ঢাকা: অনিয়ম ও আইন লঙ্ঘনের কারণে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত জীবন বিমা কোম্পানি পদ্মা ইসলামী লাইফের ভ্যালুয়েশনের বেসিস অনুমোদন আটকে দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ‘বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)’। ফলে প্রতিষ্ঠানটি থেকে লভ্যাংশ পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছেন কোম্পানির পলিসিহোল্ডার ও শেয়ারহোল্ডাররা।
আগের বছর ২০১৩ সালেও পদ্মা লাইফ থেকে কোনো লভ্যাংশ পায়নি শেয়ারহোল্ডারা। ফলে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার এক বছর পরেই পচা কোম্পানির (জেড গ্রুপ) তালিকায় স্থান পায় প্রতিষ্ঠানটি।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির আবেদনের সময়ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে (বিএসইসি) মিথ্যা তথ্য দিয়েছিলো এই জীবন বিমা কোম্পানিটি। এ নিয়ে বাংলানিউজসহ কয়কেটি গণমাধ্যমে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তারপরও কোম্পানিটিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার অনুমোদন দেয় বিএসইসি।
বিএসইসির একটি সূত্র জানায়, ২০০৭ সালে পদ্মা লাইফের অনিয়ম-দুর্নীতি তনন্ত করতে গিয়ে পরিচালকদের মাধ্যমে ভুয়া বিল ভাউচার দিয়ে অর্থ আত্মসাতের প্রমাণ খুঁজে পায় বিলুপ্ত অধিদফতের নিয়োজিত অডিট ফার্ম। একই সঙ্গে কোম্পানিটি ২০০৯ সালের বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদনের হিসাবে গোঁজামিল করে। এ বিষয়ে তথ্য প্রমাণসহ অভিযোগ আসে বিএসইসিতে।
ওই অভিযোগ থেকে জানা যায়, পদ্মা লাইফ ২০০৪ সাল পর্যন্ত অ্যাকচুয়ারি ভ্যালুশেন রিপোর্টে ৮ কোটি টাকার বেশি লোকসানের তথ্য উপাত্ত উপস্থাপন করলেও পরিচালকরা তাদের মূলধন ৩ কোটি টাকার ওপর ১৫ শতাংশ হারে লভ্যাংশ বাবদ ১ কোটি ৩৫ লাখ টাকা তুলে নেন। তিনটি খাতে ভুয়া বিল ভাউচারের মাধ্যমে কোম্পানির একাধিক প্রকল্প থেকে ওই টাকা পরিচালকরা তুলে নেন।
এমন অনিয়ম দুর্নীতির তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা কোম্পানির চেয়ারম্যানসহ পরিচালনা বোর্ডের সদস্যদের ২ কোটি টাকা জরিমানা করে তা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পরিশোধের নির্দেশ দেয়। কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থার নির্দেশ তোয়াক্কা না করে নানা কৌশলে তা ধামা চাপা দেওয়া হয়েছে। এমনকি বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন থাকার পরও কোম্পানির আইপিওর জন্য প্রকাশিত প্রসপেক্টাসে সে তথ্য উপস্থাপন করা হয়নি।
এদিকে আইডিআরএ সূত্রে জানা গেছে, পদ্মা লাইফ ২০১২ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ৩ বছরে ব্যবস্থাপনা ব্যয় খাতে আইন লঙ্ঘন করে ৯১ কোটি ৩৯ লাখ টাকা অতিরিক্ত খরচ করেছে। এরমধ্যে ২০১২ সালে ৩২ কোটি ৮৮ লাখ, ২০১৩ সালে ৩১ কোটি ৪৪ লাখ এবং ২০১৪ সালে ২৭ কোটি ৭ লাখ টাকা।
আইন লঙ্ঘন করে গ্রাহকের টাকা খরচ করায় প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক অবস্থা ক্ষতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ জন্য কোম্পানিটির ২০১২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ৩ বছরের আর্থিক অবস্থা ক্ষতিয়ে দেখতে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান হুদা ভাসী চৌধুরী অ্যান্ড কোং কে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান পদ্মা লাইফের আয়, ব্যয়, সম্পদ ইত্যাদি বিষয়ে নিরীক্ষা করবে। এ জন্য কোম্পানির বিনিয়োগ, ঋণ এবং অগ্রিম, স্থায়ী সম্পদ ও অন্যান্য সম্পদ, গাড়ি, জমি ও বিল্ডিং, নগদ টাকা, ট্যাক্স ও ভ্যাট, চেয়ারম্যান ও পরিচালকদের সম্মানিসহ অন্যান্য সুবিধা পর্যালোচনা করে নভেম্বরের শেষের দিকে প্রতিবেদন দেবে।
