জাকার্তা পোস্টের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক দামার হারসানতো সিঙ্গাপুরে এশিয়া জার্নালিজম ফেলোশিপে (এজেএফ) অামার ফ্ল্যাটমেট। ১০ সপ্তাহ অামরা একই ছাদের নিচে বাস করেছি।
পূর্ব জাকার্তার জাতিনেগারা ইন্দাহ হাউজিং কমপ্লেক্সে যেতে আমাদের প্রায় দেড় ঘণ্টা সময় লেগে গেলো। একতলা সুন্দর বাড়ি দামারের। বাড়ির সামনে নামতেই তার পোষা কুকুর কেরানের হইচই শুরু হয়ে গেলো। দীর্ঘ ১০ সপ্তাহ পর দামারকে দেখে কেরান যে কি করবে যেন বুঝে উঠতে পারছিল না! একবার ডানে ঝাঁপায় তো একবার বামে।
দামারের স্ত্রী লিসা গুনাওয়ান এসে গেট খুলে দিলেন। সিঙ্গাপুরে এজেএফ এর বিদায়ের সুরের বেদনা আর ভ্রমণের ক্লান্তি বেশিক্ষণ জেগে থাকতে দিলো না।
দামারের বাসাটা বেশ সুন্দর। সামনে একটু খোলা জায়গায় তার গাড়ি অার মোটরসাইকেল। কারেনের বিচরণ সেখানে। আর ভেতরে ঢুকলে বেশ বড় ড্রইং আর ডাইনিং রুম। এই বাড়িটি কিনে নিজের মনের মতো করে সাজিয়েছেন দামার। শিল্প অার চিত্রকলা সম্পর্কে তার জ্ঞান যে বিশেষ সেটা বোঝা যায় তার ঘরের দেয়ালের চিত্রকর্ম দেখেই। আর ডাইনিং টেবিলটাও বানানো হয়েছে ক্লাবের টেবিলের অাদলে।
শনিবার (১৪ অক্টোবর) সকালে নাস্তা শেষে বের হলাম অামি অার দামার। লিসা সকালেই ছেলে এরফান এবং মেয়ে হান্নাহকে নিয়ে স্কুলে চলে গেছেন। আজ স্কুলে অভিভাবক দিবস। দামার হাফপ্যান্ট পড়েই বের হলেন। রাতেই দামার শিখিয়ে দিয়েছেন কীভাবে কারেনকে বশ মানাতে হবে। যেন হাত দিয়ে ছুঁতে না যাই, বরং চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি। কারেন কিছুটা সময় নিলো অামার পায়ের কাছে এসে নাক দিয়ে গন্ধ শুঁকলো। দামার বললেন, পরিচিত করে নিচ্ছে তোমাকে।
দামার বেশ ভালো গাড়ি চালান। তার এই হাউজিং এলাকাটা বেশ সুন্দর। মূল শহর থেকে একটু দূরে হওয়ায় বেশ কোলাহলমুক্ত। তবে আমাদের যাত্রা এখন এরফান আর হান্নাহর স্কুল সেন্ট মারিয়া ফাতিমা জুনিয়র হাইস্কুলে। সেখান থেকে পরিবারের সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে দুপুরের খাবার খাওয়া হবে। পথে সিম কিনে নেয়া।
তবে দিনের বেলায় টের পেলাম যানজট কাকে বলে। ঢাকার তুলনায় কোনো অংশেই কম হবে না। মোটরসাইকেল বাহনের অ্যাপসগুলো জনপ্রিয় হওয়ায় মানুষ এখন বাসের চেয়ে বাইক ব্যবহার করছে বেশি। বেশ কয়েকটি লোকাল বাস দেখলাম, তবে প্রায় ফাঁকা। বরং গো-জ্যাক বা গ্র্যাবের হেলমেট পড়া যাত্রী আর চালকের সংখ্যা অনেক বেশি।
চার থেকে পাঁচ কিলোমিটার পথ যেতে প্রায় দুই ঘণ্টারও বেশি সময় লেগে গেলো। এখানে মোটরসাইকেল কোনো নিয়ম মানে না। সুযোগ পেলেই যেমন গাড়ির সামনে দিয়ে ঘুরে যায়, তেমনি ফুটপাতে উঠতেও কোনো গড়িমসি করে না।
