ব্যাংকক (থাইল্যান্ড) থেকে: সাগর পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে মালয়েশিয়ার যাওয়ার সময় থাইল্যান্ড উপকূলে আটক হয়েছেন। জেল খেটে অনাহারে বা অর্ধাহারে মৃত্যু।
নাট্যনির্মাতা, অভিনেতা আফজাল হোসেন থেকে শুরু করে থাইল্যান্ডে আছেন সাধারণ ভ্রমণকারী। অনেকের মুখেই তার নাম। সবার ভরসার কেন্দ্রে তখন একটি মানুষ- আদম আলী মীর। প্রবাসে বাংলাদেশের স্বজন।
শূন্যহাতেই দেশ থেকে এসেছিলেন থাইল্যান্ডে। নিজের মেধা, সততা আর নিষ্ঠা কাজে লাগিয়ে আজ তিনি প্রতিষ্ঠিত। তার হাত ধরে প্রতিষ্ঠিতও হয়েছেন অনেকে।
কোনো থাই নারীকে নয়, বাংলাদেশি নারীকে বিয়ে করেছেন আদম আলী মীর। তারপরও থাইল্যান্ড সরকার তাকে দিয়েছে- ‘তাঙডাও’ স্থায়ী বা অভিবাসীর মর্যাদা।
দীর্ঘ তিন দশকের বেশি সময় ধরে আদম আলী বসবাস করছেন থাইল্যান্ডে। জীবনযুদ্ধে জয়ী এই মানুষটির শুরুর দিনগুলি ছিল কিন্তু গভীর ত্যাগ আর সংগ্রামের।
চার ভাই এক বোনের মধ্যে পাঁচ নম্বর তিনি। বয়স তখন ২২ বছর। নেশা উঠলো, বিদেশ যাওয়ার। ভিসা নিয়ে চলেই এলেন থাইল্যান্ডে। সেখানে তিনি কী করবেন, দিনগুলো কী করে চলবে তার কোনো পরিকল্পনা ছিল না তার। বিমান থেকে নেমে সোজা সৈকত নগরী পাতায়া। তখনকার পাতায়ার সঙ্গে এখনকার পাতায়ার ব্যবধান আকাশ-পাতাল।
ভাগ্য ভালো। মাসুদ নামে এক স্বদেশিকে পেলেন সেখানে। তার মারফতেই কাজ জুটে গেল এক টেইলারিং শপে। ব্যবসাও তখন বেশ জমজমাট। তবে বেতন বলতে শূন্য। পেটেভাতে। বুঝে গেলেন, এভাবে পড়ে থাকলে কিছুই হবে না। জেদ চাপলো বিদেশি খদ্দেরদের সঙ্গে যে করেই হোক ইংরেজিতে কথা বলতে হবে।
শিখেও গেলেন ইংরেজি ভাষা। উদ্দাম জীবনের এই সৈকত নগরীর বিনোদনের মাদকতা টানেনি আদম আলী মীরকে। তার লক্ষ্য কেবলই এগিয়ে যাওয়ার। এভাবে বছর তিনের পর পাতায়াকে বললেন, গুডবাই। চলে এলেন রাজধানী ব্যাঙ্ককে। ভারতীয় এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে পরিচয় হয় তার। কাজকর্মও ততদিনে শিখে নিয়েছেন। বেড়েছে নিজের ওপর নিজের আস্থাও। চোখে সেই অভিজ্ঞতার দ্যুতি দেখেই সেই ব্যবসায়ী তার টেইলারিং শপের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলেন আদম আলী মীরকে।
খাওসান রোড। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে দুনিয়ার ভিনদেশি পর্যটকদের মিলন মেলায় জমজমাট হয় সড়কটি। তবে পাতায়ার মতো নয়। ভিন্নরকম। বেশ রক্ষণশীল আর সুস্থ বিনোদনে ভরপুর। এটাও পছন্দ হলো আদম আলীর। মনস্থির করলেন, এখানেই হবে তার ঠিকানা। এখান থেকেই মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হবে তাকে। এভাবেই স্বপ্নগুলো ডানা মেলে উড়ে বেড়াতে লাগলো দূর আকাশে। ততদিনে বিশ্বাসযোগ্যতা, আস্থা আর সততায় আদম আলী ভিনদেশিদের কাছে জনপ্রিয়তার শীর্ষে। দেখা গেল, একজন ভিনদেশি একবার এসে তার সঙ্গে পরিচয়ের সূত্র ধরে পরের বার নিয়ে এলেন আরেক বন্ধুকে। এভাবেই বিস্তৃত হতে থাকে ব্যবসার পরিধি। এর সফলতায় ব্যবসা আরো সম্প্রসারিত হলো। বাড়লো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও। হলো গাড়ি, বাড়ি সবই। দেশ থেকে বেকার যুবকদের এনে শুরু করলেন তাদের প্রতিষ্ঠা করার আরেক সংগ্রাম। সঙ্গে চললো দেশের মানুষদের জন্য কিছু করার চেষ্টা। দেশের কেউ বিপদে পড়লেই ছুটে যেতেন তার কাছে। সাধ্যমতো কমিউনিটির সবাইকে নিয়ে প্রয়োজনে চাঁদা তুলে পাশে দাঁড়িয়েছেন স্বদেশির।