এরপর প্রতিবেদনের তথ্য পর্যালোচনা করে পদ্মা লাইফ কর্তৃপক্ষকে আইডিআরএ’র কার্যালয়ে শুনানিতে ডাকা হবে। তারপর কোম্পানিটির ভ্যালুয়েশনের বেসিস অনুমোদন দেওয়া হবে কি হবে না সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এ প্রক্রিয়া শেষ করতে ২০১৬ সালের মার্চ থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সময় লেগে যেতে পারে।
যোগাযোগ করা হলে আইডিআরএ চেয়ারম্যান এম শেফাক আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, পদ্মা ইসলামী লাইফে কী কী অনিয়ম হয়েছে তা ক্ষতিয়ে দেখতে অডিটর নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অডিট প্রতিবেদন পাওয়ার পর কোম্পানিটির বিরুদ্ধে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
আইডিআরএ সূত্র জানায়, বেসিস অনুমোদন না হওয়া পর্যন্ত পদ্মা লাইফ অ্যাকচুয়ারি ভ্যালুয়েশন করতে পারবে না। আর অ্যাকচুয়ারি ভ্যালুয়েশন না হলে শেয়ারহোল্ডার ও পলিসিহোল্ডারদের জন্য লভ্যাংশ ঘোষণা করা যাবে না। কারণ জীবন বিমা কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার ও পলিসিহোল্ডররা কি পরিমাণে লভ্যাংশ পাবেন তা অ্যাকচুয়ারি ভ্যালুয়েশনের মাধ্যমে নির্ধারণ করে দেয় নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান।
জানতে চাইলে জি কিবরিয়া অ্যান্ড কো. এর প্রিন্সিপাল গোলাম মো. কিবরিয়া, এফসিএ জানান, জীবন বিমা কোম্পানির আর্থিক হিসাব নিরীক্ষণের জন্য অ্যাকচুয়ারি ভ্যালুয়েশন প্রয়োজন হয়। কোনো কোম্পানি ভ্যালুয়েশন না দিলেও নিরীক্ষা কাজ করা হয়। তবে তা নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। আর অ্যাকচুয়ারি ভ্যালুয়েশন না হলে কোনো জীবন বিমা কোম্পানি লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারে না।
এদিকে কোম্পানি আইনে কোম্পানির একটি এজিএম অনুষ্ঠিত হওয়ার ১৫ মাসের মধ্যে পরবর্তী এজিএম অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে। যদি কোনো কারণে ১৫ মাসের মধ্যে এজিএম করা না যায় তবে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিকে এজিএম’র জন্য আদালত থেকে অনুমোদন নিতে হবে।
পদ্মা লাইফের শেষ এজিএম অনুষ্ঠিত হয় ২০১৪ সালের ২০ নভেম্বর। সে হিসেবে কোম্পানিটিকে আগামী বছরের ২০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে এজিএম করতে হবে।
এজিএম’র বিষয়ে কোম্পানি আইনের ৮১(১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘প্রত্যেক কোম্পানি তার অন্যান্য সভা ছাড়াও প্রতি ইংরেজি বছরে তার বার্ষিক সাধারণ সভা হিসাবে একটি সাধারণ সভা অনুষ্ঠান করবে এবং ওই সভা আহ্বানের নোটিশে সেটাকে বার্ষিক সাধারণ সভা বলে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করবে। কোনো কোম্পানির একটি বার্ষিক সাধারণ সভা অনুষ্ঠানের তারিখ এবং তার পরবর্তী বার্ষিক সাধারণ সভা অনুষ্ঠানের তারিখের ব্যবধান ১৫ মাসের বেশি হবে না। ’
আর ৮০ (২) ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো কোম্পানি উপ-ধারা (১) এর বিধান পালনে ব্যর্থ হলে, কোম্পানির যেকোনো সদস্যের আবেদনক্রমে আদালত ওই কোম্পানির বার্ষিক সাধারণ সভা আহ্বান করতে অথবা আহ্বান করার নির্দেশ দিতে পারবে এবং আদালত ওই সভা আহ্বান অনুষ্ঠান ও পরিচালনার জন্য যেটা সমীচীন বলে বিবেচনা করবে সেই অনুর্বতী (consequential) ও আনুষঙ্গিক (incidental) আদেশ দিতে পারবে। ’
এ ব্যাপারে কথা বলতে পদ্মা ইসলামী লাইফের চেয়ারম্যান এ বি এম জাফরুল্লাহ ও প্রতিষ্ঠানটিতে চলতি দায়িত্বে থাকা মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা চৌধুরী মো. ওয়াসিউদ্দীনর মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তবে দুজনেরই মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
বাংলাদেশ সময়: ১১৪৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৯, ২০১৫
এএসএস/এমজেএফ/