড়ের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তাই আমি নিয়মিত এখান থেকেই গুড় কিনি।
স্থানীয় মিঠাপুরের বাসিন্দা নবীর তালুকদার খাদিজার গুড়ের প্রশংসা করে বলেন, এ গুড়ের স্বাদ অনন্য। স্বাস্থ্যসম্মত এবং বিশুদ্ধ হওয়ায় আমি নিয়মিত এখান থেকে গুড় সংগ্রহ করি।
এছাড়াও, গোপালপুর গ্রামের বাসিন্দা ইকবাল হোসেন যিনি নিয়মিত ঘাস কিনেন।
তিনি জানান,খাদিজা বেগমের কাছ থেকে আমি প্রতিবার ১০০ টাকা দরে ঘাসের তিনটি আঁটি কিনি। তার এই উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়।
আরেক ক্রেতা নাওরা মিঠাপুরের বাসিন্দা শাহাদাত তালুকদার বলেন, আমি ৪০০ টাকা দিয়ে দুটি বড় আঁটি কিনি। তার ঘাসের মান খুবই ভালো।
এ উদ্ভাবনী উদ্যোগের প্রশংসা করে উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা নাহিদ আলী মীর বলেন, ঘাস থেকে গুড় তৈরির এ ধারণা আমাদের কাছে প্রথমে নতুন ছিল। কিন্তু খাদিজা বেগম তার পরিশ্রম ও একাগ্রতা দিয়ে এটি সফল করে দেখিয়েছেন। তার এ উদ্ভাবনী ক্ষমতা অন্য নারীদের জন্য একটি বড় অনুপ্রেরণা।
আলফাডাঙ্গা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তুষার সাহা বলেন, আমরা খাদিজা বেগমকে শুরু থেকেই বিভিন্ন ধরনের পরামর্শ ও কারিগরি সহায়তা দিয়েছি। তার এই সাফল্য আলফাডাঙ্গা এলাকার জন্য একটি দৃষ্টান্ত। তার দেখাদেখি আরও অনেক নারী কৃষিকাজে এগিয়ে আসবেন বলে আমরা আশা করি।
খাদিজা বেগম যেন বাংলাদেশের হাজারো গৃহিণীর জন্য এক নতুন আশার আলো। তার পরিশ্রম ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা প্রমাণ করে যে, সঠিক সুযোগ ও ইচ্ছাশক্তি থাকলে নারীরাও যেকোনো ক্ষেত্রে সফল হতে পারে বলে যোগ করেন এ কৃষি কর্মকর্তা।
জেএইচ