সেন্ট মারিয়া স্কুলের দোতলাতে যেতেই প্রিন্সিপাল ইবু তিতুকের সঙ্গে দেখা। মিষ্টি হাসি দিয়ে পরিচয় দিলেন ভদ্রমহিলা। বাহসা ইন্দোনেশিয়ায় দামারকে জানালেন দুই সন্তানের পড়াশোনার বর্তমান অবস্থা। কথা বুঝতে না পারলেও অামার ধারণা এ ধরনের কথাবার্তাই হয়েছে। হান্নাহ স্কুলের বারান্দার ফ্লোরে বসে ছবি অাঁকছে। রোববার একটি চিত্রাংকন প্রতিযোগিতায় অংশ নেবে সে। স্কুলের মাঠে দুই দলে ভাগ হয়ে ফুটবল খেলছে প্রাথমিকের শিশুরা। নিজের শৈশবের কথা মনে পড়ে গেলো, স্কুলের বারান্দায় টেনিস বল দিয়ে ফুটবল খেলার দিনগুলো।
স্কুল থেকে বেরিয়ে অাবারো অাধা ঘণ্টার যানজট ঠেলে সুরান দারুস সোলো রেস্টুরেন্টে পৌঁছুলাম। এখানে জাকার্তার ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলো পাওয়া যায়। নাসি লাঙ্গি স্পেশাল অর্ডার দিলাম। হলুদ দেয়া ভাতের সঙ্গে এক টুকরো মুরগির মাংস, গরুর মাংসের ফ্রাই, সবজি, অালু দিয়ে এই খাবার সাজানো। খাবারের অাগে ক্যাথলিক এই পরিবার প্রার্থনা করলো ঈশ্বরের কাছে হাত জোড় করে। প্রার্থনায় অামাকেও অভিনন্দন জানানো হলো। তাদের অান্তরিকতায় অামি বিহ্বল। এটা অামার প্রত্যাশার বাইরে।
এমন সময় দামার জানালেন, আজ এই দম্পতির ১৬তম বিবাহ বার্ষিকী। অপরাধবোধ কাজ করলো খালি হাতে শুভেচ্ছা জানাতে। ডাবের পানি খেয়ে খাবারের পর্ব শেষ করলাম।
এবার সেন্ট্রাল জাকার্তা ঘুরে দেখা। যানজট ঠেলে অাবারো গুটি গুটি গতি গাড়ি চললো প্রায় অাধা ঘণ্টা। তবে এটা এক অন্য জাকার্তা। অাকাশছোঁয়া আর অনন্য নকশার সব স্থাপনা। এ স্থান অনেক পরিষ্কার, কুয়ালালামপুর শহরের অাদলে গড়া অনেকটা। আমরা চলে গেলাম জাতীয় স্থাপনায়।
হাজারো জাতির দেশ ইন্দোনেশিয়াকে এক সূত্রে বাঁধতে এই স্থাপনা 'মোনাস' তৈরি করা হয়েছে। যার মানে ইন্দোনেশিয়ার জন্য লড়াই করো। ৪৩৩ ফুট উঁচু এই স্থাপনার মাথায় ২৫ কেজি স্বর্ণ দিয়ে অাগুনের প্রতিকৃতি তৈরি করা হয়েছে। দামার জানান, ১৯৬১ সালে এই স্থাপনার কাজ শুরু হয়ে ১৯৭৫ সালে উদ্বোধন করা হয়। এখানে রয়েছে জাতীয় জাদুঘর।
মাঠের এক কোণায় অারেকটি ভাস্কর্য, নাম পাতুং ইকাদা। পাঁচ যুবক তাদের পেশী প্রদর্শন করে ইন্দোনেশিয়ার পতাকাকে রক্ষা করে রেখেছে।
এখানকার পার্কে ঘুরে বেড়ালাম কিছুক্ষণ। বেশ কিছু হরিণ রয়েছে এখানে। দামার জানালেন, প্রথম যখন হরিণগুলো শহরে নিয়ে অাসা হয়েছিল মিডিয়া তার বিরোধীতা করে। হরিণগুলো শহরে বাঁচবে না বলে ধারণা করা হয়। তবে মাস না যেতেই চিত্রা হরিণ বাচ্চা প্রসব করে এবং এখন সংখ্যায় কয়েকগুণ বেশি।
এখানকার পার্কের সঙ্গে ঢাকা পার্কের অনেক মিল। গাছের গোড়ায় আর বেঞ্চিতে বসে নতুন দুনিয়ার স্বপ্ন অাঁকছেন প্রেমিক যুগলেরা।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৩২ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৫, ২০১৭
এমএন/এসআই