নাট্যনির্মাতা ও অভিনেতা আফজাল হোসেন চিকিৎসার জন্য ভর্তি হয়েছিলেন বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে। ঢাকা থেকে এক বন্ধুর ফোন পেয়ে স্ত্রী আশাকে নিয়েই ছুটে গেলেন সেখানে। সেখানে আফজাল হোসেনের স্ত্রী আর কোলের শিশু সন্তানের সেবায় নিয়োজিত করলেন নিজেকে। তারপর থেকে আফজাল পরিবারের সদস্য এই আদম আলী।
সপ্তাহখানেক আগে ঢাকার এক ব্যবসায়ী মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য গেলেন ব্যাঙ্কক হাসপাতালে। সেখানে নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়ায় পরিবারটির চোখেমুখে তখন অন্ধকার! যিনি পথপ্রদর্শক, তিনিই কিনা অসুস্থ। দ্রুত তাকে হাসপাতালে নিয়ে সুস্থ করে তবেই স্বস্তি আদম আলীর।
শাহাবুদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, আমার পরিবারের ঠিকানাই ছিল আদম আলী ভাইয়ের বাসা। আমি একা নই, অনেক বাংলাদেশিদের জন্য নিঃস্বার্থভাবে তিনতলা বাড়ির দুটি তলাই তিনি ছেড়ে দিয়েছেন। সঙ্গে খাবার-দাবারও।
আদম আলী জানালেন, অতীতে আমাদের দূতাবাস থেকে ফোন করে বলেছেন, ভাই, অমুকের লাশ তো পাঠানো যাচ্ছে না অর্থের অভাবে। আমরা জানা মাত্রই চাঁদা তুলে এভাবে অনেকের লাশ দেশে পাঠিয়েছি।
আসলে এই কাজেই আমার আনন্দ। আমার কাছে চেনা-অচেনা বলে কিছু নেই। মানুষের উপকার করাটাই যেন আমার রক্তের সাথে মিশে আছে। তাদের জন্য কিছু করতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে হয়।
তবে স্বদেশিদের প্রতি আদম আলীর এই ভালোবাসার বিপরীতে কে তাকে মূল্যায়ন করলো আর কে করলো না, সেই দিকে তার মোটেও নজর নেই। তার মতে, আমি কোনো কিছু পাওয়ার আশায় নয়, ভালোবেসে মানুষের জন্য কিছু করতে চাই। আর হ্যাঁ, অনেকেই এই সরলতার সুযোগ নিয়েছেন। আমি দেশ থেকে এনেছি ওদের ভাগ্য পরিবর্তন করাতে। দেখা গেছে, আমার গুরুত্বপূর্ণ দলিল চুরি করে আমারই কোম্পানির কর্ণধার পরিচয়ে ইউরোপে পাড়ি জমিয়েছে। পরে জেনে খারাপ লেগেছে। কিন্তু কিছু বলার নেই। মানুষের মধ্যে ভালো-খারাপ দুটোই আছে। আমার ভালোটা দিয়েই আমি মানুষের সেবা করে যেতে চাই।
মানুষের জন্য নিবেদিতপ্রাণ হওয়ার কথা মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ায় আদম আলী মীর এখন থাইল্যান্ডে বাংলাদেশি অনেকের কাছে প্রথম ঠিকানা। কারো ডাক্তার দেখাতে হবে, কারো শপিংয়ে সহযোগিতা করতে হবে, নিজেই গাড়ি নিয়ে ছুটে বেড়ান শহরের এ প্রান্ত থেকে সে প্রান্ত পর্যন্ত। এতে নেই কোনো বিরক্ত বা ক্লান্তি। ভালো কিছু করার মধ্যে রয়েছে অপার সুখ। সেই সুখেই ভেসে বেড়ান আদম আলী মীর।
তিনি বাংলানিউজকে জানান, একজনের পরিচয়ের সুবাদে আরেকজন; এভাবেই দেশে নানা পেশা ও শ্রেণির মানুষের সঙ্গে আমার বন্ধন। আমি মানুষের সঙ্গে মিশতে ভালোবাসি। আমার সৌভাগ্য আমাকে তারা এত ভালোবাসে! এখানে এলে তারা আমার সঙ্গে দেখা করেন। ক’জনার ভাগ্যেইবা এটা জোটে!
আবার উল্টো অভিজ্ঞতাও কম নয়। কোনো বিখ্যাত মানুষের স্বজনের ফোনে তাকে দেখতে হাসপাতালে। সেখানে ওই মানুষটির অসৌজন্যতাও তাকে কষ্ট দেয়।
তারপরও আদম আলী থামেন না। বিরতিহীনভাবেই নিজের দেশের মানুষের সেবায় নিয়োজিত করেছেন নিজেকে।
আসলে এই আদম আলীরাই তো পরবাসে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের হৃদয়। তারাই বিদেশে বাংলাদেশের নাম রাখবেন।
বাংলাদেশ সময়: ২১৪০ ঘণ্টা, আগস্ট ১২, ২০১৫
এবি
** সবার মুখে মুখে ‘লাক মে মাক মাক’
** পাতায়ার ‘ডন’
** বাংলার আলোয় আলোকিত পাতায়া